দুর্নীতির বিরুদ্ধে পদক্ষেপে সুফল পাচ্ছেন বন্দর ব্যবহারকারীরা

1

নিজস্ব প্রতিবেদক

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম মনিরুজ্জামান বলেছেন, চট্টগ্রাম বন্দরে সকল ধরনের সিন্ডিকেট, মনোপলি ভেঙে ব্যবসার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করার কার্যক্রম জোরদার করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে ২৩টি শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। সকল ক্ষেত্রে দুর্নীতি-অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, যার সুফল ইতিমধ্যে বন্দর ব্যবহারকারীরা পেতে শুরু করেছেন।
গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে চট্টগ্রাম বন্দরের শহীদ মুন্সী ফজলুর রহমান অডিটরিয়ামে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় তিনি এ কথা বলেন।
বন্দর চেয়ারম্যান বলেন, গত তিন মাসে চট্টগ্রাম বন্দরে কন্টেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে ৮ লাখ ৩০ লাখ ৫৮২ টিইইউ। যা বিগত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৭৬ হাজার ৯৮৬ টিইইউ বেশি। চট্টগ্রাম বন্দর ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের গত ৪ মাসে ১৬৪৩.৮৫ কোটি টাকা রাজস্ব আয় হয়েছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়কালের রাজস্ব আয়ের তুলনায় ২১.৮৫ শতাংশ বেশি।
এছাড়া গত ১৬ জুলাই চট্টগ্রাম বন্দরে ৪৫ হাজার ৫০০ কন্টেইনারের স্থিতি ছিল। গত তিন মাসে পদ্ধতিগত উদ্ভাবনের মাধ্যমে তা ৩৪ হাজারে নামিয়ে আনা হয়েছে। জাহাজের গড় ওয়েটিং সময় ছয়-আট দিন থেকে একদিনে নেমে এসেছে। চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ আসার পরই অন অ্যারাইভাল বার্থিং পাচ্ছে।
তিনি বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) পরিচালনায় ওপেন টেন্ডারের মাধ্যমে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করা হবে। এ টার্মিনালটি আন্তর্জাতিক অপারেটর ডিপি ওয়ার্ল্ডকে দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কাজ করছে। এ প্রক্রিয়া চ‚ড়ান্ত করতে এক বছরের মতো সময় লাগবে। এ অন্তর্বর্তী সময়ে পরিচালনার জন্য ওপেন টেন্ডারের মাধ্যমে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করা হবে। টেন্ডার যাতে প্রতিযোগিতামূলক হয়, সেজন্য এ সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপনের কিছু শর্ত সংশোধন করা হচ্ছে। সংশোধন শেষে দরপত্র আহŸান করা হবে। একইভাবে লালদিয়ার চরে লালদিয়া কন্টেইনার টার্মিনালে বিনিয়োগ ও পরিচালনার জন্য বিদেশি অপারেটরের সঙ্গে চুক্তি হবে। ডেনমার্কের এপি-মুলার মার্সকের সঙ্গে আগামী ছয় মাসের মধ্যে এ সংক্রান্ত চুক্তির বিষয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেন বন্দরের চেয়ারম্যান।
আমদানি পণ্যের কন্টেইনার পর্যাপ্ত হলে করাচি-চট্টগ্রাম রুটে ভবিষ্যতে নিয়মিত জাহাজ পরিচালনা করতে মালিকরা আগ্রহী জানিয়ে তিনি বলেন, ইতিপূর্বে পাকিস্তানের সঙ্গে সিঙ্গাপুর ও কলম্বো বন্দরের মাধ্যমে বাংলাদেশের পণ্য আমদানি-রপ্তানি হতো। নতুন রুট চালু হওয়ায় বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হলো। এতে সাশ্রয়ী ব্যয় ও সময়ে উভয় দেশের আমদানি রপ্তানি বাণিজ্যে নতুনভাবে গতিশীলতা সৃষ্টি হবে। এ লক্ষ্যে প্রথমবার গত ১১ নভেম্বর করাচি বন্দর থেকে লাইনার সার্ভিসের মাধ্যমে এইচআর শিপিং লাইনের অধীনে একটি জাহাজে ৩২৮ কন্টেইনার নিয়ে চট্টগ্রাম আসে। ১২ নভেম্বর কন্টেইনার খালাস করে চট্টগ্রাম ত্যাগ করে। জাহাজটি মূলত দুবাইয়ের জেবল আলী বন্দর থেকে যাত্রা শুরু করে করাচি বন্দর হয়ে চট্টগ্রাম আসে। জাহাজটির সাধারণ রাউন্টিং হচ্ছে দুবাই জেবল আলী-করাচি-চট্টগ্রাম-ইন্দোনেশিয়া-মালয়েশিয়া-মুন্দা (ভারত)-দুবাই।
এ সময় তিনি বলেন, ওপেন ইকোনমিতে একা চলতে পারবো না। সবাইকে নিয়ে চলতে হবে। একা হয়তো চলতে পারবো, কিন্তু অথনৈতিক সক্ষমতা বাড়বে না, উন্নতি করা যাবে না। সুতরাং ইনক্লুসিভনেস লাগবে। যে সিদ্ধান্তই নেওয়া হবে, দেশের স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে, বন্দরের স্বার্থে নেওয়া হবে। বন্দর যেখানে উপকৃত হবে, সাধারণ মানুষ যেখানে উপকৃত হবে, রাষ্ট্র যেখানে উপকৃত হবে, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এখানে ব্যক্তি স্বার্থের কোন বিষয় নেই।
বন্দরে দীর্ঘদিন ধরে পড়ে থাকা বিপজ্জনক কন্টেইনার প্রসঙ্গে বন্দরের চেয়ারম্যান বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরে বিপজ্জনক কন্টেইনার সংরক্ষণের জন্য নির্ধারিত ইয়ার্ডে প্রায় ১৪ থেকে ১৫ বছর ধরে ৪টি অতিদাহ্য সোডিয়াম নাইট্রোক্লোরাইড পরিবাহী ট্যাংক কন্টেইনার সংরক্ষিত ছিল। কন্টেইনারগুলো দীর্ঘদিন ধরে অনিষ্পন্ন অবস্থায় পড়ে থাকায় উচ্চ তাপমাত্রায় বিস্ফোরিত হওয়ার ঝুঁকি বিরাজমান ছিল; যা বন্দরকে সার্বক্ষণিক ঝুঁকিতে রেখেছিল। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার নির্দেশে এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও শুল্ক কর্তৃপক্ষের সার্বিক সহযোগিতায় চট্টগ্রাম বন্দর হতে গত ২৭ অক্টোবর অতিদাহ্য সোডিয়াম নাইট্রোক্লোরাইড ভর্তি ৪টি ট্যাংক কন্টেইনার নিলামের মাধ্যমে ডেলিভারি দেওয়া হয়েছে। এতে চট্টগ্রাম বন্দর বিস্ফোরণের ঝুঁকি হতে শঙ্কামুক্ত হয়েছে। এছাড়া বিপজ্জনক পণ্যের ৯টি কন্টেইনার রয়েছে, যা শ্রীলংকার কলম্বো বন্দরের মাধ্যমে ধ্বংস করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, দেশে জ্বালানি সমস্যা দ্রুত সমাধানের লক্ষ্যে ল্যান্ড বেইসড এলএনজি টার্মিনাল স্থাপনে মাতারবাড়ি বন্দরের ১ম ধাপের ২য় পর্যায়ে প্রথম ধাপের সাথে সংযুক্ত করা হয়েছে। ২য় পর্যায়ের ৬১৯ একর জমি অধিগ্রহণের প্রস্তাবনা কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের কাছে দেওয়া হয়েছে। বে-টার্মিনাল এলাকার সন্নিকটে বন্দরের নিজস্ব জমিতে ট্রাক টার্মিনাল নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। বে-টার্মিনাল, মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর এবং লালদিয়া টার্মিনালে ৬ জেনারেশন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে। এ বন্দরগুলো গ্রিন পোর্ট হিসেবে গড়ে তোলা হবে।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (প্রশাসন ও পরিকল্পনা) মো. হাবিবুর রহমান, সদস্য (হারবার ও মেরিন) কমডোর এম ফজলার রহমান, সদস্য (অর্থ) মোহাম্মদ শহীদুল আলম, সদস্য (প্রকৌশল) কমডোর কাওছার রশিদ, বন্দর সচিব ওমর ফারুক সহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।