রাঙামাটি জেলার দুর্গম এলাকাগুলোতে বিশুদ্ধ খাবার পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। কাপ্তাই লেকের পানি শুকিয়ে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া ও গত সেপ্টেম্বর থেকে বৃষ্টি না হওয়ার ফলে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। পাহাড়ি গ্রামগুলো ঝিরি বা ছড়ার পানির ওপর নির্ভরশীলতার ফলে বরকলসহ জেলার প্রতিটি উপজেলায় এখন বিশুদ্ধ খাবার পানির তীব্র সংকট চলছে।
দূর্গম পাহাড়ি এলাকাগুলোতে সুপেয় বা খাবার পানির জন্য মূলত প্রাকৃতিক ছড়া, ঝিরি ও কুয়ার পানির ওপর নির্ভর করতে হয়। এ জায়গাগুলোতে পানি শুকিয়ে যাওয়ার ফলে খাওয়ার পানির জন্য ওইসব গ্রামবাসীকে দূর থেকে পায়ে হেঁটে খাবার পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে। অনেক সময় কুয়ার পানি পান করে বিভিন্ন এলাকার মানুষ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। প্রতিবছর পানিবাহিত রোগে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে। তবে, এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি।
বরকল উপজেলার সুবলং ইউনিয়নের মিতিঙ্গাছড়ি গ্রামের বাসিন্দা ঝর্না চাকমা। নিজের গ্রামে সুপেয় পানির উৎস নেই। প্রতিদিন পরিবারের সদস্যদের জন্য সুপেয় পানি সংগ্রহ করেন পাশের গ্রাম চেয়ারম্যানপাড়া থেকে। সে গ্রামও নদীর ওপারে। নদীতে পানি আছে তবে খাওয়ার যোগ্য নয়। মিতিঙ্গাছড়ি থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকা যোগে আধ কিলো দূরে গিয়ে পানীয় জল সংগ্রহ করেন তিনি। শুধু ঝর্না চাকমাই নন; একই গ্রামের বিদর্শন চাকমা, আখি চাকমা, মুক্তা চাকমা, সুপ্রিয় চাকমাসহ ৩৫-৪০টি পরিবারের সবাই একমাত্র এই নলকূপ থেকে দীর্ঘদিন ধরে পানি সংগ্রহ করছেন।
জুরাছড়ি উপজেলার দূর্গম মৈদং ইউনিয়নের ভূয়াতলীছড়া গ্রামে ১৫টি পাহাড়ি পরিবারের বসবাস। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর পাথুরে হওয়ায় এই এলাকায় গভীর নলকূপ স্থাপনের কথা থাকলেও তা আর করা সম্ভব হয়নি। তাই একমাত্র পানির উৎস হিসেবে কুয়া পানির পান করে আসছেন এই গ্রামের পাহাড়ি পরিবারগুলো। তবে কুয়া পাহাড় থেকে নিটু এলাকায় হওয়ায় ৪শ’ ফুট উঁচু পাহাড় ডিঙিয়ে কুয়া হতে পানির সংগ্রহ করেন তারা। বর্ষাকালে ছড়া ও কুয়া পানি ঘোলাটে ও অপরিষ্কার হয়ে পড়ায় সেই সময়ে দুর্ভোগ আরও চরম হয় তাদের। খবর বাংলা ট্রিবিউনের
এটি শুধুমাত্র বরকলের সুবলং কিংবা জুরাছড়ির মৈদং ইউনিয়নের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীবাসীদের হাহাকার নয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত পাহাড়ি গ্রামগুলোজুড়েই এই করুণ পরিস্থিতি।
আদমশুমারির সবশেষ (২০১১) তথ্য অনুযায়ী, রাঙামাটি পার্বত্য জেলায় মোট জনসংখ্যা ৬ লাখ ২০ হাজার ২১৪ জন। এর মধ্যে বর্তমানে জেলার ৬৬ শতাংশ মানুষ সুপেয় পানির সুব্যবস্থার আওতায় এসেছে বলে দাবি জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের (ডিপিএইচই)। তবে নির্বিচারে বন উজাড় ও বৃক্ষ নিধনের কারণে ক্রমশ পানির উৎস হারাচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম।
অন্যদিকে, রাঙামাটি জেলাবেষ্টিত কৃত্রিম কাপ্তাই হ্রদের পানিও পান অনুপযোগী। এতে করে কুয়া, ঝিরি-ঝর্না, ছড়ার দূষিত পানির পানের কারণে পানিবাহিত রোগের আক্রান্ত হচ্ছেন স্থানীয়রা।
আয়তনে দেশের সবচেয়ে বড় জেলা ও রাঙামাটির বাঘাইছড়ির উপজেলার দূর্গম ইউনিয়ন সাজেক ইউনিয়নের ৮০ শতাংশ মানুষ সুপেয় পানির সংকটে ভোগেন সারাবছর। এই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নেলসন চাকমা নয়ন জানিয়েছেন, সাজেকে সারা বছরই সুপেয় পানির সংকট থাকে। তবে এবছর অন্যান্য বছরের চেয়ে সংকট বেশি। তার ইউনিয়নের মধ্যে ব্যাটেলিং, লংকর, শিয়ালদহ, তুইথুইসহ বেশি কয়েকটি এলাকায় সুপেয় পানির জন্য বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হয়। কয়েক কিলোমিটার পাহাড়ি পথ ডিঙিয়ে এসব এলাকার মানুষকে পানি সংগ্রহ করতে হয়।
পরিবেশবাদী সংগঠন গ্লোবাল ভিলেজের নির্বাহী পরিচালক ফজলে এলাহী বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার ঝিরি-ঝর্নাগুলো আগে থেকে নষ্ট হয়ে গেছে। এখন শুষ্ক মৌসুমে ঝিরি-ঝর্নার পানি শুকিয়ে যায়। পাহাড়ি প্রত্যন্ত এলাকায় পানির উৎস ঝিরি-ঝর্ণা ও কুয়া। কিন্তু, পাহাড়ে এখন নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন ও বন উজাড়ের কারণে পরিবেশের বিপর্যয় ঘটছে; পানির উৎস কমছে। কারণ, গাছপালা না থাকলে তো পাহাড়ে পানি পাওয়া যাবে না। পার্বত্য চট্টগ্রামের সুপেয় পানির সংকট সমাধানে পাহাড়ের ভৌগোলিক বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্টদের গবেষণার প্রয়োজন।
রাঙামাটি জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের নির্বাহী প্রকৌশলী অনুপম দে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় সুপেয় পানির সংকট রয়েছে এটি সত্য। ভৌগোলিক কারণে সমতলের মতো এখানে প্রকল্প গ্রহণ করে সুপেয় পানির সংকট নিরসন সম্ভব হচ্ছে না। আমরা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের পক্ষ থেকে গভীর ও অগভীর নলকূপ স্থাপন করে যাচ্ছি। বিশেষত পাহাড়ি এলাকাগুলোতে ভূগর্ভস্থ স্তরে আমরা পানির উৎস পাই না, অনেকাংশে আবার বিভিন্ন এলাকায় পাথুরে হওয়ায় গভীর ও অগভীর নলকূপ স্থাপন করা সম্ভব হয় না।