আকতার কামাল চৌধুরী
নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের দায়বদ্ধতা অনেক। সেটা একান্তভাবে ভোটারদের কাছে,জনগণের কাছে এমনকি নিজের দলের কাছেও। রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে এটি তাঁর মাথায় থাকে।
আর রাজা-বাদশাদের সেটা নাই। তিনিই রাষ্ট্রের প্রতিভূ, তিনিই সর্বময় ক্ষমতার মালিক। তাঁর হুকুম-ই সব,তিনি নিজেই একটি ‘সংবিধান’।
সে তুলনায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট রাজা-বাদশাদের চেয়েও বড়ো। বলতে গেলে ‘রাজাদের রাজা’, ‘রাজাধিরাজ’। মার্কিন প্রেসিডেন্ট মানে ‘দুনিয়ার শাসক’। মূলত: সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বিশে^ একক আধিপত্য এনে দিয়েছে।
এই যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প, স্বদেশ কিংবা বিদেশ, সব সিদ্ধান্ত একহাতেই নিচ্ছেন এবং তা বেপরোয়াভাবেই। চীনের পন্যের উপর ১৪৫% ট্যারিফ, হার্ভার্ডের মত বিশ^খ্যাত বিশ^বিদ্যালয়ের অনুদান বাতিল, এভাবে কী-ই না করেছেন তিনি।
সোভিয়েত ইউনিয়ন নেই। চীন অবশ্য সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রবল প্রতিপক্ষ নয়। তাই বিশ্বে মার্কিন প্রেসিডেন্ট-ই এখন একক তারকা,তারকাদের তারকা, মহাতারকা। হালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট মানেই যেন এক মহাপরাক্রমশালী ‘অতিমানবের’ প্রতিকৃতি। তাঁর এ-এক অসীম ক্ষমতা, আজব ক্ষমতা।
তিনি প্রেসিডেন্টদের প্রেসিডেন্ট, যাঁর আদেশ-নিষেধ- সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করার দু:সাহস দুনিয়ার বুকে কারোই নেই।
তিনি চাইলে ব্যক্তিগত পছন্দের খাতিরে সৌদি প্রিন্স মোহাম্মদ সালমানকে জামাল খাশোগী হত্যার বিচার থেকে দায়মুক্তি দিতে পারেন। তিনি দয়ার সাগর।
চাইলে ইরাক দখল করতে পারেন, ছেড়েও দিতে পারেন। বানোয়াট অভিযোগের ভিত্তিতে ইরাকে আক্রমণ করতে পারেন। এই জালিয়াতি পরবর্তীতে প্রমাণিত হলেও ‘দুনিয়ার বাদশাকে’ এরজন্যে কারো সামনে জবাবদিহি-ই করতে হয়নি। আইন তাঁকে স্পর্শ করেনা। তামাম দুনিয়ার ‘বাদশা’ বলে কথা।
তিনি মুখে অনেক কথা বলতে পারেন। তাঁর মুখনিসৃত কথা যেন-তেন কথা নয়, অমৃত। প্রতিটি শব্দ একেকটা হিরকখÐ। একেকটা বাক্য মহামূল্যবান বাণী,চিন্তার খোরাক, টক্শোর অনিবার্য উপাদান।
তিনি জ্ঞানীদের জ্ঞানী। জ্ঞানের সোল এজেন্ট।
দুনিয়ার সমস্ত জ্ঞানের উৎস হোয়াইট হাউস। এ জ্ঞান আহরণের জন্যে বিশ্বের ক্ষমতাধর নেতারা এখানে হুমড়ি খেয়ে পড়েন। এখানে চান্স পাওয়াটাই বড়ো ভাগ্যের কথা, জ্ঞান আহরণ না করলেও চলে। এখানে পিলার হেলান দিয়ে একটা ছবি তোলাও অর্ধেক জ্ঞান অর্জনের সমতুল্য। রাজদর্শন-ই আসল কথা।
এ-বাদশার হাসিরও গভীর অর্থ থাকে। সেই হাসি মানে ভবের রাজ্যে রহস্যের খনি। তাঁর এক চিলতে হাসির আশায় কত লবিং, কত দেনদরবার,কত সাধনা। তিনি হেসেছেন তো কেল্লাফতে।
তাঁর রাগ মানে কারো ক্ষমতায়ণ আর কারো রাজ্য হারানো। এ রাগ মানে আগুনের লেলিহান শিখা ; পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়ার অপেক্ষায় এক উদীয়মান জনপদ, বোমার আঘাতে গর্ভবতী নারীর ছিন্নভিন্ন দেহ, সারি সারি লাশ,ক্ষুধায় পড়ে থাকা রাস্তার অগুনতি শিশু,দেশ হারানো লাখ লাখ উদ্বাস্তু। বিশ্বে তাঁর হুঙ্কারে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বের হয়। দুনিয়ার মানুষ এ ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করেছিলো দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধে হিরোশিমা-নাগাশাকি শহরে।
তিনিই ‘বিশ্ববিবেক’, ‘বিশ্ববিচারক’, তিনিই ‘বিশ্বসংবিধান’। বিশ্বমানবতার মূল দর্শনের তিনিই উদ্ভাবক। তিনিই বিশ্বমানবতার জীবন্ত কিংবদন্তি। মানবতা ও গণতন্ত্রের সংজ্ঞা তিনিই নিরূপন করেন।
কোনো রাষ্ট্রের স্বাধীনতা হরণ-অর্জন এ বাদশার সদয় ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টনের ইচ্ছে হয়েছিল, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত চিরতরে নির্মুল করবেন। তাই তিনি নিজের প্রভাব খাটিয়ে ১৯৯৩ সালে উভয় পক্ষকে অস্লো চুক্তি স্বাক্ষর করালেন। এই চুক্তিতেই একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের প্রতিশ্রুতি ছিল। পরবর্তীতে নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন বুশ। বুশের ইচ্ছে হলো, ফিলিস্তিনকে স্বাধীনতা দেওয়াই যাবে না। দুনিয়ার বাদশার ইচ্ছাই সবকিছু। অতএব, ফিলিস্তিন জ্বলছে, মানুষ মরছে, পশ্চিমারা হাসছে।
এক বাদশা জো বাইডেনের ইচ্ছে হলো, যুদ্ধে ইউক্রেনের পাশে দাঁড়ালেন,আবার নতুন বাদশা ট্রাম্পের ইচ্ছা হলো, তাই উল্টো পথে হাঁটলেন। তিনি মার্কিন চিরাচরিত পররাষ্ট্রনীতির ১৮০ ডিগ্রি উল্টো রথে সওয়ার হয়ে রাশিয়ারই সাফাই গাওয়া শুরু করলেন। বিপর্যস্ত জেলেনস্কির মলিন চেহারা এখন লুকোনো যাচ্ছে না। যুদ্ধের খেসারত দিতে গিয়ে নিজ দেশের বিরল খনিজ সম্পদ যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হলেন। বেচারা!
মার্কিন প্রেসিডেন্ট মানে বিশ্ব মোড়ল। দেশে দেশে ঠেলাঠেলি, গুঁতোগুঁতি লাগলে সালিশের ভার পড়ে তাঁর ঘাড়ে। তিনি সালিশ বসান, সালিশ করেন। তাঁর সালিশ মানবে না – এমন বাপের পুত দুনিয়াতে জন্ম নেয়নি। না মেনে যাবে-ও কোথায়! সব পক্ষ এই ‘বাদশার’ অভাবনীয় ক্ষমতার কাছে অষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা।
লেখক : প্রাবন্ধিক