ড. মুহম্মদ মাসুম চৌধুরী
আমরা এখন একুশ শতকের নাগরিক। এই শতক বিজ্ঞান প্রযুক্তির রাজত্বের শতক। আগের তুলনায় জ্ঞান বিজ্ঞানের অনেক অনেক শাখা প্রশাখা। এই বিজ্ঞান প্রযুক্তি রাজ্যে প্রবেশ করতে প্রয়োজন নিবেদিত প্রাণ ধ্যানী তরুণ। যারা জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে মানব সম্পদে পরিণত করে তারাই ঠিকে থাকবে। জ্ঞানকে কাজে লাগানোর শক্তি অর্জনই শিক্ষা। প্রকৃত শিক্ষা কাজে লাগিয়ে সমাজ পরিবর্তন করা যায়। যে শিক্ষা সমাজ পরিবর্তনে সাহায্য করে না। সেটি পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা নয়।
এডুকেশন শব্দটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ ‘এডুকার্ল’ হতে। এডুকার্ল অর্থ বের করা। অর্থাৎ মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তির বিকাশ করার নাম শিক্ষা। জ্ঞান বিজ্ঞান প্রযুক্তির প্রচুর উন্নতি হয়েছে, কিন্তু এখনো মানুষের ১০ ভাগ শক্তির বিকাশ ঘটাতে পারিনি। জ্যাঁ পল সার্ত্র মৃত্যুর তিন মাস পূর্বে জানিয়ে গেলেন, ‘মানুষ আজও অর্ধ মানব, পুরো মানব হয়ে উঠেনি। তবে এই আশা নিয়ে বিদায় নিচ্ছি মানুষ একদিন মানুষ হবেন, মনুষ্য অর্জন করবেন।’ মহান আল্লাহ পাক মানুষকে মনুষ্যত্ব অর্জনের জন্য সৃষ্টি করেছেন। পবিত্র কোরআনে তিনি ঘোষণা করেছেন, ‘আমি আদম সন্তানকে মহিমান্বিত করেছি। (সূরা বনী ইসবাঈন, আয়াত : ৭০)
বহু শতাব্দী পেরিয়ে আমরা এক নতুন শতাব্দীতে প্রবেশ করেছি। এই শতাব্দীতে মানুষ দেখবে নুন এক বিশ্ব। ভবিষ্যৎ বিশারদ রে কুর্তজওয়েল বলেছেন, আগামী তিন দশকের মধ্যে মানুষের বুদ্ধি শতগুণ বৃদ্ধি পাবে। এই শতাব্দীর পিঠে চড়ে ভবিষ্যতের নতুন সুপার ওয়ার্ল্ড-এ প্রবেশ করতে ‘সুপার উইজডম’ (প্রজ্ঞা) প্রয়োজন। এই শতাব্দীতে জ্ঞানের যত গুরুত্ব, ততটুকু গুরুত্ব মানবেতিহাসের কোন কালে ছিল না। প্রজ্ঞা নিয়ে এই শতাব্দীর ইতিহাসের পাতায় প্রবেশ করে নিজেই ইতিহাস হয়ে যেতে হবে।
মানুষের বৈজ্ঞানিক নাম ‘Homo Sapiens’ Homo অর্থ মানুষ। আর ঝধঢ়রবহং অর্থ জ্ঞানী। যার জ্ঞান আছে, বুদ্ধি আছে, বিবেক আছে সে প্রাণীর নাম মানুষ। জ্ঞানের কারণে মানুষ অজয় অমর হয়ে থাকতে পারে। হযরত মাওলানা আলী (রা.) বলেছেন, মূর্খ লোক জীবিত থাকলেও মৃত, আর জ্ঞানী লোক মৃত্যুর পরও জীবিত। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ পাক ইরশাদ করেছেন, ‘মানকাল ফি হাজেহি আম্মা কাহুয়া ফিল আখেরাতে আম্মা,’ যে দুনিয়াতে অন্ধ সে আখিরাতেও অন্ধ থাকবে। মহানবী হযরত মোহাম্মদ (দ.) ইরশাদ করেছেন, ‘বিদ্যার মত চক্ষু নেই, সত্যের চেয়ে বড় তপস্যা নেই, আসক্তির চেয়ে বড় দুঃখ নেই, ত্যাগের চেয়ে বড় সুখ নেই।’
সব মানুষের নিকট সুপ্ত বিদ্যা থাকে কিন্তু তা চর্চা করে বিকাশ করতে হয়। পশু পাখি জীবজন্তু বিদ্যা বুদ্ধি চর্চা করে উন্নত হতে পারে না। তাদের বুদ্ধি এক ধরনের হয়ে থাকে। গাধা যদি বোকা হয়, সকল গাধাই বোকা। সকল মানুষের বিদ্যা বুদ্ধি সমান নয়। কোন মানুষ গাধার মত আর কোন মানুষ আইনস্টাইন। বিদ্যা চর্চার বিষয়। সব মানুষের মাথা আছে, কেউ এই মাথা দ্বারা বোঝা বহন করে আর কেউ মাথার মস্তিস্কের চর্চায় নিউটন হন।
এক সময় বলা হতো রাজার হাতে তরবারী, মধ্যবিত্তের হাতে কলম, গরীবের হাতে লাঙল। এখন যুগ বদলে গেছে। এখন গরীবের হাতে লাঙল আর কৃষি শিল্প, শিক্ষিত পুজিপতির হাতে চলেগেছে। ছোট বেলায় ভালো করে পড়া লেখা না করলে বাবা মা বলতেন, তোর দ্বারা পড়াশুনা হবে না, কৃষি কাজ কর। একুশ শতকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে কৃষি কাজ করতে শিক্ষিত লোক দরকার। শত ভাগ শিক্ষিত মানুষের দেশে কৃষি কাজ তো শিক্ষিতরাই করেন। কথায় আছে, তুমি যদি কাউকে ১ কেজি মাছ দাও তাহলে তার একদিনের আহারের ব্যবস্থা করলে, যদি কাউকে মাছ ধরার কৌশল শিখিয়ে দাও তাহলে তুমি তার সারাজীবনের আহারের ব্যবস্থা করে দিলে। শিক্ষা কোন অল্প মেয়াদী ব্যবস্থা নয়, শিক্ষা দ্বারা দীর্ঘ মেয়াদী ব্যবস্থা চিন্তা করা হয়।
একটি গল্প আছে। চীন ও বাংলাদেশের দুই নাগরিকের সামনে একটি বড় মাছ ও একটি মাছ ধরার মিশিন যদি রাখা হয়, বাঙালি নাকি মাছটি নিবে। আর চীনের লোকটি নিবে মাছ ধরার যন্ত্রটি। চীনের মানুষটি আজ মাছ খেতে না পারলেও সারাজীবন মাছ খাবে। একে বলে ভিশন, ভিশনল্যাস বাঙালি আজই মাছ খেতে পারলেও সারাজীবন মাছ খেতে পারবে না। শিক্ষা মানুষের ভিশন সৃষ্টি করে। একটা জাতির মাছে ভিশন তৈরী করা বড় বিষয়। একটি জাতির ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হয় বিদ্যালয়ের শ্রেণি কক্ষে। যে জাতি যত বেশী শিক্ষাক্ষেত্রে বিনিয়োগ করবে সে জাতি তত বেশী উন্নতি করবে। আমাদের দূরের প্রতিবেশী দেশ সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইওয়ান, থাইল্যান্ড কয়েক দশকের মধ্যেই শিক্ষায় বিনিয়োগ করে উন্নতির শীর্ষে গেছে।
নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী ভারতীয় শিক্ষাবিদ কৈলাস সত্যার্থী ঢাকায় এসে বলে গেছেন, শিক্ষা খাতে একডলার ব্যয় করলে ২০ বছর পর সেখান হতে ১৫ গুণ রিটার্ন আসে। অন্য কোন বিনিয়োগে এত বেশি রিটার্ণ আসে না।
দার্শনিক কুয়ানসু বলেছেন, ‘যদি তোমার পরিকল্পনায় এক বছরের মধ্যে ফল পেতে চাও তাহলে শস্য বপন কর, আর যদি দশ বছরে ফুল পেতে চাও তাহলে বৃক্ষ রোপন কর, আর যদি সমগ্র জীবনের জন্য কোন পরিকল্পনা করো তাহলে মানুষকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোল’।
একটি অসাধারণ শক্তি নিয়ে পৃথিবীতে আমাদের শিশুরা আগমন করে। আমরা তাদের সাধারণ বনিয়ে ছাড়ি। তাদের মৌলিক অধিকার চারটি শরীরে আর একটি মাত্র মনে। তা হলো শিক্ষা মহান আল্লাহ পাক মানব জাতিকে অগণিত নেয়ামত দান করেছেন। তার মধ্যে শ্রেষ্ঠ নেয়ামত হলো সুসন্তান। ধন সম্পদ হলো প্রাণ বাঁচানোর উপায় আর সন্তান হলো বংশ ও মানব জাতি রক্ষার উপায়। তাই সম্পদের দিকে দৃষ্টি না দিয়ে সন্তানের শিক্ষার দিকে দৃষ্টি দেওয়া উচিৎ। একন চোর ডাকাতও চায় তার সন্তান ভালো মানুষ হোক। শিক্ষিত হোক। চোর ডাকাতের বিশ্বাস ভালা মানুষের উপর থাকে। যদি সন্তানকে ভালো শিক্ষিত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে না পারে তার হাজার কোটি টাকার কোন দুই পয়সার মূল্য নেই। সম্পদ ধরে রাখতে সন্তানদের সম্পদে পরিণত করে যেতে হয়। বহু ধনকুবের সন্তানকে সম্পদ রক্ষায় যোগ্য করতে ব্যর্থ হওয়ায় সমস্ত সম্পদ শূণ্য হয়ে গেছে। হযরত মওলা আলী (রা:) বলে গেছেন ‘জ্ঞান দিয়ে সম্পদ রক্ষা করা যায়, সম্পদ দিয়ে জ্ঞান অর্জন করা যায় না। সুসন্তানের চেয়ে বড় সম্পদ নেই। তাই সম্পদের দিকে দৃষ্টি না দিয়ে আগে সন্তানের দিকে দৃষ্টি রাখা উচিৎ।
কোন সন্তান অপরাধী হয়ে জন্মায় না পরিবেশ পরিস্থিতিই তাদের অপরাধী করে। একজন চিত্রশিল্পী যিশুখ্রিস্টের ছবি আঁকতে খোঁজ নিলেন সুন্দর এক কিশোরকে। সে কিশোরকে সামনে রেখে আঁকলেন খৃষ্টের ছবি। এই অসাধারণ ছবিটির কারণে ছড়িয়ে পড়ে শিল্পীর খ্যাতি। অনেক বছর পর এই শিল্পীর শয়তানের প্রতিকৃতি আঁকতে ইচ্ছে হলো। তার জন্য দরকার কুৎসিত অপরাধীর প্রতিকৃত। অনেক খুঁজে অন্ধকার কানা গলিতে খুঁজে পেয়ে গেলেন এক কুৎসিত মানুষ। মানুষটিকে দেখে শিল্পী আঁকলেন শয়তানের ছবি। ছকি আঁকার পর শিল্পী দেখলেন লোকটির চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়েছে। তার কারণ জানতে চাইলে লোকটি বললো, আমার কৈশোর জীবনে আমাকে দেখে আপনি এঁকে ছিলেন যিশুর প্রতিকৃত। আর এখন আমাকে দেখে আপনি আঁকলেন শয়তানের প্রতিকৃত। পরিবেশ পরিস্থিতিই আমাকের যিশুর প্রতিকৃত হতে শয়তানের প্রতিকৃতি করে ছিলো। বিশাল এক সম্ভাবনা নিয়ে আমাদের সন্তান বা দুনিয়াতে আগমন করে। পরিবেশ পরিস্থিতি আমাদের সন্তানদের সম্ভাবনা নষ্ট করে দেয়। বর্তমান জিডিটাল দুনিয়ার ডিজিটাল প্রযুক্তিতে আমাদের সন্তানরা অনেক বেশী সময় ব্যয় করে। তারা পিতা-মাতা শিক্ষক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বেশী সময় ব্যয় করে ডিজিটাল জগতে। এই জগতের অতিরিক্ত প্রভাব তাদের প্রতিভা নষ্ট করছে।
প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (দ:) ইরশাদ করেছেন, শিশুরা হলো মহান আল্লাহ প্রদত্ত আমাদের জন্য নেয়ামত। আরেক হাদিসে বর্ণনা আছে, ‘শিশুরা আল্লাহর ফুল’ (তিরমিজী শরীফ) এই ফুলে বিকাশ ঘটিয়ে সমাজে সুগন্ধী ছড়ানোর জন্য তাদের গড়ে তোলা আমাদের দায়িত্ব।
লেখক : কলাম লেখক, রাজনীতিক