পূর্বদেশ ডেস্ক
ঢাকায় দু’টি ফ্ল্যাট, স্ত্রী ও বিসিএস প্রশাসন কমিটির সঙ্গে দু’টি প্লট, নগদ ও ব্যাংকে আমানত মিলিয়ে ৭১ লাখ টাকাসহ স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ থাকার তথ্য দিয়েছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) নতুন দায়িত্ব পাওয়া চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মোমেন।
সম্পদের তথ্যে রাজধানীর পান্থপথে পৈত্রিকা বাড়ির অংশ বিক্রি করে পাওয়া টাকা স্থায়ী আমানত করার কথা বললেও অঙ্কটা কত, তা তিনি বলেননি।
গতকাল রবিবার বিকালে দুদক কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে দুদক বিটে কর্মরত প্রতিবেদকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে সম্পদের তথ্য দেওয়ার কথা তুলে ধরে নিজের আয়-ব্যয় ও সম্পদের ফিরিস্তি দেন মোমেন। খবর বিডিনিউজের
তিনি বলেন, ‘আনুষ্ঠানিকভাবে আমার সম্পদ বিবরণী দুদক সংস্কার কমিশনের কাছে জমা দিয়েছি। অন্য কমিশনাররা তাদের সম্পদ বিবরণী জমা দিয়ে দেবেন’।
দুদক চেয়ারম্যান বলেন, এর বাইরে কিছু মিললে, সেগুলো সরকার বাজেয়াপ্ত করতে পারে বা ধ্বংস করে দিতে পারে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান ও কমিশনার নিয়োগে ‘স্বচ্ছতা নিশ্চিতে’ তাদের আয় ও সম্পদের তথ্য প্রকাশের যে আহবান জানিয়েছিল টিআইবি তাতে সাড়া দিয়ে দুদক চেয়ারম্যান এদিন নিজের সম্পদের হিসাব দেওয়ার কথা বললেন।
গত ১১ ডিসেম্বর দুদকে যোগ দেন মোহাম্মদ আবদুল মোমেন। ওই দিন তিনি সাত দিনের মধ্যে স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ও আয়-ব্যয়ের হিসাব প্রকাশ করার কথা বলেছিলেন।
নিজের সম্পত্তির ফিরিস্তি তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘বছিলায় ৭৫০ স্কয়ার ফিটের দুটি ফ্ল্যাট মিলিয়ে ১৫০০ স্কয়ার ফিটের অ্যাপার্টমেন্ট আছে। সেখানে আরও ৭০০ স্কয়ার ফিট নেওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যে আছি। পূর্বাচল আমেরিকান সিটিতে স্ত্রীর সঙ্গে আমার একটি খালি জায়গা আছে ৫ কাঠা। বিসিএস প্রশাসন কমিটির সদস্য ছিলাম। সেখানে ৮ জন সদস্যের জন্য ১০ কাঠা জমি আছে। আমার ভাগে ১ দশমিক ২৫ কাঠা পড়বে। ২০০৭ সালে টাকা পয়সা দিয়েছি কিন্তু এখন পর্যন্ত দখল পাইনি। এটা অনিশ্চিত’।
দুদক চেয়ারম্যান বলেন, ‘রাজউকের একটি প্লটের জন্য ৭৫ হাজার টাকা জমা দিয়েছিলাম। আজ পর্যন্ত সেটার কোনো নিষ্পত্তি হয়নি। যেকোনো কারণে হোক সরকার আমাকে দেয়নি। আমি আবেদন করব আবার। এর বাইরে আমার আর কোনো স্থাবর সম্পদ নেই’।
অস্থাবর সম্পত্তির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন আকারের ২৫ সেলফ ভর্তি বইপত্র। দেশি বিদেশি অনেক দামি বইপত্র। আসবাব, ইলেকট্রনিক সামগ্রী মিলিয়ে ৫ লাখ টাকার জিনিস আছে। ৫ বছর মেয়াদী ৩০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র আছে। আর ৩ মাস অন্তর সঞ্চয়পত্র আছে ২০ লাখ টাকার। আমার জিপিএফের টাকা আমি এখনো তুলিনি, ওখানে ১৭ লাখ টাকা আছে’।
নিজের আয়ের উৎস তুলে ধরে তিনি বলেন, এসব সম্পদ তিনি অর্জন করেছেন তার চাকরি থেকে আয় ও উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পদ বিক্রির অর্থ দিয়ে।
তিনি বলেন, এখন পান্থপথের যেটা শমরিতা হাসপাতাল; এর একটা বড় অংশ আমার বাবার বাড়ি ছিল। আমরা ভাই বোন অনেক, সেই বাড়িটা বিক্রি করে টাকাটা ফিক্সড ডিপোজিট করেছি। সেই টাকাটা একটি বড় অংশ’।
শিক্ষকতা, বক্তৃতা ও লেখালেখি করে, বইপত্রের সম্মানী থেকেও আয় হওয়ার কথা বলেছেন দুদক চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, ‘সাড়ে ৫ শতক একটা জমি কিনেছিলাম বেড়িবাঁধের বাইরে, সেটা বিক্রি করে কিছু টাকা পেয়েছি। আমার হাতে নগদ এবং ব্যাংক মিলিয়ে সাড়ে চার লাখ টাকার মত আছে’।
সরকারি চাকরি থেকে ২০০৯ সালে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-ওএসডি হয়ে যাওয়া এবং পরে চাকরি চলে যাওয়ার সেই সব বিষয় স্মরণ করে আবদুল মোমেন বলেন, ‘চাকরি যেহেতু ফিরে পেয়েছি, পেনশন অন্যান্য বেনিফিট সবই ফেরত পাব। হঠাৎ করে দেখবেন আমার টাকার অঙ্ক বেড়ে গেছে, সেটা এই টাকা’।
তিনি বলেন, তার চাকরি জীবন অনেক দিনের। ছাত্র অবস্থা থেকেই আয় করা শুরু করেছেন। যখন এই চাকরি থেকে চলে যাব তখন হিসাব করবেন এই সম্পদ কতটা বাড়ল, কতটা কমল।
এমন এক সময় দুদক চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পেয়েছেন মোমেন, যখন রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় নেই। একে সৌভাগ্য বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গণ-প্রত্যাশা লালন করার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। জনগণ এই সরকার প্রতিষ্ঠা করেছে। এই সরকার প্রতিষ্ঠা না হলে, ৫ আগস্টের বিপ্লব না হলে আমরা এখানে আসতাম না’।
ক্ষমতার পালাবদলের মধ্যে গত ২৯ অক্টোবর দুদক চেয়ারম্যান মুহাম্মদ মইনুউদ্দীন আব্দুল্লাহ, কমিশনার আছিয়া খাতুন ও কমিশনার জহুরুল হক ‘ব্যক্তিগত’ কারণ দেখিয়ে পদত্যাগ করেন। পাঁচ বছর মেয়াদের জন্য তারা দুদকের দায়িত্ব পেলেও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দেড় বছর আগেই তাদের বিদায় নিতে হয়।
১০ নভেম্বর দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান ও কমিশনার নিয়োগে সুপারিশ করতে সার্চ কমিটি গঠন করে সরকার। তার এক মাসের মাথায় সার্চ কমিটির সুপারিশে দুদকে নতুন চেয়ারম্যান ও দুই কমিশনারকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
বিসিএস ’৮২ ব্যাচের প্রশাসন ক্যডারের কর্মকর্তা আবদুল মোমেন দুদক চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পাওয়ার আগে ২০০১ সালের বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় কৃষি মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব, বিআরটিএর চেয়ারম্যান ও বিমানের এমডি ছিলেন।
এর আগে নব্বইয়ের দশকে তিনি ছিলেন তখনকার প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার এপিএস। ২০০৯ সালে যুগ্ম সচিব থাকা অবস্থায় তাকে ওএসডি করা হয়। পরে ২০১৩ সালে ৬ জুন তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়েছিল তখনকার আওয়ামী লীগ সরকার।
পটপরিবর্তনের পর ১৭ আগস্ট ‘বঞ্চিত’ কর্মকর্তাদের মধ্যে আব্দুল মোমেনকেও সচিব পদমর্যাদায় ফিরিয়ে আনা হয়। ১৮ আগস্ট জ্যেষ্ঠ সচিব করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয় তাকে।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি বাংলাদেশে অবিশ্বাস্য বলে মন্তব্য করেছেন নতুন দুদক চেয়ারম্যান। মোমেন বলেন, ‘পৃথিবীর ইতিহাসে এমন ঘটনা ঘটেনি যে একই সঙ্গে দেশের প্রধানমন্ত্রী ও বায়তুল মোকাররমের ইমাম পালিয়েছে। এটা একটা অদ্ভুত ঘটনা। অনেক দেশেই আন্দোলন হয়েছে। রাষ্ট্র প্রধান পালিয়ে গেছে, প্রধানমন্ত্রী পালিয়ে গেছে। কিন্তু পোপ পালিয়ে গেছেন, মন্দিরের পুরোহিত পালিয়ে গেছেন এমনটা ঘটে না’।
নানা কারণে দুর্নীতিবাজদের ছাড়া পেয়ে যাওয়ার বিষয়টি তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘দুর্নীতিবাজদের যেন ছাড় দেওয়া না হয়, এটা আমাদের প্রত্যাশা। কিন্তু আমাদের প্রত্যাশা অনেক সময়ই সফলকাম হয় না অনেক কারণে। হয়ত আমরা যে মামলা করি, সেই মামলাটি দুর্বল। কিংবা এখানে বসে বিচারবিভাগের সমালোচনা করা সমীচীন না। কিন্তু সেই প্রশ্ন আমরা কেউ কেউ তুলে থাকি যে, সুবিচার কী হলো? সুবিচারের দায় শুধুমাত্র দুদকের, এটা মনে করলে হবে না’।
মাত্র অর্ধেক জনবল নিয়ে দুদকের কাজ করার কথা বলেছেন দুদক কমিশনার (তদন্ত) মিঞা মুহাম্মদ আলি আকবার আজিজী। তিনি বলেন, নির্মোহভাবে অনুসন্ধান করা হবে। কোথায় পক্ষপাত হবে না। তারা জাতির জাতির কাছে প্রতিশ্রæতিবদ্ধ বলে মন্তব্য তার।
দুদকের নিজস্ব প্রসিকিউশন বিধান প্রণীত না হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরে এই কমিশনার বলেন, ‘আমি ১/১১ এর সরকারের সময় আইন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ছিলাম। স্থায়ী প্রসিকিউশন সৃষ্টি করতে বাংলাদেশ অ্যাটর্নি সার্ভিস ডাইরেক্টরি তৈরি করা হয়েছিল। আইনও তৈরি করা হয়েছিল’।
পরবর্তী সময় রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় এসে সেই অধ্যাদেশ নিয়ে কাজ করেনি বলে তা কার্যকর হয়নি বলে মন্তব্য করেন মিঞা আজিজী। তিনি বলেন, ‘সিনিয়র ও যোগ্য আইনজীবীদের এই কমিশনের স্থায়ী প্রসিকিউশনে নিয়ে আসা দরকার। কিন্তু তাদের আনতে হলে তো পারিতোষিক দিতে হবে। এর জন্য একটু সময় লাগবে’।
দুদকের অপর কমিশনার (অনুসন্ধান) অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হাফিজ আহ্সান ফরিদ বলেন, ‘দুদকের পেশাগত ভিত্তি অনেক শক্ত। ৪২ দিন কমিশন না থাকার পরেও দুদকের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা নিরলস কাজ করে গেছে। পৃথিবীর কোনো মানুষের দাসত্ব করবে না দুদক’।