নিজস্ব প্রতিবেদক
সড়ক পরিবহনের ওপর চাপ কমানো, পরিবহনের গতি বাড়ানো, জ্বালানি সাশ্রয় এবং সবুজ পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথকে গ্রিন রুটে রূপান্তরের উদ্যোগ নেয়া হয়। ২০২১ সালের নভেম্বরে প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। ২০২৩ সালের ১৬ জুলাই তুমাসতুর্কি ইঞ্জিনিয়ারিং কনসাল্টিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকটিং কোম্পানি নামের একটি প্রতিষ্ঠান বিদ্যুৎচালিত রেললাইনের সমীক্ষা কাজ শুরু করে। সমীক্ষা কাজ শুরুর মধ্য দিয়ে মাত্র ৫৫ মিনিটে বুলেট ট্রেনে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাতায়াতের প্রাথমিক প্রক্রিয়া শুরু হয়। গত মার্চ মাসে সমীক্ষা কাজের মেয়াদ শেষ হলেও এখনো ২০ শতাংশ সমীক্ষা কাজ বাকি রয়েছে। যে কারণে দ্রæতসময়ে এই প্রকল্পবাস্তবায়নে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের প্রধান বৈদ্যুতিক প্রকৌশলী ও সমীক্ষা প্রকল্পের পরিচালক মো. হাবিবুর রহমান পূর্বদেশকে বলেন, ‘এখনো বৈদ্যুতিক ট্রেন প্রকল্পের স্টাডি চলছে। ৮০ শতাংশের বেশি স্টাডি শেষ হয়েছে। ডিজাইনের কাজও শেষের দিকে। সব কাজ শেষ হলেই প্রকল্পের বিনোয়োগের জন্য প্রস্তাব দিব। অনেক বিদেশি ডোনার প্রকল্পটির কাজ করতে আগ্রহী। তবে ডোনার কারা হবে সেটি অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) দেখভাল করবে। আমরা দ্রুতসময়ে সমীক্ষা যাতে শেষ হয় সেটি নিয়ে কাজ করছি।’
জানা যায়, ‘বাংলাদেশ রেলওয়ের নারায়ণগঞ্জ হতে ঢাকা হয়ে চট্টগ্রাম পর্যন্ত ইলেকট্রিক ট্র্যাকশন (ওভারহেড ক্যটেনারি ও সাব-স্টেশন নির্মাণসহ) প্রবর্তনের জন্য সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ও বিশদ ডিজাইন’ শীর্ষক প্রকল্পটি হাতে নেয়া হয়। ২০২১ সালের ২১ অক্টোবর প্রকল্পটি অনুমোদিত হয়। চলতি বছরের মার্চের মধ্যে সমীক্ষা কাজ শেষ করার টার্গেট নিয়ে ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে সমীক্ষা কাজ শুরু হয়। কিন্তু এখনো সমীক্ষা কাজ শেষ করতে পারেনি রেলওয়ে।
বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, দেশের অন্যতম শিল্প ও বাণিজ্য নগরী নারায়ণগঞ্জ। অন্যদিকে দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দর চট্টগ্রাম দিয়ে দেশের আমদানি-রপ্তানি পণ্যের ৯০ শতাংশ পরিবহন হয়। এসব বিষয় বিবেচনায় নিলে নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা-চট্টগ্রামের বিদ্যমান লাইনটি বিদ্যুৎ চালিত ট্রেন চলাচলের উপযোগী করলে তা দেশের পরিবহন ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হবে। বর্তমানে ঢাকা-চট্টগ্রামের মধ্যে যে যাত্রী পরিবহন হয়, তার ৫৬ শতাংশই হয় রেলপথে।
নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা-চট্টগ্রাম সেকশনের ৩৪৮ দশমিক ১৬ কিলোমিটার অংশ দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ রেলপথ। বন্দর নগরী চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার সাথে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের অন্যতম মাধ্যম ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথ। নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকায় প্রচুর যাত্রী রেলপথে দৈনিক যাতায়াত করে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে চলাচল করা ট্রেনগুলো পরিচালনা করতে প্রায় ৩৫ শতাংশ খরচ কমবে। যাতায়াতে সময় কমবে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ। রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় কমবে ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর কার্বন নিঃসরণ কমবে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ। এসবের পাশাপাশি প্রকল্পটি রেলওয়ের রাজস্ব আয় বাড়াতেও ভূমিকা রাখবে।
রেল কর্মকর্তারা বলছেন, দেশের রেলপথের ইঞ্জিনে জ্বালানি হিসেবে ডিজেল ব্যবহার করা হয়। এর পরিবর্তন ছাড়া গ্রিন রেলওয়ে রূপ শতভাগ দেওয়া সম্ভব নয়। এজন্য ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-চট্টগ্রাম রেলপথে বৈদ্যুতিক ট্রেন পরিচালনার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এটা শতভাগ বাস্তবায়ন হলে একদিকে পণ্য পরিবহন বাড়বে অন্যদিকে রিটার্নও বেশি আসবে। সড়ক পরিবহনের ওপর চাপ কমবে এবং পরিবহনের গতি বাড়বে। সড়কে চাপ কমলে জ্বালানি সাশ্রয় হবে এবং সবুজ পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে উঠবে।
৩৪৮ দশমিক ১৬ কিলোমিটার ট্রাকের মধ্যে নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা-চট্টগ্রাম অংশে ৩৩৬ দশমিক ৮৯ কিলোমিটার ও টঙ্গী-জয়দেবপুর অংশে ১১ দশমিক ২৭ কিলোমিটার রেলপথ রয়েছে। ২০৩২ সালের মধ্যে এই রেলপথকে ৭০টি স্টেশনসহ বৈদ্যুতিক ট্রাকশন সিস্টেমে রূপান্তরের লক্ষ্য নিয়ে এগুচ্ছে রেলওয়ে। যেটি ২০৩৩ সালে চালুর লক্ষ্য ধরা হয়েছে। প্রস্তাবিত সিস্টেমে দুই ধরনের লাইন থাকবে মেইন ও কমিউটার। এতে ট্রেনের গতিবেগ হবে ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার, যা পরে আপগ্রেড করা যাবে। এই নতুন সিস্টেম যাত্রী ও ট্রেন ব্যবহারকারীদের জন্য সময় সাশ্রয়, সড়ক পরিবহনের ওপর চাপ হ্রাস, জ্বালানি সাশ্রয় এবং পরিবেশগত প্রভাবের দিক থেকে উপকারী হবে। জয়দেবপুর থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত কমিউটার লাইন থেকে ২৪ শতাংশ আর নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা-চট্টগ্রাম পর্যন্ত মেইন লাইন থেকে ৪১ শতাংশ অর্থনৈতিক রিটার্ন আশা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ রেলওয়েও আর্থিকভাবে লাভবান হবে।