দুই পার্বত্য জেলাসহ উত্তর চট্টগ্রামের লাখ লাখ মানুষের স্বাস্থ্যসেবায় বিপ্লব ঘটাবে

5

হাটহাজারী প্রতিনিধি

দিনটি ছিল গেল বছরের অক্টোবরের পঞ্চম দিন। ১০ মাস বয়সী একমাত্র পুত্র সন্তান মোহাম্মদ আইমান নিউমোনিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। ওইদিন হঠাৎ পুত্রের নিস্তেজ হওয়া দেখে কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ে তার গর্ভধারিণী মায়ের। কোন উপায় না দেখে, তাকে হাটহাজারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে ভর্তি করানো হয়। ভর্তির ২৪ ঘন্টা অতিবাহিত হওয়ার পরও তার শারীরিক অবস্থার উন্নতি না হয়ে বরঞ্চ অবনতি হওয়ায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপতালে রেফার করে।
কিন্তু চমেক হাসপাতালে বেড না পেয়ে বাধ্য হয়ে নগরীর পাঁচলাইশস্থ একটি বেসরকারি বিশেষায়িত শিশু হসপিটালে আইমানকে ভর্তি করানো হয়। সেখানে পাঁচ দিন চিকিৎসা নিয়ে সে সুস্থ হয়। এজন্য তার অভিভাবককে গুনতে হয়েছে প্রায় ৬৯ হাজার টাকা। যা তার মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য পুরোটাই অসম্ভব। বহু কষ্টে টাকা জোগাড় করে বিল পরিশোধ করে সেদিন বাসায় ফিরে আইমান।
গতকাল রোববার সকালে কান্নাভেজা কণ্ঠে পুত্রের চিকিৎসা সেবার এমন শোচনীয় দুর্ভোগের বর্ণনা দেন ফটিকছড়ি উপজেলার সমিতির হাট ইউনিয়নের দক্ষিণ নিশ্চিন্তাপুর এলাকার প্রবাসীর স্ত্রী ঝর্ণা আক্তার (ছদ্মনাম)। এ সময় চীন সরকারের বিশেষ উদ্যোগে হাটহাজারী পৌর এলাকায় প্রস্তাবিত ৫০০ শয্যার ‘চায়না-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ জেনারেল হাসপাতাল’ নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছে এমনটা জানতে পেরে তিনি (ঝর্ণা আক্তার) বেশ উচ্ছ¡াস প্রকাশ করেন।
ঝর্ণা আক্তারের মত দুই পার্বত্য জেলা (রাঙ্গামাটি-খাগড়াছড়ি) ও পাঁচ উপজেলার (হাটহাজারী-রাউজান-রাঙ্গুনিয়া-ফটিকছড়ি-সীতাকুন্ড) মধ্যবিত্ত শ্রেণির অর্ধকাটি মানুষ মনে করছেন হাটহাজারীতে প্রস্তাবিত ৫০০ শয্যার চায়না-বাংলাদেশ হাসপাতালটি হবে স্বাস্থ্যসেবার অন্যতম ভরসাস্থল। গত শনিবার (২৬ এপ্রিল) হাটহাজারী পৌরসভার ৬নং ওয়ার্ডের ফটিকা বিল ও ১নং ওয়ার্ডের দেওয়াননগর এলাকার মিঠাছড়া এলাকায় উক্ত বিশেষায়িত হাসপাতাটির জন্য নির্বাচন করা সম্ভাব্য জায়গা পরিদর্শন করেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নুরজাহান বেগম।
পরিদর্শনকালে উপদেষ্টা হাসপাতাল নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা ও সম্ভাবনা মূল্যায়ন করেন এবং আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে অন্তর্বর্তী সরকারের পরিকল্পনা ও অগ্রগতির বিষয়েও সংশ্লিষ্টদের জানান। এ বিষয়ে তিনি দিকনির্দেশনাও দেন। পাশাপাশি এই স্থানে হাসপাতাল নির্মিত হলে শুধু হাটহাজারী উপজেলা নয়, পার্শ্ববর্তী অন্তত ৫টি উপজেলার জনগণসহ দুই পার্বত্য জেলায় স্বাস্থ্যসেবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন সংশ্লিষ্টরা।
পাশর্^বর্তী রাঙ্গুনিয়া উপজেলার রানীরহাট এলাকার বাসিন্দা পারভেজ তালুকদার ও রাউজান উপজেলার কদলপুর এলাকার বাসিন্দা আইযুব খান বলেন, স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে এখনও পর্যন্ত উত্তর চট্টগ্রামের ৫ উপজেলাসহ দুই পার্বত্য জেলার লাখ লাখ মানুষকে চিকিৎসা সেবার জন্য নির্ভর করতে হয় চমেক হাসপাতালের ওপর। এরমধ্যে হাটহাজারীতে ৫০০ শয্যার হাসপাতাল নির্মাণের পরিকল্পনা করছে সরকার। যা আমাদের মত মধ্যবিত্ত ও গরীব শ্রেণির মানুষের জন্য সত্যিই আনন্দের বিষয়। হাটহাজারীতে চীনমৈত্রী হাসপাতালটি স্থাপিত হলে নানা জটিল রোগে আক্রান্ত দরিদ্র মানুষ সহজে চিকিৎসা সেবা পাবেন। তাছাড়া কষ্ট করে দীর্ঘ যানজট পেরিয়ে রোগীদের স্বাস্থ্যসেবা নিতে শহরে যেতে হবে না।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) এর আইন উপদেষ্টা মানবাধিকার আইনজীবী অ্যাড. জিয়া হাবীব আহসান বলেন, দেশে তিনটি হাসপাতাল করতে যাচ্ছে চীন। আশা করছি, হাসপাতালগুলো খুবই আধুনিক হবে এবং সেখানে পাওয়া যাবে উন্নত চিকিৎসা। এগুলো দেশের জন্য এত বেশি ভূমিকা রাখবে যে, কথায় কথায় চিকিৎসার জন্য ভারত যাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে। বিশেষ করে গরীব ও মধ্যবিত্তের জন্য বিশাল অবদান রাখবে। চট্টগ্রাম হলো দেশের দ্বিতীয় বাণিজ্যিক শহর। তারমধ্যে উত্তর চট্টগ্রাম হচ্ছে প্রাণের স্পন্দন। বিশেষ করে হাটহাজারী হচ্ছে দুই পার্বত্য জেলা ও ৫টি উপজেলার জংশনস্থল। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে হাটহাজারীতে ভালো কোন মানসম্মত হাসপাতাল গড়ে উঠেনি। এখানে এমন একটি হাসপাতাল দরকার যেটি চট্টগ্রাম শহরের উপর চাপ কমাবে। স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য প্রস্তাবিত চায়না-বাংলাদেশ হাসপাতালটি যদি হাটাহাজরীতে নির্মিত হয় তাহলে উন্নত চিকিৎসা বঞ্চিত দুই পার্বত্য জেলা ও ৫টি উপজেলার দুর্গম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের লাখ লাখ গরীব-মধ্যবিত্ত জনসাধারণের জন্য চিকিৎসা ক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হবে।
সাউদার্ন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের প্রফেসর ডা. জসিম উদ্দিন বলেন, দুই পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটিসহ উত্তর চট্টগ্রামে ৫টি উপজেলার অর্ধ কোটিরও বেশি মানুষের জন্য উন্নত চিকিৎসা সুবিধার অভাব রয়েছে। এদের মধ্যে অনেকেই দরিদ্র মানুষ। তাদের হৃদরোগ ও ক্যান্সারের মতো চিকিৎসার জন্য বাধ্য হয়ে ঢাকা বা ভারতে যেতে হয়। তবে ঢাকা শহরে বা দেশের বাইরে গিয়ে চিকিৎসা করানোর সামর্থ্য তাদের নেই। চীনের সহায়তায় প্রস্তাবিত এই হাসপাতাল স্বাস্থ্যসেবায় বিপ্লব ঘটাবে এবং গরীব ও মধ্যবিত্ত মানুষ উপকৃত হবে।
এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী অফিসার এবিএম মশিউজ্জামান জানান, সরকারি নির্দেশনা মতে হাসপাতাল নির্মাণের জন্য ১০-১২ একর জায়গা দরকার, যা আমাদের আছে। শুধু তাই নয়, সরকারকে এই হাসপাতাল তৈরীর জন্য জায়গা ক্রয় করতে হবে না। হাসপাতালটি নির্মাণের জন্য জমি হাটহাজারী পৌরসভার এলাকার মিঠাছড়ায় (পরিত্যক্ত জায়গা), ফটিকা বিলে (ডাক ও তার বিভাগ) এবং ফতেয়াবাদের চিকনদন্ডীতে (ওয়াসা’র জায়গা) রয়েছে। ইতোমধ্যে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা সম্ভাব্য জায়গাটি পরিদর্শন করেছেন। সরকার অগ্রাধিকার ভিত্তিতেই হাসপাতালটি নির্মাণে আগ্রহী। তাই কাজ দ্রুত শুরু করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এই হাসপাতাল নির্মিত হলে দুই পার্বত্য জেলাসহ উত্তর চট্টগ্রামের লাখ লাখ মানুষের উন্নত চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা যাবে।