অধ্যক্ষ আবু তৈয়ব
আদিম যুগে মানুষ ও জন্তু থাকত গুহায়। সেই গুহায় জন্তুরা থেকে গেল। আর মানুষ খুঁজে পেল পথ। মানুষদের মধ্যে সেই পথ যারা নির্মাণ করল, ও পথ প্রদর্শন করল তারাই শ্রেষ্ঠ। আর সেই শ্রেষ্ঠ মানুষগুলোর মধ্যে মর্যাদাময় ও প্রাতস্মরণীয় হলেন শিক্ষক। সেই শিক্ষকই আমাদের শারীরিক বা স্থুল ব্যক্তিকে মানবিক মানুষে রূপান্তর করে সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়েছে। আজ তাই আমরা সভ্য ও উন্নত এই মানব সমাজ পেয়েছি। প্রত্যক্ষভাবে হোক বা পরোক্ষভাবে হোক প্রত্যেকেই শিক্ষকের সেই ঋণ স্বীকার করে এবং মানে। কিন্তু এখন আমাদের অজ্ঞতার কারণে, অসচেতনতার কারণে, দৃষ্টিভঙ্গিগত ত্রæটির কারণে সেই শিক্ষকের ভ‚মিকাকে যথাযথভাবে ধারণ করতে পারছি না। সঠিক মূল্যায়নও করতে পারছি না। তাঁদের অবদান ও চেতনা-শ্রমকে অন্যান্য পেশার মত সাধারণ পেশা হিসাবে অনেকে ভাবে। সেই জন্য শিক্ষকরাও এখন বিদ্যা বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন, প্রাইভেট পড়ানোর মাধ্যমে হোক বা কোচিং এর মাধ্যমে হোক। কিন্তু প্রকৃত শিক্ষক তো বিদ্যা বিক্রি করেন না। জ্ঞান বিতরণ করেন। সেই জ্ঞান বিতরণের ভেতর দিয়ে তাঁর দীক্ষাদানটাও হয়ে যায়। দীক্ষায় শিক্ষার চরিত্র বা কাজ কর্ম বোঝা যায়। যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেই পেশার গুরুত্ব, জৌলুস, কার্যকারিতা, প্রভাব, ফলাফল ইত্যাদিকে সুউচ্চ মর্যাদায় থাকার প্রেক্ষিতগুলো সব এখন কুলশিত হয়ে পড়েছে। মহান পেশাকে সামাজিক কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়ায় ধারণ করতে পারছে না। ধাই-মা নিজের বুকের দুধ খাওয়ায়ে ও বাড়ির কাজের মেয়েটি সন্তানকে লালান পালন করতে পারে। সন্তানের শারীরিক বাড়ে ও সুস্থতায় সহায়তা করতে পারে। কিন্তু সেই সন্তানকে প্রকৃত মানুষ হিসাবে গড়ে তুলতে শিক্ষকই লাগে, শিক্ষকই পারেন শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীকে দীক্ষায় উজ্জীবিত করতে। তাঁকে মানুষ করেতে। দীক্ষা – -মানে নৈতিকতা, মানবিকতা ও আত্মশুদ্ধি লাভ করা। তাই দীক্ষা ছাড়া শিক্ষায় মানুষ হওয়ার নিশ্চয়তা থাকে থাকে না। তাই দুর্নীতি, স্বার্থপরতা শিক্ষিতজনের মধ্যে বেশি বলে প্রকাশ পায়। এখান থেকে ঘুরে দাঁড়াতে হলে শিক্ষকের ভ‚মিকাকে মর্যাদাময় করতে হবে। এই নিয়ে এই নিবন্ধের অবতারণা।
এক এক সময় এক এক সভ্যতার আবির্ভাব ও সেই অনুযায়ী তার প্রতিপত্তি প্রকাশ পায়। শুরুতেই যাযাবর সমাজ থেকে গোত্রভিত্তিক সভ্যতার যুগ শুরু হয়। কালের বিবর্তনে প্রকটতা প্রকাশ পেতে থাকে ধর্মীয় সভ্যতা, দর্শনযুক্তি সভ্যতা বিজ্ঞান সভ্যতার ইত্যাদির যুগ। প্রত্যেকটি যুগই সমৃদ্ধ ও সমুজ্জ্বল হয় শিক্ষকের হাত ধরে। তার সাথে অর্থ সম্পদের প্রসার ঘটল। এখন অর্থ-বাণিজ্যের বিস্তৃতি ও উলম্ফন শুরু হয়েছে, এই শতাব্দিতে। অনেকে তাই খেই হারিয়ে ফেলল। যার জন্য তথ্যপ্রযুক্তিতে বিপ্লব ঘটলে তার তাড়া খেয়ে পৃথিবী দৌড়ালেও তার পিছনে আছে বিশাল পুঁজির পৃষ্ঠপোষকতা, প্রতিযোগিতা। সেখানে মানবিকতাকে সামনে রাখে না। তাই পৃথিবী এখন পুঁজির পিছনে ছুটছে, মনুষ্যত্বের পিছনে নয়। অনেকে আবার তথ্যপ্রযুক্তি থেকে শিক্ষা নেওয়ার কথা বলে। তথ্যপ্রযুক্তি বিদ্যা দিতে পারে, জ্ঞানের ভেতর দিয়ে দীক্ষা নয়। এই দীক্ষাদান এখন শিক্ষককের পক্ষে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না, তা সম্ভব হচ্ছে না তাঁর মানসিক বিপর্যয়ের কারণে, সে সব খানে অবহেলিত হচ্ছে। শিক্ষককে রাষ্ট্রের ভাবনা ও মূল্যায়নে কেন্দ্রে না রাখায়। ফলে দীক্ষাহীন শিক্ষাই চলছে। শিক্ষার্থী শিক্ষা নেয় চাকুরি পাওয়ার জন্য আর শিক্ষক বিদ্যা বিক্রি জীবীকার জন্য,। ফলে শিক্ষিত মানুষ অনৈতিক, দুর্নীতিগ্রস্ত, আত্মকেন্দ্রিক, হিংসা ও লোভী হয়ে উঠেছে। শিক্ষাকে এই যুগে একমাত্র সম্মান ও প্রতিপত্তি লাভের উপায় ভাবতে পারে না। তাই আজ ধন সম্পদ লুন্ঠনের যুগ শুরু হয়েছে। এই সময়ে ধনসম্পদ আহরণ করে প্রতিপত্তি প্রকাশের যুগ। তাই তো কোন জ্ঞানীকে, গুণী শিক্ষককে নেতা করতে, নেতা মানতে আগ্রহ দেখা যায় না। শিক্ষক সভ্যতা নির্মাণের কারিগর ও পথ প্রদর্শক হলেও তাঁর প্রভাব প্রতিপত্তিকে অর্থ সম্পদ চাপা দিয়ে যাচ্ছে। যদি সেই শিক্ষকের আর্থিক সক্ষমতা না থাকে তা হলে তিনি পাঠদানে পটু হলেও তাকে এই সময়ে চাহিদা মিটানোর উৎস হিসাবে ব্যবহার করে মাত্র। অনেক অভিভাবক আছেন তার সন্তানকে কে পড়ালেন, কোন কোন শিক্ষক সন্তানের ভালো ফলাফলে ভ‚মিকা রেখেছেন তাদের নামও জানেন না, চিনেনও না। সন্তানের বিয়েতে বা কোন পারিবারিক অনুষ্ঠানে সেই শিক্ষকের সম্মানজনক কোন উপস্থিতি দেখা যায় না। অন্য দিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে শিক্ষকের দৃশ্যমান কোন সামাজিক সক্ষমতা প্রকাশের ব্যবস্থা নেই। জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ডে কোন রাষ্ট্রীয় বা সমাজ কল্যাণমুখী সভায় সম্মানিত শিক্ষকদের সক্রিয় উপস্থিতি নেই। থাকবে কেন? ভিআইপি এর মর্যাদা দেয়া হয় না (যুক্তরাষ্ট্রে দেওয়া হয়)। যদুমধুরা মঞ্চে বসে পা দোলায় ও সিগরাটের ধোঁয়া ছাড়ে। এতে সমাজে কি ম্যাসেজ দেওয়া হয়? দেওয়া হয় এটা যে শিক্ষকের অবস্থান এই সমাজে তেমন মর্যাদাকর নয়। এই সমাজ শিক্ষককের মত মহৎ সত্তাকে ধারণ করতে পারে না। যার জন্য যাদের ছেলেমেয়ে এখানে পড়ে না, ছেলেমেয়ে নেই তারা শিক্ষকের উপস্থিতিও ঠের পায় না। ফলে শিক্ষককে সামাজিক সক্ষমতাহীন এক সত্তা বলে ভাবতে পারে। এই সংস্কারাচ্ছন্ন সমাজ শিক্ষককে উজ্জীবিত করার সকল প্রেক্ষিত ধ্বংস করে দিয়েছে। নিম্নবিত্ত শ্রেণিতে শিক্ষকের উপস্থিতি কিছুটা ঠের পেলেও উপরের শ্রেণিগুলোতে সম্মানজনকভাবে তাঁদের সক্রিয় উপস্থিতি তেমন নেই।
আরও দুঃখের বিষয় হলো জ্ঞানে যাঁরা সফল, যাঁরা শিক্ষায় উজ্জ্বল অবদান রাখতে পারেন তাঁদের জন্য রাষ্ট্রের কোন পৃষ্ঠপোষকতা নেই। যাঁরা উপজেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হন, বা যাঁদের অনানুষ্ঠানিক অবদান সমাজে উজ্জ্বল বা যাঁর কথায়, বক্তৃতায় লেখায় মানুষ সমৃদ্ধ হয়, প্রজন্মরা সুন্দর ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে তাড়িত হয়, স্বপ্ন দেখে, তাঁদেরকে যদি মাসিক প্রণোদনা দেওয়া যেত, যদি রাষ্ট্রের নির্দেশ থাকত শিক্ষকের বিচার শুরু করার আগে রাষ্ট্রের অনুমতি লাগবে (জাপানে অনুমতি নিতে হয়), বিচারালয়ে আসামীর কাঠগড়ায় শিক্ষককে দাঁড় করায়ে রাখা যাবে না, চেয়ার দিতে হবে বসতে (ফ্রান্সে দেওয়া হয়) কেননা ঐ বিচারক কোন না কোন শিক্ষকের ছাত্র ছিলেন তাই। যানবাহনে শিক্ষকের জন্য সম্মান প্রদর্শনের প্রতীকী আসন থাকত, শিক্ষকের স্বার্থে শিক্ষকের আর্থিক সক্ষমতা সকলের উর্ধ্বে রাখা সম্ভব হতো তা হলে শিক্ষার্থী ও সমাজ কি ম্যাসেজ পেত? পেত এটাই যে শিক্ষক শিক্ষকই। তিনি সকল আলোচনা ও সমালোচনার উর্ধ্বে। তিনি যে দিকে হেঁটে যান সে দিকে তাঁর সম্মানের জন্য নিরবতা নেমে আসে। তাঁকে বাজারে যেতে হয় না, বিশেষ ব্যবস্থায় তার ঘরে নিয়মিত বাজার পৌঁছিয়ে দেওয়া হয়। তিনি সব সময় শিক্ষার মান উন্নয়নে ও বিস্তারে নিজেকে নিয়মিত ব্যস্ত রাখেন। নিয়মিত সেমিনার, সেমুলেশন ক্লাসে তিনি সময় দেন। বিশেষ ব্যবস্থায় আর্থিক সহায়তা দিয়ে তাঁকে বাড়ি নির্মাণ করে দেওয়া হত। তাঁর জীবন কোন সংঘাতে ও সংকটে না পরে তার পূর্বপ্রস্তুতি রাখা হত। শেষ পর্যন্ত তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা বা সমাধিস্ত করা হত। স্থানীয় সরকারি কার্যালয়ে শিক্ষকদের অবদান সংরক্ষণ করা হত। তাহলে এইসব উদ্যোগে ও ব্যবস্থায় সমাজ পেত শিক্ষক নামের দেবতুল্য এক সত্তা, যিনি শিক্ষা-দীক্ষায় জাতিকে আলোর পথে নিতে পারেন, যিনি সামাজিক সক্ষমতায় সর্বোচ্চ মর্যাদার মানুষ, আর্থিক সক্ষমতায়ও তাঁদের অবস্থান সর্বাগ্রে। তখন আর্থিক সক্ষমতা ও সর্বোচ্চ মর্যাদায় থাকা শিক্ষকের উদ্যোম, সৃজনশীলতা, দায়িত্বশীলতা, কর্তব্যপরায়নতা ইত্যাদিতে সমুজ্জ্বল থাকত। এতে আমাদের শিক্ষারমান তো বাড়তই তার চেয়ে বড় পাওনা হত জ্ঞাননির্ভর আলোকিত সমাজ গড়ে উঠত। যেখানে দীক্ষায় আমাদের প্রজন্মরাও দেশপ্রেমিক, দায়িত্বশীল সুনাগরিক হয়ে উঠত।
যে সমাজ জ্ঞানীদেরকে ধারণ করে, বৈচিত্রকে ধারণ করে, সেই সমাজ শিক্ষা আর দীক্ষায় বলিয়ান থাকবে। সে সমাজে দুর্নীতি টিকতে পারবে না, নির্বাসিত হবে। তাইন শিক্ষককে সর্বোচ্চ আর্থিক ও সামাজিক সক্ষমতায় মর্যাদাবান রাখা রাষ্ট্র ও সমাজের জরুরি কাজ হয়ে উঠেছে। আর্থিক ও মানসিক দীনতা ও ভাঙা বুক নিয়ে শিক্ষকতা করায় না থাকে প্রকৃত শিক্ষা। আর না থাকে উজ্জীবিত শক্তি দীক্ষা। থাকে হয়তো জীবন ধারণের জন্য বিদ্যা বিক্রি। তাতে শিক্ষারমান ও ফলাফল কি করে ভাল হতে পারে! তাঁরা তো চলমান পরিস্থিতিতে নিজেদেরকে ক্ষয়ে যাওয়া বিধ্বস্ত একজন কারিগর মনে করেন। কারণ অন্য পেশার লোকদের সাথে যা করা সম্ভব হয়নি এই পেশার লোকদের সাথে তার চেয়ে বেশি অপমানকর ঘটনা ঘটিয়ে যাচ্ছি। এতে যে শিক্ষককে মারধর করল, যে শিক্ষককে জোর করে পদত্যাগ করাল, এতে দেশব্যাপী ও শিক্ষার্থীরা মনন জগতে কি চেতনা তৈরি করে দিল? দিল এটা যে শিক্ষক দেবতুল্য কেউ নন। তার সাথে যেমন তেমন আচরণ করা যায়। শিক্ষার্থীরাই শিক্ষককে ক্ষমতায় বসাতে পারে, আবার ক্ষমতা কেড়ে নিতে পারে। এতে কী ঘটল? আমাদের শিক্ষা দীক্ষাহীন শিক্ষায় পরিণত হচ্ছে। আর দীক্ষাহীন শিক্ষা জাতির অন্ধকার দূর করতে পারে না। বরং অন্ধকার ঘনীভ‚ত করে। তাই জাতির স্বার্থে, জাতির ভবিষ্যৎ উন্নয়নের স্বার্থে শিক্ষকের সামাজিক মর্যাদা সুনিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষকদের শুধু চলমান আন্দোলনের দাবি মানা নয়, শিক্ষকদের আর্থিক সক্ষমতা বাড়াতে, সামাজিক মর্যাদা বাড়াতে তাঁদের আংশিক দাবী নয় পূর্ণদাবি মেনে জাতিকে অন্ধকারের গ্রাস থেকে রক্ষা করা জরুরি হয়ে উঠেছে।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট,
সাবেক অধ্যক্ষ -খলিলুর রহমান মহিলা ডিগ্রি কলেজ
সহসভাপতি- চট্টগ্রাম জেলা বাকশিস











