পূর্বদেশ ডেস্ক
বাংলাদেশ থেকে ‘পাচার হওয়া টাকা দিয়ে’ দেশকে ‘অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করা হচ্ছে’ বলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতদেরকে বলেছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সহযোগীরা এই চেষ্টা চালাচ্ছেন বলেও অভিযোগ তাঁর। গতকাল সোমবার দুপুরে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ১৯ সদস্যের প্রতিনিধি দলটি সাক্ষাৎ করতে গেলে তিনি এ কথা বলেন।
সাক্ষাতে ঢাকায় ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত ৮টি দেশের এবং ভারতের নয়াদিল্লিতে পাঁচটি মিশনের প্রধানরা অংশ নেন। ছিলেন আরও ছয়টি মিশনের কর্মকর্তারা। তাদের নেতৃত্বে ছিলেন বাংলাদেশে ইউরোপীয় ইউনিয়নের হেড অব ডেলিগেশন মাইকেল মিলার। প্রায় আড়াই ঘণ্টা ধরে চলা এই বৈঠকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ১৫ জন প্রতিনিধি তাদের মতামত তুলে ধরেন। খবর বাংলআ ট্রিবিউন ও বিডিনিউজের।
বৈঠকে শ্রম অধিকার, বাণিজ্য সুবিধা, জলবায়ু পরিবর্তন, মানবাধিকার, আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ও টেকসই ভবিষ্যৎ নির্মাণে উভয়ের অঙ্গীকার ও করণীয় সম্পর্কে আলোচনা হয় বলে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে দেওয়া এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।
এতে লেখা হয়, বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে এমন আলোচনায় অংশ নিতে পেরে ইউনূস ‘খুব আনন্দিত’ বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি জুলাই-আগস্টে গণঅভ্যুত্থানে শহীদ ও আহতের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেন।এ সময় তিনি গত ১৬ বছর ধরে ‘অত্যাচার, শোষণ, বলপূর্বক গুম, মানবাধিকার লঙ্ঘন’ সম্পর্কে সংক্ষেপে তুলে ধরেন। তিনি অর্থনৈতিক শ্বেতপত্রের বিষয় উল্লেখ করে ‘দুর্নীতি, অর্থপাচার এবং ব্যাংকিং সিস্টেমকে কীভাবে বিপর্যস্ত করা’ হয়েছিল সেসব কথা জানান।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ইউনূস বলেছেন, বাংলাদেশ সম্পর্কে ‘ব্যাপক আকারে অপতথ্য ছড়ানো হচ্ছে’। এই ‘মিসইনফরমেশন’ ইউরোপীয় ইউনিয়নের দূতদের সহযোগিতাও কামনা করেছেন তিনি।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে দেশ থেকে ‘পালিয়ে যেতে বাধ্য হওয়া স্বৈরাচারী’ শেখ হাসিনা ও তার সহযোগীরা যে ‘ব্যাপক টাকা পাচার করে নিয়ে গেছে’, তা দিয়ে তারা দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে।
স¤প্রীতি ও জাতীয় ঐক্যের লক্ষ্যে বাংলাদেশের ‘সব’ রাজনৈতিক দল ও ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময়ের কথাও বৈঠকে উল্লেখ করেন প্রধান উপদেষ্টা। অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার ও নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পর্কেও ইইউ প্রতিনিধিদের বিশদভাবে জানিয়েছেন ইউনূস।
বৈঠকে বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা সেন্টার দিল্লি থেকে সরিয়ে ঢাকায় অথবা প্রতিবেশী অন্য কোনো দেশে স্থানান্তরের অনুরোধ করা হয় বলেও জানিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর।
ইউনূস বলেন, ভারত বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা সীমিত করায় অনেক শিক্ষার্থী দিল্লি গিয়ে ইউরোপের ভিসা নিতে পারছেন না। ফলে তাদের শিক্ষাজীবন নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বাংলাদেশের শিক্ষার্থী পাচ্ছে না।
ভিসা অফিস ঢাকা অথবা প্রতিবেশী কোনো দেশে স্থানান্তর হলে বাংলাদেশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন উভয়ই উপকৃত হবে।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে অংশ নেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনও। তিনি জানান, ইতোমধ্যে বুলগেরিয়া বাংলাদেশিদের জন্য তাদের ভিসা সেন্টার ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনামে স্থানান্তর করেছে।
ইইউ প্রতিনিধিরা সংস্কার প্রক্রিয়ায় প্রধান উপদেষ্টাকে পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন বলেও জানানো হয় সরকার প্রধানের দপ্তর থেকে। এতে লেখা হয়, পরামর্শ ও সুপারিশ জানিয়ে নতুন বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে পাশে থাকার প্রতিশ্রæতিও দেন তারা।
বৈঠকে ঢাকায় ডেনমার্কের রাষ্ট্রদূত ক্রিশ্চিয়ান ব্রিক্স মোলার, ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত মারি মাসদুপুই, জার্মানির রাষ্ট্রদূত আখিম ট্র্যোস্টার, ইতালির রাষ্ট্রদূত আন্তোনিও আলেসান্দ্রো, স্পেনের রাষ্ট্রদূত গ্যাব্রিয়েল সিসতিয়াগা, সুইডেনের রাষ্ট্রদূত নিকোলাস উইকস, নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূত আন্দ্রে কারস্টেনস। দিল্লিতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মিশন প্রধানদের মধ্যে ছিলেন, বাংলাদেশে বেলজিয়ামের রাষ্ট্রদূত দিদিয়ের ভান্ডারহাসেল্ট, বুলগেরিয়ার রাষ্ট্রদূত নিকোলাই ইয়ানকোভ, এস্তোনিয়ার রাষ্ট্রদূত মারিয়ে লুপ, লুক্সেমবার্গের রাষ্ট্রদূত পেজি ফ্রান্টজেন, স্লোভাকিয়ার রাষ্ট্রদূত রবার্ট ম্যাক্সিয়ান, সাইপ্রাসের রাষ্ট্রদূত ইভাগোরাস ভ্রায়োনাইডস।
ছিলেন নয়াদিল্লিতে হাঙ্গেরি দূতাবাসের বাংলাদেশ অফিসের ফার্স্ট সেক্রেটারি, পোল্যান্ডের দূতাবাসের কনস্যুলার, পর্তুগাল দূতাবাসের হেড অব মিশন, স্লোভেনিয়া দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি এবং নয়াদিল্লিতে রোমানিয়া দূতাবাসের সেকেন্ড সেক্রেটারিও।
এদিকে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে ইইউভুক্ত দেশের ১৯ কূটনীতিকের সঙ্গে বৈঠককে ঐতিহাসিক বলে মন্তব্য করেন সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি বলেন, আমরা কেবল বাংলাদেশে যেসব ইউরোপীয় দূতাবাস রয়েছে তাদের সঙ্গে কাজ করি। কিন্তু আজকের (সোমবার) বৈঠকে দিল্লিতে আছেন এমন রাষ্ট্রদূত ও প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে আগে কখনও হয়নি যে ইইউ একটি ইউনিয়ন হিসেবে এত রাষ্ট্রদূত-প্রতিনিধি কোনও সরকার প্রধানের সঙ্গে আলোচনা করতে এসেছেন। নতুন বাংলাদেশের যাত্রায় এটি বড় ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে মনে করি এবং বিশ্বাস করি।
বৈঠকে দুপক্ষ কথা বলেছেন জানিয়ে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, বাংলাদেশ এখন স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ ঘটাবে, সে জন্য ইইউ থেকে বাণিজ্য সুবিধা তাদের মার্কেটে প্রাপ্তির ব্যাপারে কথা বলেছি। জলবায়ু পরিবর্তন, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের বিষয়ে কথা বলেছি।
তিনি বলেন, তারা আমাদের কাছে মানবাধিকারের বিষয়ে জানতে চেয়েছেন। নির্বাচন ও শ্রমিক অধিকার নিয়ে কথা বলেছেন। উত্তরে আমরা বলেছি প্রত্যেকটা বিষয়ে প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। অবশ্যই একটি অবাধ, স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক নির্বাচনের দিকে যাবো।
রিজওয়ানা হাসান বলেন, আইসিটি আদালতের কথা জানিয়েছি। বিভিন্ন সংস্কার কমিশন কোন কোন ক্ষেত্রে কী পদ্ধতিতে কাজ করছে তা জানিয়েছি। শ্রম অধিকার নিয়ে ইইউকে বলেছি, সেখানে একটি সংস্কার কমিশন হয়েছে। বাংলাদেশ যাতে আর সস্তা শ্রমের দেশ শুনতে না হয়, বরং শ্রমিক স্বার্থ সুসংহত থাকে, সেটি কমিশনের মতামতের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেবো।
ইইউভুক্ত অনেক দেশের ভিসার জন্য আবেদন করতে দিল্লিতে যেতে হয়। এটা অনেক সময় ঝামেলা হয়ে যায়। তাদের কাছে সুস্পষ্ট অনুরোধ ছিল তারা যেন ভিসা সেন্টারগুলো দিল্লি থেকে অন্যত্র স্থাপন করে।
বাংলাদেশ নিয়ে ক্রমাগত অপপ্রচারের বিষয়ে ইইউকে জানানো হয়েছে উল্লেখ করে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, কেন জুলাইয়ে বিপ্লব হলো, তার আকাক্সক্ষা কী? সেটাকে ধারণ করে বিভিন্ন বিষয়ে জাতীয় ঐক্য গঠনের চেষ্টা হচ্ছে, সেটি জানানো হয়েছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানকালে হত্যাকান্ডের বিচারের বিষয়ে সরকারের উদ্যোগের কথা জানানো হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।