চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা এম. রেজাউল করিম চৌধুরী বলেছেন, সিটি কর্পোরেশন একটি নতুন রাস্তা করে গেল। ধবধবে ঝকঝকে রাস্তা। সেই রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলাচলের স্বাদ নেওয়ার আগেই দেখা গেল অন্য এক সেবা সংস্থা রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করেছে। ফলে জনদুর্ভোগ ও জনভোগান্তি বেড়ে যায়। দিনশেষে মেয়রকে গালাগালি শুনতে হয়। সেবা সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতার কারণে এমনটা হচ্ছে। তাই আমি পরিষ্কার করে বলতে চাই, জবাবদিহিপূর্বক সেবাসংস্থাগুলোর সমন্বয় করতে হবে। এর আগেও সমন্বয়ের উদ্যোগ নেওয়া হলে আলাপ-আলোচনায় সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু কার্যকর কোন উপকার জনগণ পায়নি। তাই সমন্বয় নিশ্চিত করতে মেয়রকে নিবার্হী ক্ষমতা দেওয়া উচিত।
তিনি বলেন, জননেত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রামের উন্নয়নের দায়িত্ব নিজের হাতে নিয়েছেন। এরপর থেকে চট্টগ্রামকে আর পিছনে তাকাতে হয়নি। কিন্তু সমন্বয়হীনতার কারণে যেভাবে এগিয়ে যাওয়ার কথা, সেভাবে এগিয়ে যায়নি চট্টগ্রাম।
গতকাল সোমবার বেলা ২টায় নগরীর টাইগারপাস সংলগ্ন বাটালি হিল এলাকায় চসিকের অস্থায়ী কার্যালয়ে গিয়ে মেয়র হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন রেজাউল করিম চৌধুরী।
এর আগে নগরীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে সুধী সমাবেশে তিনি এসব কথা বলেন। সুধী সমাবেশে চট্টগ্রামের বিশিষ্টজনদের পরামর্শ শোনেন তিনি। সুধী সমাবেশে মন্ত্রী, হুইপ, সংসদ সদস্যসহ ৩০ জনেরও বেশি বক্তা বক্তব্য রাখেন।
সুধী সমাবেশ ও দায়িত্ব গ্রহণের পর উপস্থিত সাংবাদিকদের রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, অনেকে মনে করেন মেয়র নির্বাচিত হলে চট্টগ্রাম শুধু মেয়রের। আমি সেই পুরনো ধারাকে ভেঙে দিতে চাই। কোন কিছু হলেই মেয়রের দোষ। রাস্তায়
যানজট মেয়রের দোষ। মেয়রের যে সীমাবদ্ধতা রয়েছে সেটা ইতোমধ্যে বলা হয়েছে। তা আমি পুনরাবৃত্তি করতে চাই না। এই শহর শুধু মেয়রের না, আমরা আপনার সবার। সবাই পরামর্শ, সহযোগিতা নিয়ে টেকসই উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিতে চাই।
তিনি আরও বলেন, মশার উপদ্রবে নগরবাসী অতীষ্ঠ। আমার প্রথম কাজ হবে মশা নিয়ন্ত্রণ। ১০০ দিনের মধ্যে নগরীর যেসব রাস্তায় খানাখন্দ আছে, সেগুলো সংস্কার করে যানবাহন চলাচলের উপযোগী করার চেষ্টা করব। তবে সব রাস্তা ১০০ দিনের মধ্যে মেরামত করা সম্ভব হবে না। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে যেসব বিশৃঙ্খলা আছে, সেগুলো দূর করে শৃঙ্খলার মধ্যে আনার চেষ্টা করব।
রেজাউল বলেন, মানুষ একটু শান্তি চায়, সুন্দরভাবে বসবাস করতে চায়। আমি মানুষকে শান্তি ও স্বস্তির নগরী উপহার দেওয়ার চেষ্টা করব।
শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেন, জাতির পিতার জন্মশতবর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বীর মুক্তিযোদ্ধাকে মেয়র হিসেবে মনোনয়ন দিয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। এর আগে মুক্তিযোদ্ধা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী মেয়র ছিলেন। রেজাউল করিম চৌধুরী সবার মতামতের ভিত্তিতে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করার ঘোষণা দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী যে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন সবাইকে সাথে নিয়ে, সমন্বয়ের মাধ্যমে কোন ধরনের আমাদের প্রতিযোগিতার প্রয়োজন নেই, বিবাদের প্রয়োজন নেই, বিরোধের প্রয়োজন নেই, সব সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, এ শহরের সব নাগরিক, সব জনপ্রতিনিধি সবাইকে সাথে নিয়ে আমরা নাগরিক সেবা নিশ্চিত করতে পারি। মানুষের চাহিদা সীমিত। যদি সবাই সহযোগিতা করেন তাহলে শতভাগ প্রত্যাশা পূরণ হবে। সংবর্ধনা নয় মতামত গ্রহণের জন্য সমাবেশের আয়োজন করেছেন নতুন মেয়র। সমন্বয় সুন্দরভাবে হলে নাগরিকরা সুবিধা পাবে। জননেত্রী শেখ হাসিনা ব্যাপক উন্নয়নকাজ উপহার দিয়েছেন। নগরপিতার মাধ্যমে এসব উন্নয়নের খবর মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারবো।
সমাবেশে হুইপ সামশুল হক চৌধুরী বলেন, এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী একজন দক্ষ প্রশাসক ছিলেন, আবার তিনি জনতার নেতাও ছিলেন। এমন একজন নেতা চট্টগ্রামের রাজনীতিতে আর আসবেন কি না, জানি না। মেয়র সাহেবকে বলব জনগণ আপনাকে ভোট দিয়েছে, আপনার দায়বদ্ধতা জনগণের কাছে। মহিউদ্দিন চৌধুরীর মতো জনতার নেতা হওয়াটাই আসল। অনেকে রেজাউল সাহেবের জন্য মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী মর্যাদা দাবি করেছেন। দাবি করা উচিত হবে না। কাকে কোন মর্যাদা দেবেন, সেটা প্রধানমন্ত্রী ভালো জানেন। দাবি প্রধানমন্ত্রী পছন্দ করেন না।
চট্টগ্রাম-৮ আসনের সংসদ সদস্য মোছলেম উদ্দিন আহমেদ বলেন, অনেকে পদে গেলে সবজান্তা হয়ে যান। ফ্লাইওভার দরকার ছিল কি না, সিডিএতে আমার মামা (সাবেক চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম) তা কারও কাছে জানতে চেয়েছেন কি না জানি না। অথচ তিনি আমাদের পরামর্শ নিতে পারতেন। তিনি রাজনীতিতে এসেছেন আমাদের অনেক পরে। প্রকৌশলীদের পরামর্শ শুনে ফ্লাইওভার বানিয়ে ফেলেছেন। এরপরও বলব, উনি অনেক কাজ করেছেন। মেয়রকে বলব জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে সমন্বয়ের প্রয়োজন আছে। আমরা রেজাউল করিম চৌধুরীকে নয়, চট্টগ্রামবাসীকে সহযোগিতা করব।
চসিকের বিদায়ী প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন বলেন, সবার পরামর্শ নিয়ে যোগদানের এ উদ্যোগ সবাই মনে রাখবে। এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীও এভাবেই পরামর্শ নিতেন। মাননীয় মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী দীর্ঘদিন রাজনীতি করছেন, উনি অবশ্যই সফল হবেন। ছয় মাস দায়িত্ব পালন করেছি। পরামর্শ হচ্ছে আয় বাড়াতে হবে। কিন্তু মানুষের ওপর ট্যাক্স চাপিয়ে আয় বাড়ানো যাবে না। শহরকে যারা ব্যবহার করছে, তাদের সারচার্জ আইন করে নির্ধারণ করতে হবে। নগরবাসী মাত্র ২০ শতাংশ নগরীকে ব্যবহার করে। যে ট্যাক্স একজন সাধারণ নাগরিক দেবে, তা বন্দর দিলে হবে না। ৩০ হাজার ট্রাক নগরীতে ঢোকে প্রতিদিন। তাদের ট্যাক্সের আওতায় আনতে হবে।
চসিকের সাবেক মেয়র মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী মেয়র হওয়ার পরে প্রতিটি আইনি বিষয়ে আমার পরামর্শ নিতেন। ভয় দেখিয়ে উনাকে কখনও দমিয়ে রাখা যায়নি। নতুন মেয়রকেও বলব দুর্নীতি দমন কমিশনকে ভয় করে কাজ করবেন না। অনেক কাজ করতে গেলে মামলার আসামি হতে হবে।
চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এমএ সালাম বলেন, চট্টগ্রামে অনেক কাজ হয়েছে, কিন্তু সমন্বিতভাবে হয়নি বলে মনে হচ্ছে। সব উন্নয়ন হলেও মানসিকতার পরিবর্তন আমরা করতে পারিনি। রাস্তাঘাট হলে উন্নতি হয় না, যদি নৈতিকতার উন্নয়ন না হয়। দেশের দ্বিতীয় বড় শহরের নাগরিক ময়লাটা রাস্তায়-নালায় ফেলি, সড়কে দোকান করছি। সমন্বয়ের জন্য মেয়রকে নির্বাহী ক্ষমতা দেওয়ার প্রয়োজন। ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সে তার যে অবস্থান, তাতে অন্য সরকারি সংস্থার প্রধানরা আসতে চান না। শুধু অর্নামেন্টাল মর্যাদা দিলে হবে না, নির্বাহী ক্ষমতা কতটুকু সেটাও দেখতে হবে।
সিডিএ’র সাবেক চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম বলেন, উন্নয়নে মহিউদ্দিন চৌধুরীর মডেল অনুসরণ করলে চট্টগ্রামের মানুষের প্রত্যাশা পূরণ হবে।
সুধী সমাবেশে আরও বক্তব্য রাখেন সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম চৌধুরী, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হেলালুদ্দীন আহমেদ, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোজাফফর আহমদে, চবি’র সাবেক উপাচার্য ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী, বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন কেন্দ্রীয় সংসদের ভাইস প্রেসিডেন্ট ডা. শেখ শফিউল আজম, আইইবি’র সভাপতি প্রকৌশলী প্রবীর কুমার সেন, চসিকের কাউন্সিলর সাইয়েদ গোলাম হায়দার মিন্টু, জাসদ নেতা জসিম উদ্দিন বাবুল, চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম, নগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী, নগর মহিলা আওয়ামী লীগ সভাপতি হাসিনা মহিউদ্দিন, প্রকৌশলী মো. হারুন, চুয়েট উপাচার্য ড. রফিকুল আলম, চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিাচলক মো. ফজলুল্লাহ, চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান প্রদীপ চক্রবর্তী, সিডিএ’র চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষ, দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।