রূপম চক্রবর্ত্তী
সূর্যের তাপ, বজ্রপাত, অগ্নিসংযোগ, ক্যাম্প ফায়ার, জ্বলন্ত সিগারেট ত্যাগ করা, ধ্বংসাবশেষ সঠিকভাবে না পোড়ানো এবং ম্যাচ বা আতশবাজি খেলার মাধ্যমে বিভিন্ন সময় দাবানলের সৃষ্টি হয়। দাবানলকে ইগনিশনের কারণ, ভৌত বৈশিষ্ট্য, উপস্থিত দাহ্য পদার্থ এবং আগুনের উপর আবহাওয়ার প্রভাব দ্বারা শ্রেণীবদ্ধ করা যেতে পারে। দাবানলের তীব্রতা পাওয়া যায় জ্বালানি, ভৌত স্থাপনা এবং আবহাওয়ার মতো কারণগুলির সংমিশ্রণের ফলে। জলবায়ু চক্রগুলি আর্দ্র সময়কালের সাথে যা যথেষ্ট জ্বালানী তৈরি করে, তারপরে খরা এবং তাপ, প্রায়শই মারাত্মক দাবানলের আগে ঘটে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এই চক্রগুলি তীব্রতর হয়েছে। একটি দাবানলকে আরও সুনির্দিষ্টভাবে বুশফায়ার, মরুভূমির আগুন, ঘাসের আগুন, পাহাড়ের আগুন, পিট ফায়ার, প্রেইরি ফায়ার, গাছপালা আগুন, বা ভেল্ড ফায়ার হিসাবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। সাধারণত, যখন কোনো আগুনের উৎস প্রচন্ড তাপমাত্রায় এবং যথেষ্ট পরিমাণে অক্সিজেনের উপস্থিতিতে দাহ্য পদার্থের সংস্পর্শে আসে, তখন দাবানলের সুত্রপাত ঘটে। আমেরিকার বনাঞ্চলে বিভিন্ন উপায়ে আগুন লাগে বছরে প্রায় এক লক্ষ বার। যে কারণে পুড়ে যায় ২০ লক্ষ হেক্টর জমি।
দাবালনের লেলিহান শিখা গ্রাস করে বসত-বাড়ি, ব্যবসা-অফিস-শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বাদ যায়না ধর্মীয় উপাসনালয়ও। সবুজে আচ্ছাদিত বৃক্ষরাজিও জ্বালানিতে পরিণত হয়ে এক সময় মিশে প্রকৃতিতে মিশে যায় ছাই হিসেবে। আগুন প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম যেভাবেই লাগুক এবং এক পর্যায়ে এটা ক্ষতিকর রূপ নিলেও এর ভেতর কিছু কল্যাণকর দিকও আছে। প্রকৃত প্রস্তাবে, মাঝে মাঝে আগুন না লাগলে বনাঞ্চলের ন্যাচারাল ইকোসিস্টেম নষ্ট হয়ে যেতে চায়। মৃত ও পচনশীল দ্রব্যাদি পুড়ে গিয়ে শুদ্ধ হয় পরিবেশ, গাছের কান্ডে জমে থাকা পুষ্টি, অগ্নিকান্ডের পরে আবার ফেরত আসে জমিতে। যাবতীয় ক্ষতিকর পোকামাকড় ধ্বংস হয় এতে, রোগশোকের জীবাণুও নষ্ট হয়ে যায়। উচুঁ গাছের শামিয়ানা পুড়ে গেলে অন্ধকার স্যাঁতসেতে বনের উঠানে সূর্যের আলো ঢুকে পড়ে। তখন ছাইয়ের গাদায় শুরু হয় নতুন জীবন। প্রথমে তৃণ, তারপর বড় গাছ এবং ক্রমশ নিবিড় অরণ্য। আবার কখনো বজ্রপাতে পুড়ে যাবার জন্যে তৈরি হয় বন। এভাবেই চলতে থাকে প্রাকৃতিক অগ্নি-চক্র।
লস অ্যাঞ্জেলেস হলো হলিউডের প্রাণকেন্দ্র। যেটি আমেরিকার প্রধান বিনোদন কেন্দ্র। সর্বগ্রাসী দাবানলের আগুনে যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেস যেন নরককুন্ড। শুষ্ক আবহাওয়ার সঙ্গে তীব্র বাতাসের বেগের কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। হাজার হাজার একর এলাকা জুড়ে পুড়ছে ঘরবাড়িসহ বিভিন্ন স্থাপনা। ভয়াবহ দাবানলের আগুনে পুড়ে ছাই হচ্ছে লস অ্যাঞ্জেলসের বিশাল অংশ। বৃহস্পতিবার সেখানে পাচটি সক্রিয় দাবানলে পুড়ছিল সবকিছু। এরমধ্যে ইটন নামে একটি দাবানল গতকাল পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল। এ দাবানলটি ১৭ হাজার ৬০০ একর জায়গাজুড়ে ছড়িয়েছিল। শক্তিশালী বাতাস, শুষ্ক আবহাওয়া এবং পানির চাপ কম থাকায় আগুনের তীব্রতা শুধু বাড়ছিল। দাবানলে পুড়ে গেছে হলিউড হিলসও।
লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমসের প্রতিবেদনে জানা যায়, দাবানলের কারণে বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে ২ লাখের বেশি বাসিন্দা। শুধু যে বাড়ি তা নয়, ব্যবসায়িক নানান প্রতিষ্ঠানের অফিসও ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ রয়েছে। ফলে সেখানের ব্যবসাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এলাকার বহু অংশে নেই বিদ্যুৎ সংযোগ। ফলে ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনে অনেকেই বিপত্তির মুখে পড়ছেন। মেল গিবসন আমেরিকান বংশোদ্ভূত অস্ট্রেলিয়ান অভিনেতা ও চলচ্চিত্র পরিচালক। তিনি নিউজ নেশনকে জানিয়েছেন, টেক্সাসের অস্টিনে শ্যুটিং করার সময় তার বাড়িটি দাবানলে পুড়ে গেছে। তিনি বলেন, এটা আবেগের বিষয়। বাড়িটিতে আমি দীর্ঘদিন ধরে বাস করছি। সেখানে আমার সব জিনিসপত্র ছিল। সেগুলো সব পুড়ে গেছে।
বিলি ক্রিস্টাল এবং তার স্ত্রী জেনিস বুধবার বিবৃতিতে জানান, তাদের ৪৫ বছরের পুরোনো বাড়ি প্যাসিফিক প্যালিসেডস অঞ্চলে পুড়ে গেছে। বিবৃতিতে তারা লিখেছেন, ‘জেনিস এবং আমি ১৯৭৯ সাল থেকে আমাদের বাড়িতে বাস করছি। আমরা এখানে আমাদের সন্তান ও নাতি-নাতনিদের বড় করেছি। আমাদের বাড়ির প্রতিটি ইঞ্চি ভালোবাসায় পূর্ণ ছিল, সুন্দর স্মৃতি যা কখনো চলে যাবে না। জনপ্রিয় টিভিব্যক্তিত্ব প্যারিস হিলটনের বাড়ি দাবানলে পুড়ে গেছে। মালিবুতে তার বাড়ি সম্পূর্ণ ভস্মীভূত। প্যাসিফিক প্যালিসেডসের বাসিন্দা ব্রিটিশ অভিনেত্রী কেট বেকিনসল। প্যাসিফিক প্যালিসেডসের ধ্বংসযজ্ঞের ছবি ইনস্টাগ্রামে প্রকাশ করে তিনি লিখেছেন, ‘আমার ও আমার মেয়ের শৈশবের বেশির ভাগ সময় এখানেই কেটেছে। তারকা মিলো ভেন্টিমিগ্লিয়া সিবিএস নিউজকে জানান, তিনি এবং তার গর্ভবতী স্ত্রী জারাহ মারিয়ানো তাদের মালিবু বাড়ি হারিয়েছেন।
গত ৭ জানুয়ারি মঙ্গলবার রাতে শুরু হওয়া ইটনের আগুনে পাঁচ হাজারেরও বেশি অবকাঠামো পুড়ে গেছে। যার মধ্যে বাড়ি, অ্যাপার্টমেন্ট ভবন, ব্যবসা, আউটবিল্ডিং এবং যানবাহন রয়েছে। আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে গিয়ে অগ্নিনির্বাপণকর্মীরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন বলে জানিয়েছেন লস অ্যাঞ্জেলেসের অগ্নিনির্বাপক বাহিনীর প্রধান ক্রিস্টিন এম ক্রাউলি। ক্রাউলি বলেন, ‘আমাদের অগ্নিনির্বাপণ কর্মীরা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। তবে তাঁরা হাল ছাড়বেন না।’ দাবানলের আগুন ছড়িয়েছে লস অ্যাঞ্জেলেস ও ভেলটুরা কাউন্টির সীমান্তবর্তী কেনেথ অঞ্চলে। গত ০৯ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় এই অঞ্চলে দাবানল ছড়ায়। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আগুন প্রায় এক হাজার একর এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। লস অ্যাঞ্জেলেস কাউন্টির অগ্নিনির্বাপক বিভাগের প্রধান জন ও ব্রায়েন বলেছেন, ‘অগ্নিনির্বাপক বাহিনীর সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে।’
সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, সবচেয়ে বড় দাবানলটি জ্বলছে প্যালিসেডস অঞ্চলে। দ্বিতীয় বৃহত্তম দাবানলটি জ্বলছে ইটন অঞ্চলে। সানসেট, হার্স্ট ও লিডিয়া এলাকাতেও এখনো আগুন জ্বলছে। প্যাসিফিক প্যালিসেডসের পশ্চিমে এলএ অঞ্চলে জ্বলতে থাকা দাবানলগুলোর মধ্যে বৃহত্তম আগুনটি ৫ হাজার ৩০০টির বেশি অবকাঠামো ধ্বংস করেছে। সেখানে দমকল কর্মীদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দাবানলের বিস্তার কমিয়ে আনতে দমকল কর্মীরা উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করলেও এখনো এটি নিয়ন্ত্রণের বাইরে। অগ্নিনির্বাপণকর্মীদের আকাশ ও মাটি থেকে আগুন নেভানোর চেষ্টা চালানোর পরও কয়েক দিন ধরে দাবানল ছিল নিয়ন্ত্রণহীন। তবে অবশেষে প্যালিসেইডসের আগুন ৮ শতাংশ এবং ইটনের আগুন তিন শতাংশ নিয়ন্ত্রণে এসেছে।
বেশ কয়েকটি আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ সংস্থা ১০ জানুয়ারি শুক্রবার ঘোষণা করেছেন, ২০২৪ সালটি পৃথিবীর উষ্ণতম বছর হিসেবে রেকর্ড করা হয়েছে। জর্জিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া বিভাগের অধ্যাপক মার্শাল শেফার্ড বলেন, হারিকেন হেলেন, স্পেনে বন্যা এবং ক্যালিফোর্নিয়ায় দাবানল ছড়িয়ে পড়া- এসবই দুর্ভাগ্যজনক দ্রæত জলবায়ু পরিবর্তনের লক্ষণ। প্রাথমিকভাবে আগুন কীভাবে লাগলো, তা নিয়ে ধোঁয়াশা দেখা দিয়েছে। ন্যাশনাল ফায়ার প্রোটেকশন অ্যাসোসিয়েশনের মতে, যুক্তরাষ্ট্রে আগুনের সবচেয়ে সবচেয়ে সাধারণ উৎস হলো বজ্রপাত। তবে তদন্তকারীরা এবারের আগুনের পেছনে বজ্রপাতকে কারণ মানতে নারাজ। এপি বলছে, পূর্ব লস অ্যাঞ্জেলেসের ইটন, প্যালিসেড কিংবা আশেপাশের ভূখন্ডে বজ্রপাতের কোনো খবর পাওয়া যায়নি। দেশটিতে দাবানলের আরও দুটি সাধারণ কারণের মধ্যে রয়েছে, ইচ্ছাকৃতভাবে আগুন লাগানো এবং ইউটিলিটি লাইন থেকে ছড়িয়ে পড়া আগুন।
ফ্লোরিডার সায়েন্টিফিক ফায়ার অ্যানালাইসিসের মালিক জন লেন্টিনি বলেন, আগুনের আকার এবং পরিধির কারণ সবসময় একই থাকে। একসময় ছোট অগ্নিকান্ড, পরে পড় আকার ধারণ। কেননা অতীতে দুর্ঘটনাসহ অসংখ্য সূত্র থেকেও আগুন লাগার নজির রয়েছে। দেশটির কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিবিএস বলছে, দীর্ঘ সময় বৃষ্টি না হওয়ায় ফলে খরা আর প্রবল বাতাসের কারণে দাবানলটি এত দ্রæত ছড়াচ্ছে। কম বৃষ্টিপাতের ফলে খরা, গরম তাপমাত্রা এবং বাতাস সবই দাবানলের জন্য নিখুঁত রেসিপি তৈরি করে। জাতিসংঘের একটি বড় রিপোর্ট অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব আগের চিন্তার চেয়েও বেশি মারাত্মক। প্রতিবেদনে সতর্ক করা হয়েছে যে ক্রমবর্ধমান তীব্র আবহাওয়ার ধরণ যা দাবানলকে জ্বালাতন করতে পারে, এবং শীঘ্রই ব্যবস্থা না নেওয়া হলে তাপপ্রবাহ এবং খরা আরও সাধারণ হয়ে উঠবে। আগুন প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম যেভাবেই লাগুক এবং এক পর্যায়ে এটা ক্ষতিকর রূপ নিলেও এর ভেতর কিছু কল্যাণকর দিকও আছে। প্রকৃত প্রস্তাবে, মাঝে মাঝে আগুন না লাগলে বনাঞ্চলের ন্যাচারাল ইকোসিস্টেম নষ্ট হয়ে যেতে পারে। মৃত ও পচনশীল ব্রব্যাদি পুড়ে গিয়ে শুদ্ধ হয় পরিবেশ, গাছের কাÐে জমে থাকা পুষ্টি, অগ্নিকান্ডের পরে আবার ফেরত আসে জমিতে।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট