হাটহাজারী প্রতিনিধি
চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার শিকারপুর ইউনিয়নে রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার ও অন্তর্কোন্দল নিয়ে মারামারির ঘটনায় গেল কুরবানির ঈদের পর উভয় পক্ষ মামলা করেছিল। তারই জের ধরে প্রকাশ্যে ফিল্মি স্টাইলে গুলি করে দুইজনকে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে নিহতের পরিবার ও তাদের স্বজনরা। দুর্বৃত্তরা গুলি করেই ক্ষান্ত হয়নি, তারা মৃত্যু নিশ্চিত করতে ৪০ মিনিট ঘটনাস্থল পাহারা দিয়ে রেখেছিল বলে জানিয়েছেন অক্সিজেন-কুয়াইশ সড়কে দুর্বৃত্তের গুলিতে নিহত শিকারপুর ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আনিসের স্ত্রী এনি আক্তার।
এই ঘটনায় বায়েজিদ ও হাটহাজারী মডেল থানায় পৃথক দুইটি মামলা করার প্রস্তুতি চলছিল বলে জানা গেছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন মদুনাঘাট পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পুলিশ পরিদর্শক মো. মহিউদ্দিন সুমন। তবে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত (শুক্রবার বিকেল ৪টা) চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে নিহত দুইজনের মরদেহের ময়না তদন্ত চলছিল বলে জানান এই পুলিশ পরিদর্শক।
শিকারপুরের এই ওয়ার্ডের অন্তর্ভুক্ত এলাকা পশ্চিম কুয়াইশের ওসমান আলী মেম্বারের বাড়ির মৃত মো. ইসহাক মিয়ার ছেলে নিহত মোহাম্মদ আনিসের বাড়িতে গেলে তার স্ত্রী অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে এ বিষয়টি নিশ্চিত করেন। এ সময় এনি আক্তারের পাশে সত্তরোর্ধ্ব নিহত আনিসের গর্ভধারিনী মা সায়রা খাতুন তার নাতি-নাতনীকে জড়িয়ে ধরে বিলাপ করতে করতে বারবার বলছিলেন, তোমরা আমার ছেলেকে এনে দাও। আমার ছেলে তো নির্দোষ, সে কারো ক্ষতি করেনি। বরং সে এলাকার গরিব লোকজনকে সাহায্য করার পাশাপাশি অসহায় পরিবারের মেয়েদের বিয়ে-শাদীতে আর্থিক সহযোগিতা করত।
গতকাল শুক্রবার দুপুর ১২ টার দিকে গণমাধ্যমকর্মীরা নিহত আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ আনিসের বাড়িতে গেলে দেখা যায়, তার মৃত্যুতে পুরো এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। পরিবারের সদস্য ও স্বজনরা তাকে হারানোর শোক সইতে পারছেন না। তাদের আহাজারিতে এলাকার পরিবেশ ভারি হয়ে উঠেছে। এলাকাবাসীও এমন করুণ মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না।
অন্যদিকে, ছোটবেলায় মা-বাবাকে হারিয়ে নানার বাড়িতে মানুষ একই এলাকার আবদুস সাত্তার মিস্ত্রি বাড়ি প্রকাশ বিল্লা বাড়ির মৃত মুন্সি মিয়ার মেয়ের ঘরের নাতি মাসুদ কায়ছার। তিনিও একই সময় দুর্বৃত্তের গুলিতে নিহত হয়েছেন। আনিসের সর্বক্ষণের সঙ্গী হিসেবে সাথে থাকেতন এই কায়ছার। মাসুদ কায়ছারের পরিবারেও চলছে শোকের মাতম। তার আশির্ধব নানী ছেনোয়ারা বেগম নাতির শোকে নির্বাক। নাতির কথা বলতে বলতে বাকরুদ্ধ হয়ে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন তিনি। নাতির মৃত্যুর সংবাদ শোনার পর থেকে তিনি ও তার পরিবারের সদস্যদের আহাজারিতে ভারি হয়ে উঠেছে পরিবেশ।
প্রসঙ্গত, গত বৃহস্পতিবার রাত আটটার দিকে নগরের বায়েজিদ বোস্তামী থানাধীন অনন্যা আবাসিক এলাকার অক্সিজেন-কুয়াইশ সড়ক হয়ে শহর থেকে নিজ বাড়িতে ফেরার পথে হাটহাজারী উপজেলার সীমান্তবর্তী নাহার গার্ডেনের সামনে ওঁৎ পেতে থাকা দুর্বৃত্তরা আনিস ও মাসুদকে লক্ষ্য করে ফিল্ম স্টাইলে গুলি ছুড়ে। এ সময় ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় আনিসের। কিছুদূর দৌড়ে উপজেলার শিকারপুর ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের ছাবের সওদাগরের দোকানের সামনে গেলে মাসুদকেও এলোপাতারি গুলি করলে মৃত্যু হয় তারও।
নিহত আনিস ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং কায়সার আওয়ামী লীগের একজন সমর্থক। তাঁরা স্থানীয় রাজনীতিতে হাটহাজারী উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক ইউনুস গণি চৌধুরীর অনুসারী হিসেবে পরিচিত। পূর্ব শত্রæতার জেরে এই জোড়া খুন হয়েছে বলে দাবি করেছে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নিহত আনিসের এক রাজনৈতিক সহকর্মী।
নিহত মোহাম্মদ আনিসের শ্বশুর মো. শাহাজান জানান, ১০ বছর আগে আনিসের সাথে আমার মেয়ে এনি’র পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়। তাদের সংসারে ৯ বছর বয়সী হুমাইরা আক্তার ও ৪ বছর বয়সী মো. আনাস নামে দুইটি সন্তান রয়েছে। আমাদের জামাতা ব্যবসার (মাটি ও বালি) পাশাপাশি রাজনীতি করত। তবে তিনি কখনও অন্যায় কাজের সাথে জড়িত ছিল না। তিনি অপরাজনীতির শিকার হয়েছেন। তাকে পরিকল্পিতভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। আমি এমন নৃশংস হত্যাকান্ডের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি।
নিহত মাসুদ কায়ছারের মামি মনোয়ারা বেগম বলেন, মাসুদ কায়ছারে বাপের বাড়ি বোয়ালখালি এলাকায়। ছোটবেলায় মা-বাবাকে হারিয়ে মাসুদ নানা বাড়িতে মানুষ হয়েছে। আমরা তার দেখাশুনা করে আসছি। সে পড়াশুনা করা একটি ছেলে। ২০০৮ সালে সে কুয়াইশ বুড়িশ্চর শেখ মোহাম্মদ সিটি কর্পোরেশন ডিগ্রী কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেছে। ওই কলেজে পড়াশোনা করার সময় সে রোভার স্কাউটস এর সদস্য ছিল। সে আমাদের বর্তমান ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আনিসের সাথে থাকত এবং তার সাথে ইট-বালুর ব্যবসা করত। তার কী অপরাধ, কেন তাকে নির্মমভাবে এভাবে গুলি করে নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে তা জানা নেই।