রাত সাড়ে ৮টা। রান্না করা খাবার নিয়ে জেল রোডে পৌঁছে একটি মিনিট্রাক। দেড় শতাধিক রিকশা চালক, ফকির, পথশিশু লালদিঘির আইল্যান্ডে বসেই এসব খাবার সংগ্রহ করেন। গত মঙ্গলবার রাতে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে খাবারগুলো পরিবেশন করা হয়। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সংস্থা, রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মীসহ স্বচ্ছল মানুষরা এভাবেই প্রতিনিয়ত সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। প্রতিদিনই কোনো না কোনো স্থানে ত্রাণ নিয়ে গরীবের দুয়ারে যাচ্ছেন স্বচ্ছল মানুষগুলো। করোনা সংক্রমণ ঝুঁকির এই সময়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে ফিরেছে মানবিকতা।
জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, লকডাউনের কারণে কর্মহীন হওয়া মানুষদের কাছে ত্রাণ পৌঁছে দিতে গত ২৬ মার্চ চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনসহ ১৫টি উপজেলায় ১৭০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেয় সরকার। ইতোমধ্যে এসব চাল বিতরণ সম্পন্ন হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে আবারো লকডাউনের ছুটি বাড়ানোর কারণে দ্বিতীয় ধাপে আবারো সিটি কর্পোরেশনসহ ১৫টি উপজেলায় ১৭০ মেট্রিক টন চাল উপ-বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
চট্টগ্রাম জেলা ত্রাণ ও পূনর্বাসন কর্মকর্তা সজীব কুমার চক্রবর্তী পূর্বদেশকে বলেন, দুই ধাপে সরকারিভাবে সিটি ও উপজেলা মিলিয়ে ৩৭০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এবার যে ১৭০ মেট্রিক টন বরাদ্দ দেয়া হয়েছে সেগুলো শ্রমহীন-কর্মহীন হয়ে পড়া মানুষদের অগ্রাধিকার দিতে বলা হয়েছে। তাদের ঘরে খাবার পৌঁছানোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। উপজেলা প্রশাসন যে তালিকা করবে সেটি ধরেই ঘরে ঘরে ত্রাণ পৌঁছে দেয়া হবে। সিটি কর্পোরেশন এলাকায় কাউন্সিলররা এ তালিকা করবেন।
জানা যায়, বাংলাদেশে মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকেই করোনা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে ভীতির সঞ্চার হয়। সরকারও করোনা সংক্রমণ মোকাবেলায় পর্যাপ্ত উদ্যোগ নিতে শুরু করে। প্রথমদিকে সরকারি ও বেসরকারিভাবে পিপিই, মাস্ক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজারের মতো নিরাপত্তা সরঞ্জাম বিতরণ করা হয়। পরবর্তীতে দেশজুড়ে লকডাউন ঘোষণা করা হলে অস্বচ্ছল মানুষের পাশে দাঁড়ায় সরকার ও স্বচ্ছল ব্যক্তিরা। প্রধানমন্ত্রী সরাসরি সাধারণ মানুষের জন্য বরাদ্দ প্রদান করেন। পাশাপাশি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও নিজেদের বেতনের অংশ দিয়ে ত্রাণ বিতরণ শুরু করেন। তরুণরা বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। চাল, ডাল, আলু, পেঁয়াজ, তেল ও সাবান নিয়ে দিন-রাতের কোনো এক সময়ে ঢুঁ মারছেন গরীবের দরজায়। আবার কেউ ছুটছেন রান্না করা খাবার নিয়ে। শহর-গ্রাম সবখানেই দুস্থ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন একঝাঁক মানবিক মানুষ।
সরকারি প্রতিষ্ঠান, সামাজিক সংগঠনের পাশাপাশি রাজনীতিবিদরাও গরীব মানুষের পাশে আছেন। চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার মানুষকে ত্রাণ তুলে দেয়া হয়েছে। সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের পাশাপাশি নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন নিজস্ব ও সরকারিভাবে পৃথকভাবে ত্রাণ বিতরণ করছেন। আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী রেজাউল করিম চৌধুরীও প্রতিদিন শহরের কোনো না কোনো স্থানে ত্রাণ বিতরণ করছেন। গত মঙ্গলবার সাধারণ মানুষের কাছে ত্রাণ তুলে দিয়েছেন ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। বিএনপির মেয়র প্রার্থী ও নগর বিএনপির সভাপতি ডা. শাহাদাত হোসেন ত্রাণ বিতরণ করেছেন। দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহবায়ক আবু সুফিয়ানও অস্বচ্ছল মানুষের হাতে ত্রাণ তুলে দিয়েছেন। এছাড়াও আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা বিভিন্ন উপজেলায় ত্রাণ বিতরণে অংশ নিচ্ছেন। দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি এসএম বোরহান উদ্দিন ও সাধারণ সম্পাদক আবু তাহের পৃথকভাবে বিভিন্ন উপজেলায় ত্রাণ বিতরণ করছেন। প্রতিদিন ২৫০ লোকের মুখে রান্না করা খাবার তুলে দিচ্ছে বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন। চসিক নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া কাউন্সিলর প্রার্থীরাও ত্রাণ নিয়ে ওয়ার্ডে থাকা গরীবের দুয়ারে যাচ্ছেন।
বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের সিনিয়র ডেপুটি গভর্নর আমিনুল হক বাবু পূর্বদেশকে বলেন, ‘করোনা সংক্রমণের ঝুঁকিতে দেশব্যাপি লকডাউন ঘোষণা করায় এখন সর্বত্রই হাহাকার। অনেকেই মাস শেষে বেতন পেলেও দৈনিক কর্মজীবী মানুষরা বেকায়দায় পড়েছেন। তাদের কাজ বন্ধ থাকায় আয়ও নেই। যে কারণে পরিবারে খাবার তুলে দিতে হিমশিম খাচ্ছে গরীব মানুষগুলো। এরমধ্যেই অনেকেই গরীব মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। লকডাউনের সময় আরো বাড়ানো হয়েছে। এই সময়গুলোতেও সবাই সরকারি নিয়ম মেনে গরীব মানুষের পাশে দাঁড়ালে মলীন মুখগুলোতে হাসি ফুটবে। সবাই যেভাবে এগিয়ে আসছেন, এতে মনে হচ্ছে- সত্যিই ‘মানুষ মানুষের জন্য’।