ভয়াবহ বন্যায় ভাসছে দেশের প্রায় ১২ টি জেলা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ফেনী জেলার পরশুরাম, ছাগলনাইয়া, ফুলগাজী, ফেনী সদর, নোয়াখালী, লক্ষীপুর, মাইজদি, কুমিল্লা, সিলেট, খাগড়াছড়ি ও চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি এলাকা। এসব জেলা উপজেলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় কোটি মানুষ। বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে ঘরবাড়ি, দোকানপাট, আত্মীয়-স্বজন, গবাদি পশু, ফসলি ক্ষেত। কোন কোন এলাকার অবস্থা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে, মৃত মানুষের দাফন কিংবা সৎকার করার মত একটু মাটি কিংবা শুষ্ক জায়গা পাওয়া যাচ্ছেনা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ছবিগুলো দেখলে বিষাদময় হয়ে যায় অন্তপ্রাণ। এরমধ্যে দীর্ঘ এক সপ্তাহ প্রায় প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকা মানুষগুলোর আহাজারিতে আকাশ ভারি হয়ে উঠছে। বন্যাকবলিত এলাকায় কিছুটা পানি নামতে শুরু করলেও জুটছে না খাবার নেই। খাবার রান্না করার মতো পরিস্থিতিতো নেই। পানিতে ভাসলেও পান করার মতো পানি নেই। সবচেয়ে বড় কথা ভানবাসি মানুষের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে সারা দেশের মানুষ। কিন্তু সব জায়গায় এ সাহায্য বা ত্রাণ যাচ্ছে না। দুর্গম এলাকায় ত্রাণ পৌঁছানোই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে ফেনীতে পানির গভীরতা ও স্রোত এতো ভয়াবহ ছিল যে, পানিবন্দি লাখো মানুষকে উদ্ধার করা দুরহ হয়ে পড়েছিল। অনেকে উদ্ধার করতে গিয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন। এ অবস্থায় পানি কিছুটা নামতে শুরু করেছে। পানির ভেতর থেকে গজে উঠছে ডুবন্ত বাড়ি, সড়ক। কিন্তু এতো ত্রাণ যাচ্ছে, পাচ্ছেনা অনেকে। ফলে বানভাসি মানুষের আহাজারি থামছে না। অনবরত তাদের চোখের পানি মিশে যাচ্ছে বানের পানিতে। নিজে অভুক্ত, কোলের শিশুটিও অভুক্ত। অসহায় মা তাকিয়ে আছেন কখন আসবে একটি মমতার হাত। ক্ষুধার জ্বালা থেকে মুক্তি পাবে তাঁর নাড়ি কাটা ধন। বন্যাদুর্গত অনেক এলাকাই দুর্গম হয়ে উঠেছে। বাড়িঘরের মায়ায় কিংবা সহায়-সম্পদ চুরি হওয়ার ভয়ে অনেকে পানির মধ্যেই মাচা বানিয়ে আছেন। অনেকে বাড়ির ছাদে আশ্রয় নিয়েছেন। অনেক দুর্গত এলাকার মানুষের অভিযোগ, প্রয়োজনের তুলনায় ত্রাণসামগ্রী পৌঁছাচ্ছে অনেক কম। কোনো কোনো এলাকায় আদৌ কোনো সরকারি কিংবা বেসরকারি ত্রাণসামগ্রীই পৌঁছায়নি।
ফলে তাঁদের দিন কাটছে অনাহারে। পান করতে হচ্ছে বন্যার পানি। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, ফেনী ও কুমিল্লা উপজেলা সদরের বেশ কয়েকটি জায়গায় পাঁচ শতাধিক পরিবার সদরেই আটকা পড়ে আছে এবং তারা এখনো কোনো ত্রাণ পায়নি। তাদের কাছে কোনো খাবার নেই, বিশুদ্ধ পানিও নেই। অপরদিকে কুমিল্লার মনোহরগঞ্জ উপজেলার গাজিয়াপাড়াসহ আশপাশের গ্রামগুলোতেও সরকারি বা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের পক্ষ থেকে এখনো কোনো ত্রাণ সহায়তা পৌঁছায়নি বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। সেখানে খাবারের কষ্টে মানুষ হাহাকার করছে। দোকানপাটেও তেমন খাদ্যসামগ্রী নেই। সামান্য কিছু পাওয়া গেলেও দাম নেওয়া হচ্ছে অনেক বেশি। এদিকে বন্যাকবলিত অনেক এলাকা থেকেই পানি নামতে শুরু করেছে। সেসব এলাকায় ব্যাপক হারে দেখা দিয়েছে ডায়রিয়াসহ পেটের পীড়া, জ্বর, সর্দি-কাশি ও নিউমোনিয়ার মতো বিভিন্ন রোগ। মেডিক্যাল টিম কাজ করলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। ওষুধেরও অভাব রয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ তহবিলে মানুষ সাধ্যমতো দান করছে। ব্যাংক, বীমা, শিল্প-প্রতিষ্ঠান ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোও এগিয়ে এসেছে, তবে এই জাতীয় দুর্যোগের সময় আরো বেশি এগিয়ে আসা প্রয়োজন। কিন্তু সরকারি ত্রাণ বিতরণে সমন্বয়হীনতা লক্ষ করা গেছে। এ মুহূর্তে ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনায় যেসব দুর্বলতা রয়েছে সেগুলো দ্রুত কাটিয়ে ওঠা প্রয়োজন। বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সংগঠন ছাড়া ও ব্যক্তি পর্যায়ে সংগৃহীত ত্রাণসামগ্রীও জেলা বা উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে বিতরণ করা প্রয়োজন। ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরো বেশি করে এগিয়ে আসা প্রয়োজন। বিশেষ করে স্থানীয়ভাবে রান্না করে খাবার বিতরণ, সুপেয় পানি ও ওরসালাইনসহ ওষুধপত্র খুব বেশি জরুরি। এক্ষেত্রে সরকারের কার্যক্রম আরো গতিশীল করতে হবে। আশার কথা, ভয়াবহ বন্যা মোকাবেলায় বেসরকারি পর্যায়ে দেশের সর্বশ্রেণির মানুষের মধ্যে মধ্যে যে মানবিক উৎকর্ষ দেখা দিয়েছে, তা এককথায় অনন্য।
আমরা আশা করি, সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই দুর্যোগ শিগগিরই কাটিয়ে উঠতে পারবে বাংলাদেশ। তবে এখন পুনর্বাসনের দিকে মনোযোগ দিতে হবে বেশি। কৃষকদের জন্য বিশেষ প্রণোদনাসহ ব্যবসায়ীদের ক্ষতি পূরণে সরকারের বিশেষ সহযোগিতা প্রয়োজন।