মুহাম্মদ জাবেদ হোছাইন
মহররম এলেই আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে ওঠে কারবালার শোক গাথায়। বিশ্বমানবতার ইতিহাসে সবচেয়ে শোকাবহ ও বেদনাবিধুর ঘটনার স্মৃতিবহ এই মাস। কারবালার রক্তাক্ত প্রান্তর আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় ন্যায় ও সত্যের পক্ষে একক ও অবিচল অবস্থান নেওয়ার অপরিমেয় সাহস এবং ত্যাগের চরম শিক্ষা। কারবালার ঘটনা কোনো সাধারণ যুদ্ধ বা ক্ষমতার লড়াই ছিল না। এটি ছিল সত্য এবং মিথ্যার, ন্যায় ও অন্যায়ের মধ্যকার এক চরম দ্ব›দ্ব। মহানবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহুআলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রিয়তম দৌহিত্র ইমাম হোসাইন রাদিয়াল্লাহুআনহু দাঁড়িয়ে ছিলেন সেই অপশক্তির বিরুদ্ধে, যারা ধর্মের নামে অন্যায় প্রতিষ্ঠা করেছিল, জুলুমকে বৈধতা দিয়েছিল এবং ইসলামকে খোলস রেখে ভিতর থেকে ফাঁপা করে দিয়েছিল। ইমাম হোসাইন (রা.) জানতেন, এই যুদ্ধে বাহ্যিক জয় তাঁর হবে না। তিনি জানতেন, জীবন দিয়ে হলেও তাঁকে সত্যের পতাকা উঁচু রাখতে হবে। কারণ জীবন ক্ষণিকের, কিন্তু আদর্শ চিরস্থায়ী।
কারবালা তাই শুধু ইতিহাস নয়, একটি চেতনার নাম। এটি কেবল একটি শোকাবহ ঘটনা নয়, বরং মানবজাতির সামনে অনন্তকাল ধরে জ্বলন্ত বাতিঘর। সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানোর সাহস, অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপোসহীন অবস্থান এবং জীবনকে নয়, আদর্শকে বড় করে দেখার যে শিক্ষা কারবালা দেয়, তা বিশ্ব ইতিহাসে বিরল। কিন্তু আমরা কী করছি? আমরা কি সেই শিক্ষাকে ধারণ করছি? না। দুঃখজনক হলেও সত্য, কারবালার শিক্ষা আজ অনেকের কাছে শুধুই শোকানুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। মজলিসে বসে, মর্সিয়া পড়ে চোখের পানি ঝরাই; অথচ সমাজে অন্যায় দেখে মুখ ফিরিয়ে নেই। দুর্নীতিবাজের সামনে নতজানু হয়ে যাই। ক্ষমতার লোভে সত্যকে বিকিয়ে দিই। কারবালার কথা স্মরণ করে আমরা যতটা কাঁদি, তার একাংশও যদি সত্য ও ন্যায়ের জন্য দাঁড়াতে পারতাম, তাহলে আমাদের সমাজটা বদলে যেত।
আজ আমাদের ঘর-সংসার, সমাজ, রাষ্ট্র ‘সবখানেই কারবালা বিরাজমান। ক্ষমতার লোভ, সম্পদের মোহ, অন্যায়ের প্রশ্রয়, দুর্নীতির জাল’ সবকিছু মিলে আজকের সমাজ হয়ে উঠেছে এক আধুনিক কারবালা। এখানে সত্য চাপা পড়ে যায় মিথ্যার আড়ালে। ন্যায় হারিয়ে যায় ক্ষমতার করাল গ্রাসে। দুর্বলরা নিপীড়িত হয়, মজলুমরা হয় বঞ্চিত। অথচ যারা নিজেদের কারবালার উত্তরসূরি বলে দাবি করে, তারা কি সত্যি সেই চেতনায় উদ্বুদ্ধ?
ইমাম হোসাইন (রা.)-এর জীবন আমাদের শেখায় সত্যের পক্ষে দাঁড়াতে গিয়ে যদি জীবনও দিতে হয়, তবুও পিছপা হওয়া যাবে না। তাঁর বিখ্যাত উক্তি- ‘মৃত্যু আমার কাছে মধুর, যদি তা ন্যায়ের জন্য হয়; অন্যায়ের কাছে মাথা নত করা আমার কাছে লজ্জার।’ এই উক্তি শুধু মহররমের জন্য নয়, বরং প্রতিদিনের জীবনের জন্য। আজ আমরা রাষ্ট্রীয়ভাবে, সামাজিকভাবে এবং ব্যক্তিগতভাবে কতটা হোসাইনি আদর্শ ধারণ করছি? আমরা কি কর্মক্ষেত্রে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলি? ঘুষ, দুর্নীতি, মিথ্যা, প্রতারণা এসব কি আমরা ঘৃণা করি? নাকি সুবিধার জন্য আপস করে নিই? যারা মজলিসে বসে কান্না করে, তারা কি কখনো দুর্নীতির প্রতিবাদ করেছে? জালিয়াতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে? অন্যায়ের প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছে?
কারবালা কেবল রক্ত আর কান্নার নাম নয়, এটি প্রতিবাদের নাম। এটি ত্যাগের নাম। এটি ন্যায়ের জন্য নিঃস্ব হওয়ার সাহসের নাম। অথচ আজ আমরা সেই ইতিহাসকে শুধু শোকের আবরণে মুড়ে রেখেছি। আমাদের মর্সিয়া পাঠ, অশ্রæবিন্দু আর শোকানুষ্ঠান যদি আমাদের জীবনে ন্যায়ের পথে চলার শক্তি না দেয়, তবে সে শোক মূল্যহীন। ইমাম হোসাইন (রা.)-এর সাথে ছিল তাঁর পরিবার, বন্ধু, সহচর — যাঁরা প্রত্যেকেই জানতেন, তারা প্রাণে বাঁচবেন না। তবুও তাঁরা সন্তানদের বিদায় দিয়েছেন, নিজেরা দাঁড়িয়েছেন মৃত্যুর মুখে। কেন? কারণ তারা জানতেন, অন্যায়ের কাছে মাথানত করা এক ধরনের আত্মঘাতী জীবন। জীবনের চেয়েও বড় কিছু আছে। আর তা হলো সত্য, আদর্শ ও বিশ্বাস।
আজকের সমাজে চারপাশে তাকালে দেখা যায়, মানুষ ধর্মকে কেবল আনুষ্ঠানিকতায় রূপান্তরিত করেছে। আমরা নামাজ পড়ি, রোজা রাখি, হজ করি; কিন্তু জীবনের ন্যায়বোধ কোথায়? আমাদের মসজিদ বড় হয়, মাদরাসা হয়; কিন্তু সমাজে সত্যের পক্ষে দাঁড়ানোর মানুষ কমে যায়। আজকের দিনে মিথ্যা বলা সহজ, ঘুষ খাওয়া স্বাভাবিক, দুর্নীতি ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বিপজ্জনক। তাহলে প্রশ্ন আসে ‘কারবালার শিক্ষা কি আমরা সত্যিই নিয়েছি? আজকের মিডিয়া, প্রশাসন, রাজনীতি’ সব জায়গায় মিথ্যারজয়জয়কার। সত্য চাপা পড়ে যায় ক্ষমতার বুটের নিচে। মানুষ সুবিধার জন্য আপস করে, নীতির কথা বলে না। এই সমাজে একজন হোসাইন দরকার, দরকার সেই সাহসী কণ্ঠ, যিনি বলবেন, ‘আমি অন্যায়ের কাছে মাথানত করবো না।’ দরকার সেই মানুষ, যে বলবে’ ‘আমি সত্যের জন্য জীবন দিতেও প্রস্তুত।’
দুঃখজনকভাবে আমরা মহররম এলে শুধু আবেগে ভাসি। এক-দুইদিন কাঁদি, শোক পালন করি। তারপর আবার আগের মতোই ফিরে যাই। অফিসে গিয়ে মিথ্যা বলি, ঘুষ দিই, অন্যায় কাজে আপস করি। এই দ্বিচারিতা আমাদের সমাজকে পচিয়ে দিয়েছে। আমাদের শোকানুষ্ঠান আমাদের আত্মশুদ্ধি করতে ব্যর্থ। কারণ আমরা কারবালার চেতনাকে হৃদয়ে ধারণ করতে পারিনি। ইমাম হোসাইন (রা.) চেয়েছিলেন ইসলামকে বাঁচাতে। তিনি যদি ইয়াজিদের সাথে আপস করে নিতেন, তাহলে তিনি প্রাণে বাঁচতে পারতেন। কিন্তু তখন ইসলাম বাঁচতো না। তাঁর এই আত্মত্যাগ আজও বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের মনে সাহস যোগায়। প্রেরণা জোগায়। উদাহরণ স্বরূপ আফ্রিকার কৃষ্ণ মানুষদের মুক্তি সংগ্রামে, ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা সংগ্রামে, দক্ষিণ আমেরিকার বিপ্লবে কারবালার অনুপ্রেরণা কাজ করেছে। তবে আমাদের সমাজে সেই অনুপ্রেরণার অভাব প্রকট। আমরা ধর্মকে লোক দেখানো কিছু আনুষ্ঠানিকতায় রূপান্তরিত করেছি। আমরা সত্য বলতে ভয় পাই। অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলতে কুণ্ঠিত হই। আমাদের মসজিদে খোৎবা হয়, কিন্তু তাতে নেই সমাজ বদলের ডাক। আমাদের মাদরাসা আছে, কিন্তু তাতে নেই প্রতিবাদ শেখানোর শিক্ষা। আজ দরকার সেই শিক্ষা, যে শিক্ষা আমাদের শেখাবে কিভাবে অন্যায়ের সামনে রুখে দাঁড়াতে হয়। দরকার সেই শক্তি, যা আমাদের শেখাবে, জীবনের চেয়ে আদর্শ বড়। দরকার সেই চেতনা, যা ইমাম হোসাইন (রা.) আমাদের দিয়ে গেছেন। তা না হলে আমাদের শোক, আমাদের মর্সিয়া, আমাদের বিলাপ হবে শুধুই এক ধরনের আত্মপ্রবঞ্চনা।
আজকের বিশ্বে যুদ্ধ, নির্যাতন, বঞ্চনা, নিপীড়ন চলছে সর্বত্র। ফিলিস্তিন, ইয়েমেন, সিরিয়া, কাশ্মীর সব জায়গায় মজলুম মানুষের রক্ত ঝরছে। ক্ষমতাবানদের জুলুম দিন দিন বেড়েই চলেছে। এই বাস্তবতায়কারবালার শিক্ষা আরও বেশি প্রয়োজন। শুধু মুসলিমদের নয়, বরং বিশ্বমানবতার মুক্তির জন্য এই শিক্ষা জরুরি। সত্যের পক্ষে থাকা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো ‘এই শিক্ষাই আজকের পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রয়োজন। ইমাম হোসাইন (রা.) ছিলেন বিশ্বের প্রথম ‘ন্যায়ের বিপ্লবী’। তাঁর বিপ্লব অস্ত্রের বিপ্লব ছিল না। ছিল আদর্শের, নীতির এবং ত্যাগের বিপ্লব। তাঁর রক্ত প্রবাহিত হয়েছে শুধু কারবালার প্রান্তরে নয়; বরং পুরো মানবজাতির ইতিহাসের শিরা-উপশিরায়। আজও সেই রক্তের ডাক আমাদের কানে বাজে’ ‘ত্যাগ চাই, মর্সিয়া-ক্রন্দন চাহি না।’
আমরা যদি সত্যিকার অর্থে কারবালাকে স্মরণ করতে চাই, তবে আমাদের প্রথম কাজ হবে আত্মশুদ্ধি। আমাদের পরিবার থেকে শুরু করে সমাজ, রাষ্ট্র ‘সবখানেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলা, দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া, মজলুমদের পাশে দাঁড়ানো এবং সত্যের পক্ষে আপোসহীন থাকা। নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত’ এসবের সঙ্গে সঙ্গে সমাজ বদলের আন্দোলন গড়ে তোলা। কারণ ইসলামের মূল শিক্ষা শুধু ব্যক্তিগত ইবাদতে নয়, বরং সামাজিক ন্যায়ের প্রতিষ্ঠায়। সত্য প্রতিষ্ঠার পথে মৃত্যু হলে সেটিই হবে শহীদের মৃত্যু। আর অন্যায়ের কাছে মাথানত করে বেঁচে থাকা এটি জীবিত মৃতের মতো। এই উপলব্ধি যদি আমাদের মধ্যে জন্ম নেয়, তাহলে মহররমের শোক হবে অর্থবহ। মর্সিয়া পাঠ হবে আত্মশুদ্ধির মাধ্যম। অশ্রু হবে পরিবর্তনের আগুন। আর কারবালার ইতিহাস হয়ে উঠবে আমাদের জীবনের অনুপ্রেরণা।
তাই আসুন, আজকের মহররমে আমরা শপথ করি ‘শুধু মর্সিয়ার কান্না নয়, আমরা সত্যের জন্য ত্যাগের পথেই চলবো। ক্ষমতার লোভ, জাগতিক স্বার্থ, আত্মকেন্দ্রিক জীবন থেকে মুক্ত হয়ে হোসাইনি আদর্শে বাঁচবো। যদি সমাজের প্রতিটি মানুষ অন্তত নিজের জায়গা থেকে এই সিদ্ধান্ত নেয় তবে নিশ্চিতভাবে সমাজ বদলাবে, রাষ্ট্র বদলাবে এবং পুরো বিশ্ব বদলাতে বাধ্য হবে। কারবালার ইতিহাস আমাদের ডাকে’ ‘জেগে ওঠো! অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াও! সত্যকে ভালোবাসো। ত্যাগ করতে শেখো।’ এই আহ্বানে সাড়া দিলে আমরা কেবল মুসলমান নয়; বরং পুরো মানবজাতির মুক্তির পথ খুঁজে পাবো। আর যদি আমরা শুধু কান্না করি, শুধু শোক পালন করি; কিন্তু জীবনে কিছু না বদলাই তাহলে কারবালার শিক্ষা ও আদর্শের প্রতি সেটি হবে সবচেয়ে বড় অবমাননা।
লেখক : ব্যাংকার, কবি ও কলামিস্ট