তিনিই নুরুল আলম চৌধুরী

144

ক. মুক্তিযুদ্ধ শেষ। শেষ পড়ালেখাও। এবারের ভাবনা জীবিকা। প্রত্যাশা কিছু করা; কর্মের সন্ধান। সে কারণে অংশ নেন প্রথম বিসিএস পরীক্ষায়। কাক্সিক্ষত ফল পেলেন। এবার সরকারি চাকরিতে যাওয়ার পালা। তার আগে গেলেন নেতার (জাতির জনক) কাছে। জানালেন, বিসিএস পাসের কথা। খুশি হলেন নেতা, জড়িয়ে নিলেন বুকে। জাতির জনক বললেন, ‘তোর জন্য আরও বড় কিছু অপেক্ষা করছে। চাকরি নয়, তুই এমপি হবি- প্রস্তুত হ’।
আর গেলেন না সেদিকে। হাঁটলেন জাতির জনকের দেখানো পথে। আরও সক্রিয় হলেন রাজনীতিতে। ১৯৭৩ সালের সংসদ নির্বাচনে পেলেন দলের মনোনয়ন। ফটিকছড়িবাসীর ভোটে হলেন প্রথম সংসদের কনিষ্ঠ সদস্য।
খ. পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট জাতির জনককে সপরিবারে হত্যার পর খুনি মোস্তাক বেতার ভাষণে দাবি করে, ‘ঐতিহাসিক কারণে শেখ মুজিবকে (খুনির ভাষায়) হত্যা করা হয়’। তারপর কোনো একদিন এমপিদের নানাভাবে চাপ দিয়ে বৈঠকে বসেন খুনি মোস্তাক। সেখানে আবারও বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পেছনে নিজের যুক্তি তুলে ধরে বক্তব্য দিচ্ছিলো খুনি। খুনির বক্তব্যের শেষ পর্যায়ে দাঁড়িয়ে যান এক তরুণ এমপি। তিনি মোস্তাকের মুখের ওপর জানতে চান, ‘কোন ঐতিহাসিক কারণে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে, তার জবাব আপনাকে দিতে হবে’।
-সেই টগবগে প্রতিবাদী তরুণ এমপি হলেন নুরুল আলম চৌধুরী।
শুধু কী তাই। জীবনভর ছিলেন নির্লোভ। সারাজীবন বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অবিচল থেকেছেন। তার প্রমাণ রেখে গেছেন জীবনের পরতে পরতে। পঁচাত্তরের পর মন্ত্রিত্ব এবং অনেক লাভজনক পদের অফার পেয়েও আওয়ামী লীগের হাল ছাড়েননি। দুঃসময়ে আঁকড়ে রেখেছেন প্রিয় দল আওয়ামী লীগকে। তাচ্ছিল্যের সাথে খুনি মোস্তাক, জিয়া ও এরশাদের লোভনীয় অফার বাদ দিয়ে এগিয়ে চলেছেন বঙ্গবন্ধুর আদর্শে।
বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন ছিল নুরুল আলম চৌধুরীর। ১৯৬১ সালে চট্টগ্রাম মুসলিম হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক পাসের পর ভর্তি হন চট্টগ্রাম কলেজে। এ কলেজে ছাত্রলীগের সংগঠন যাত্রিকের মাধ্যমে রাজনীতিতে সক্রিয় হন তিনি। হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট বাতিলের দাবিতে গড়া আন্দোলনে ছিলেন প্রথম সারির নেতা। এ আন্দোলনে বন্ধু নুরুল কুদ্দসসহ দুইজন জেল খাটেন। ১৯৬৪ সালে ভর্তি হন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক হন ১৯৬৬ সালে। ১৯৬৯ সালের প্রথম ব্যাচের ছাত্র হিসেবে ¯œাতকোত্তর পাস করেন। মাস্টার্স পাসের পর ফতেয়াবাদ কলেজে অবৈতনিক অধ্যাপনা করেন। ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনেও অগ্রণী ভূমিকা ছিল তাঁর। তিনি বৃহত্তর চট্টগ্রাম ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক ছিলেন। সত্তরের উত্তাল দিনগুলোতে নুরুল আলম চৌধুরী ছিলেন আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর উপ-প্রধান। তখন কক্সবাজার থেকে মিসরসাই পর্যন্ত বিশাল এলাকায় আওয়ামী লীগের পক্ষে জনমত গঠনে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। একাত্তরে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার দিনই মাইক দিয়ে নেমে পড়েন। মাইকে রাখাল চন্দ্র বণিকসহ তিনজন মিলে ‘বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা করেছেন। যার যা আছে তা নিয়ে দুই নম্বর গেইট, ক্যান্টনমেন্টের দিকে অগ্রসর হোন। বন্ধ করে দেন রাস্তাঘাট-সবকিছু’ প্রচার করতেন।
আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর পক্ষে নুরুল আলম চৌধুরীরা এমএ হান্নানের নেতৃত্বে সোয়াত জাহাজে অস্ত্র খালাসে বাধা দেন। তারও আগে বিডিআরকে রসদ জোগানোসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা সাহায্য সামগ্রী বিতরণ করতেন। পাক বাহিনীর শেলিং শুরু হলে তারা পটিয়া থেকে ফটিকছড়ি হয়ে রামগড় চলে যান। সেখানে কিছুদিন অবস্থান করেন। রামগড়ে সংঘটিত যুদ্ধে ক্যাপ্টেন কাদেরের মৃত্যুর পর তাদের দল চলে যান ভারতের সাব্রুম হয়ে উদয়পুর। প্রথম ব্যাচের যোদ্ধা হিসেবে হিসিবে বাগাফা ক্যাম্পে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেন। সেখান থেকে যোদ্ধাদের বিভিন্ন জায়াগায় স্থানান্তরের অংশ হিসেবে নুরুল আলম চৌধুরীকে পাঠানো হয় আগরতলায়। শিক্ষিত হিসেবে তাঁকে ইয়ুথ ক্যাম্পে সহকারী পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র ট্রাস্ট্রের ভিডিও আর্কাইভে যুদ্ধদিনের এসব স্মৃতিচারণ করেন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধের পর প্রথম বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সরকারি আমলা না হয়ে রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়া এবং প্রথম সংসদে কনিষ্ঠ সদস্য হওয়া সবই তাঁর জীবনের উজ্জ্বল ইতিহাস। তারপরের ইতিহাস আরও কঠোর সংগ্রামের। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে আমৃত্যু লড়াই করে যাওয়া নুরুল আলম চৌধুরী টিকে ছিলেন স্বকীয়তায় এবং নিজের যোগ্যতায়।
জাতির জনকের মতো তাঁর কন্যারও আস্থাভাজন ছিলেন। জননেত্রী শেখ হাসিনা ১৯৮৬ সালের সংসদ নির্বাচনে নুরুল আলম চৌধুরীকে মনোনয়ন দেন। সেবারও বিপুল ভোটে ফটিকছড়ি থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। তখনও প্রলোভনের হাতছানি ছাড়েনি তাঁকে। এরশাদ সরকারের পক্ষ থেকে অফার, জাতীয় পার্টিতে গেলেই মন্ত্রিত্ব। যথারীতি ফিরিয়ে দিলেন সেই লোভনীয় প্রস্তাব। তিনি বলতেন, ‘আমার আদর্শ একটাই- সেটা হচ্ছে, বঙ্গবন্ধু। এ আদর্শে থেকেই মরতে চাই’।
জীবনের বাঁকে চলতে গিয়ে অনেক সময় কঠোর অর্থকষ্টে পরলেও আদর্শ বিচ্যুত হননি। কারও লোভ, প্রলোভন টলাতে পারেনি এই নেতাকে। তাই তিনি সততার উদাহরণ হয়ে থাকবেন আগামী প্রজম্মের কাছে।
তিনি রূপালী ব্যাংকের পরিচালক ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ওমানে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেছেন নিষ্ঠার সাথে। সেখানেও সততার দৃষ্টান্ত রেখেছেন। বক্তা হিসেবেও ছিলেন অসাধারণ। তাঁর তথ্য নির্ভর এবং রসিক বক্তব্য সহজে আকর্ষণ করতো মানুষকে। তিনি উচ্চ বংশীয় এবং সুশিক্ষিত মানুষ হলেও ছিলেন নিহংকারী। সমাজের প্রতিটি স্তরে তাঁর সমান গ্রহণযোগ্যতা।বর্ষীয়ান এই রাজনীতিবিদ রোববার (২৭ জানুয়ারি) ভোরে চট্টগ্রাম নগরীর একটি প্রাইভেট ক্লিনিকে ইন্তেকাল করেন (ইন্নালিল্লাহে ওয়াইন্না ইলাহে রাজিউন)। তাঁর মৃত্যুতে চট্টগ্রামজুড়ে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
লেখক : যুগ্ম-মহাসচিব, বিএফইউজে