‘তারুণ্যের শক্তি’ কাজে লাগিয়ে দেশ গড়তে চায় বিএনপি

4

মীর হেলাল

জনসংখ্যার দিক থেকে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ এখন এক অন্যরকম ‘সোনালী অধ্যায়ে’ অবস্থান করছে। শুরুতেই একটি পরিসংখ্যান দিইÑ২০২৩ সালের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি। এর মধ্যে ৫ কোটিরও বেশি মানুষ তরুণ বয়সী, অর্থাৎ ১৫ থেকে ৩৪ বছর বয়সী। শুধু ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণ-তরুণীর সংখ্যা প্রায় ২ কোটি ৭০ লাখ। জনসংখ্যার হিসেবে তরুণ জনগোষ্ঠী ৩০ শতাংশেরও বেশি। আমাদের দেশের গড় বয়স মাত্র ২৮ বছর; যা বুঝায় বাংলাদেশ এখন একটি ‘তরুণ দেশ’। জনসংখ্যায় যে দেশটি তরুণ, সেই দেশটিতে সঠিক নেতৃত্ব থাকলে, যুগোপযোগী পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হলে, তরুণদের শক্তিকে কাজে লাগানো গেলে, যে কোনো অসাধ্য সাধন করা তো সম্ভব, একই সাথে বিশ্বের দরবারে দেশটিকে নতুনভাবে পরিচিত করাও সম্ভব।
দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, বিগত পনেরো বছরের একদলীয় শাসন ব্যবস্থার যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে এ দেশের তরুণ সমাজ যথেষ্ট হতাশগ্রস্ত, বিভ্রান্ত। অধিকারহীন সমাজে বড় হতে হতে তারা নিজেদের অধিকার সম্পর্কে প্রায়ই উদাসীন অবস্থার মধ্যেই রয়েছেন। ফ্যাসিবাদী সরকার চেয়েছিল এই দেশের তারুণ্যের শক্তিকে দমিয়ে রাখতে, বিনাশ করে দিয়ে ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করতে কিন্তু জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এই দেশের তরুণরা সেই ভয়ের দেয়াল ভেঙে নতুন করে আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন।
এখন আমাদের তরুণদের অধিকার প্রতিষ্ঠার সময়, এখন আমাদের তরুণদের ভবিষ্যৎ গড়ার সময়, এখন আমাদের নতুন দেশ গড়ার কাজে ঐক্যবদ্ধভাবে মনোনিবেশ করার সময় এসেছে। কারণ, তরুণরা কেবল ভবিষ্যৎ নয়Ñতারা বর্তমান। তরুণরা শুধু আগামীর নেতৃত্ব নয়, তারা আজকের নেতৃত্ব। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুমে, গ্রামের পাঠশালায়, প্রযুক্তি স্টার্টআপে, ফ্রিল্যান্সিং ডেস্কে, শিল্প কারখানায় এবং কৃষি ক্ষেতে কাজ করছে, তারা নতুন ধ্যান-ধারণা দিয়ে দেশ ও মানুষের ভাগ্যকে গড়ে দেওয়ার, বদলে দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন। যারা গার্মেন্টসের ফ্লোরে ঘাম ঝরিয়ে দেশের অর্থনীতিকে সচল রেখেছে, যারা স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠা করে নতুন পণ্যের ধারণা দিচ্ছে, যারা কী-বোর্ডের সামনে বসে বিশ্ববাজারে দেশের নাম ছড়াচ্ছেন-তারা সবাই তরুণ।
তারুণ্যের এই শক্তিকে কাজে লাগিয়ে, এই শক্তিকে সঙ্গে নিয়েই বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলÑবিএনপি, ফ্যাসিবাদী শক্তির তলানিতে নিয়ে যাওয়া দেশকে নতুনভাবে গড়তে চায়। আমাদের দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান, জনাব তারেক রহমান তাঁর রাজনৈতিক চিন্তাচেতনার সমস্ত কার্যকলাপে তরুণদের সম্পৃক্ত করেছেন, তরুণদের গুরুত্ব দেওয়ার চেষ্টা করছেন, তরুণদের ভাবনা-চাওয়াকে প্রাধান্য দেওয়ার চেষ্টা করছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের সবচেয়ে বড় সম্পদ এই দেশের তরুণ জনগোষ্ঠী। আমাদের নির্দিষ্ট ভূমি, সীমিত সম্পদের মধ্যে তরুণরাই দেশের প্রধান চালিকা শক্তি; যদি তাদের সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো যায়।’ তার এই উপলব্ধির বাস্তব প্রতিফলন কিংবা বাস্তবায়নের নিদর্শন হলো-আজকের যে সমাবেশ, চট্টগ্রামের পলোগ্রাউন্ড মাঠে অনুষ্ঠিত হচ্ছে সেটিই। জনাব তারেক রহমান তারুণ্যের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। গত ১৭ বছর ধরে এই দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি, এই দেশের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করে আসছে, সেই লড়াইয়ে আমাদের শত শত নেতাকর্মী গুম-খুন, অবর্ণনীয় জুলুম-নির্যাতন, নীপিড়নের শিকার হয়েছেন; তবুও এই দেশের মানুষের অধিকার, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে অবিচল থেকেছেন।
এই কথা অনস্বীকার্য যে, জুলাই বিপ্লবে তরুণদের ভূমিকা, তারুণ্যের ভূমিকা একটি ঐতিহাসিক বাস্তবতা। তরুণরা রক্ত দিয়েছেন বলেই আজ কথা বলার, সমাবেশ করার অধিকার আমরা পেয়েছি। আমরা দীর্ঘদিন ধরে লড়াই করছি মানুষের ভাত ও ভোটের অধিকারের জন্য-একটি সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য। আজকের এই সমাবেশ-তারুণ্যের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার সমাবেশ। আমরা বিশ্বাস করি রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা হলেই তরুণরা দেশের চালিকা শক্তি হয়ে উঠতে পারে, রাষ্ট্র পরিচালনার প্রতিটি ক্ষেত্রে তরুণদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হতে পারে, তারুণ্যের মেধা-দক্ষতা, ধ্যান-ধারণা রাষ্ট্র ও সমাজের উন্নয়ন-উন্নতিতে কাজে লাগানোর সুযোগ তৈরি হতে পারে। সে জন্য আমাদের দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বর্তমান বাস্তবতায় তারুণ্যের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সারা দেশের তরুণদের সরব করার উদ্যোগ নিয়েছেন। এই উদ্যোগ শুধু রাজনৈতিক সমাবেশ নয়; এটি তারুণ্যের মন বোঝার আয়োজন, এটি একটি রাজনৈতিক দলের তারুণ্যের প্রতি তার যে অঙ্গীকার, তার যে ভিশন তা তুলে ধরার একটি উদ্যোগ। এই সমাবেশের মাধ্যমে তারুণ্যের রাজনৈতিক অধিকার তথা ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার বার্তা যেমন জোরালো হবে, তেমনি তারুণ্যের প্রতি রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির অঙ্গীকারও দৃঢ় হবে। এই সমাবেশের আয়োজন করেছে বিএনপির তারুণ্য নির্ভর তিনটি অঙ্গ-সংগঠন-বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী যুবদল, স্বেচ্ছাসেবকদল ও ছাত্রদল। এই তিন সংগঠনের যারা নেতৃত্ব দেন তারা বয়সে তরুণ, তারুণ্যের হৃদয় তারা পাঠ করতে পারেন, তরুণদের তারা বুঝতে পারেন, তারুণ্যের সাথে তাদের মিথস্ক্রিয়া ভালো। এই সম্পর্ক, এই বোঝাপড়া আরও দৃঢ় করার লক্ষ্যেই এই আয়োজন।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি বড় পরিবর্তন আনতে চায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। দলটি মনে করছে, এদেশের তরুণ প্রজন্মই পারে রাজনৈতিক পুনর্জাগরণ ঘটাতে এবং একটি গ্রহণযোগ্য, অংশগ্রহণমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভিত গড়ে তুলতে। এই ভাবনা থেকেই আমরা তরুণদের ভূমিকা এবং অধিকারের প্রশ্নকে অগ্রাধিকার দিচ্ছি সব সময়। আমরা তরুণদের সঙ্গে নতুন এক মেলবন্ধনের চেষ্টা করছি। কারণ, আমরা বিশ্বাস করি, একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় তরুণদের সক্রিয় অংশগ্রহণ শুধু সময়ের দাবি নয়, এটি একটি রাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতার পূর্বশর্ত। আমাদের দলের চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেন, “আমরা সেই বাংলাদেশ গড়তে চাই, যেখানে একজন তরুণ নিজের চিন্তা ও স্বপ্নের জায়গা থেকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে এগিয়ে যেতে পারবে। আমরা বিশ্বাস করি, তারুণ্যই গণতন্ত্রের শেষ ভরসা।”
বিএনপি রাষ্ট্র পরিচালনা বা রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য যে ৩১ দফা প্রস্তাবনা দিয়েছে তাতে তরুণদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, ক্ষমতায় গেলে বিএনপি ‘জাতীয় যুব কাউন্সিল’ গঠন করবে, যেখানে দেশের সব বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যায় থেকে প্রতিনিধিত্ব থাকবে। এই কাউন্সিল হবে তরুণদের মতামত, অভিজ্ঞতা ও উদ্ভাবনী চিন্তার প্ল্যাটফর্ম। এই প্রস্তাবে তরুণদের কর্মসংস্থান, শিক্ষা, উদ্যোক্তা উন্নয়ন, রাজনৈতিক অধিকার এবং তথ্যপ্রযুক্তিতে অভিগম্যতা—এই সব বিষয়ে বিস্তর পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছে। এছাড়া তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ ও প্রশিক্ষণ প্রদানের প্রতিশ্রুতিও রয়েছে। শিক্ষা ব্যবস্থাকে যুগোপযোগী করার অংশ হিসেবে প্রযুক্তি-নির্ভর পাঠ্যক্রম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গবেষণা জোরদার, এবং ‘ই-লার্নিং সেন্টার’ প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে তারুণ্য বরাবরই বড় ভূমিকা রেখেছে। ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রাম, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, সর্বশেষ জুলাই বিপ্লব-সবখানেই তরুণদের ভূমিকা বলিষ্ঠ। বিএনপি এবার সেই ঐতিহাসিক চেতনাকে আধুনিক বাস্তবতায় রূপ দিতে চায়। দলটি মনে করছে, রাজপথ হোক বা রাষ্ট্রের গঠনপ্রক্রিয়াÑসবখানেই তরুণদের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা না গেলে একটি টেকসই গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়া সম্ভব নয়। তরুণরা যদি দল-মতের ঊর্ধ্বে উঠে সত্যিকারের গণতন্ত্র ও সুশাসনের প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ হয়, তবে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বড় পরিবর্তন আসতে বাধ্য। বিএনপি সেই সম্ভাবনার ওপর ভর করেই এগিয়ে যেতে চায়।
বাংলাদেশের প্রতিটি তরুণের মাঝে আমি দেখি একজন বিজয়ী। তারা ইতিহাস গড়তে চায়, দায়িত্ব নিতে চায়। আমরা যদি তাদের আস্থা দিই, তারা আমাদের আশার আলো হয়ে উঠবে।
আসুন, আমরা আমাদের তরুণ শক্তিকে আর শুধুই উৎসবের বক্তৃতায় সীমাবদ্ধ না রেখে ব্যবহারিক প্ল্যাটফর্মে প্রতিষ্ঠিত করি।
জয় হোক তারুণ্যের, জয় হোক বাংলাদেশের।

লেখক :
ব্যারিস্টার মীর মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন
কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক,
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি