‘তাক্ওয়া’ শান্তি, সফলতা ও ঐক্যের মূলমন্ত্র

1

ছৈয়দ আখতার কামাল শাহ্ আল্ মাইজভান্ডারী

আমরা বর্তমানে এমন একটি সময় অতিবাহিত করছি; সমাজ এবং রাষ্ট্রের প্রতিটি রন্ধে-রন্ধে হিংসা, বিদ্বেষ, রাহাজানি, কলহ, ফিতরা, অশান্তির দাবানল দাউ দাউ করে জ্বলছে। বিশ্ব মুসলিম মিল্লাত ৭৩ ফিরকার শিকলে আবদ্ধ। ধর্ম, মানবতা, একতা, ভ্রাতৃত্ব এইগুলো তো কিতাবে শিকলবন্দী। মানুষ দিশেহারা। সত্য আজ মিথ্যায় মিশ্রিত। তবুও মানুষ শান্তির আশায় দিক বে-দিক ঘুরছে। শান্তি, সফলতার জন্য ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে। অনৈক্য অশান্তির মূল কারণ এটা বুঝতে আরম্ভ করছে। তাই আজ ইসলামী দল সমূহ সকল মত পার্থক্য ভুলে একে অন্যের প্রতি ঐক্যের আহবান জানাচ্ছে। “আসুন আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটি কল্যাণকর রাষ্ট্র গড়ে তুলি। যেখানে সৎলোকের শাসন, আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠার কোন বিকল্প নাই। এই জন্য ঐক্যের অতিব প্রয়োজন। ঐক্য ছাড়া সফলতা, শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে না।’ আজ মুসলিম জাতি ঈমানের ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত। এই রোগ থেকে আরোগ্য লাভ না করে যতই ঐক্যের আহবান করা হউক উহা কার্যকর হবে না। আল্লাহ্ পাক (জ.) কুরআনুল করিমে ইরশাদ করিয়াছেন, অর্থঃ “এবং যারা আনুগত্য করে আল্লাহ্ ও রাসুল (সা.)’র এবং একমাত্র আল্লাহকে ভয় করে আর তাক্ওয়া পরহেজগারিতা অবলম্বন করে তবে এই সকল লোকই সফলকাম।” (সুরা নূর: আয়াত-৫২) আল্লাহ্ পাক আরো ফরমাইয়াছেন; অর্থঃ “হে আদম সন্তানগণ, তোমাদের নিকটে আমার পক্ষ থেকে বার্তা বাহক আসবে, তোমাদের নিকটে আমার আয়াতসমূহ বিশদভাবে বর্ণনা করবে। অতঃপর যারা তাক্ওয়া অবলম্বন করবে এবং নিজেদের সংশোধন করবে তাদের জন্য কোন ভয় নাই, তাঁহারা চিন্তিত হবে না।” (সূরা আরাফ: আয়াত-৩৫) উপরে উল্লেখিত কুরআন মাজিদের আয়াতে করিমা থেকে আমরা স্পষ্টরূপে জানতে পেরেছি যে, যদি সফলতা চাও, শান্তি চাও, তবে তোমরা মুত্তাকি হয়ে যাও। পরহেজগার ছালেহ্ মোখলেস হও। তবেই সফলতার চাবিকাঠি তোমাদের হাতে এসে পৌছাবে।
ঐক্যঃ কে কার সাথে ঐক্য হবে? নিঃসন্দেহে মুমিন, মুত্তাকীগণ একে অন্যের সাথে ঐক্য হবে। আমরা মুত্তাকি, মুমিন, পরহেজগার, ছুফী, এই কথা মুখে যতই বলিনা কেন কোন কাজে আসবে না। তাক্ওয়া, পরহেজগারিতা, খোদাভীতি এই সকল ভিতরের ব্যাপার। তাক্ওয়া ব্যক্তির আমল, আখলাক, চাল-চলন, কাজে কর্মে চরিত্রে প্রমাণিত হয়। আল্লাহ্ পাক (জ.) কোরআন মাজিদে কি বলেন নাই? তোমাদের মাঝে উত্তম তো ঐ ব্যক্তি যেই ব্যক্তি অধিক তায়া অর্জনকারী। আল্লাহ্ তায়ালা ফরমাইয়াছেন; অর্থঃ ‘অন্তরঙ্গ বন্ধুগণ যে দিন একে অন্যের শত্রু হয়ে যাবে, কিন্তু মুত্তাকীনগণ ব্যতীত।’ (সূরা যখরুক: আয়াত-৬৭) প্রমাণিত হলো কেবল মুত্তাকীনগণ একে অন্যের বন্ধু হবে। একে অন্যের সাথে ঐক্য হবে। গাইরে মুত্তাকীর সাথে বন্ধুত্ব, ঐক্য হওয়া সম্ভব নয়। যতই করমোর্দন করা হউক, সিনাতে সিনা মিলানো হক, চা চক্র হউক, এক টেবিলে বসে আলোচনা ও ঐক্যের স্মারক খাতায় দস্তখত করা হউক। সে ঐক্য টিকবে না। সফল হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত উভয় দলের আক্বিদা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আক্বিদা না হবে এবং নবী, অলী প্রেম, আদব, তাজিম ইতেয়াদকারী না হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত সকলের ভিতরে তাওয়া পরহেজগারিতার নূর প্রবেশ না করবে। স্মরণ রাখা উচিত এটা আল্লাহর দেওয়া বিধান। আল্লাহর বাণীঃ “হুদাল্লিল মুত্তাকীন” হেদায়েত মুত্তাকীনদের জন্য। এখানে বুঝার জন্য “হুদান” শব্দটিকে অতি পাওয়ারফুল, উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন ঔষধের সাথে তুলনা করা যায়। ইহা এমন এক প্রকার মহাঔষধ যাহা কামেল পীর মুর্শিদ নামক রূহানী চিকিৎসকের পরামর্শ অনুসারে নিয়মিত পরিমিত পরিমাণে সেবন করলে একটিমাত্র ঔষধে অনেক প্রকার ঈমানের প্রাণঘাতি রোগ থেকে রোগী নিশ্চিত আরোগ্য লাভ করবে। এই ঔষধ অনেকগুলো নূরানী উপাদানের সমন্বয়ে তৈরি হয়।
যেমন: * বিশুদ্ধ আক্বিদা বা ইমানের নূর * তাওহীদ, রেসালাত, বেলায়তের নূর * ইঙ্কে মোস্তফা, আদাতে মোস্তফা, ইতেয়াতে মোস্তফা, ইস্কে ছালেহীন, তাজিমে ছালেহীন, ইতেয়াতে ছালেহীন, তাওবা, খাউফ, জৈক, খুশউ, খুদউ, ছালাত, সাউম, তেলাওয়াতে কোরআন, সদকাহ্, আমলে ছালেহা, জাহের বাতেন পবিত্রতার নূর। ছবর, তাওয়াক্কুল ইন্তেজারি, রোনাজারি এমিনান কোরবতে ইলাহির আকাঙ্খা ইত্যাদি গুণাবলী একত্রিত করলে তৈরী হয় “হুদান” নামক ঐষধ বা আমৃত সুধা, ইসলাহে নাম্স, ইসলাহে কাল্ব হলেই এই ঔষধে ঈমানের প্রাণঘাতি রোগ থেকে আরোগ্য লাভ করবে। রোগী হবে পরিপূর্ণ মুত্তাকি, মুত্তাকিগণ পরিপূভাবে হেদায়তের উপরে প্রতিষ্ঠিত এবং হেদায়তের পথে আহবানকারী। মুত্তাকিগণ সৎ, যোগ্য ব্যক্তি, তাদের হৃদয় খান্নাছ মুক্ত, পুত: পবিত্র প্রশান্ত। আল্লাহর বাণী; অর্থঃ ‘নিশ্চয় রিপু মন্দ কাজের বড় নির্দেশদাতা। কিন্তু ঐ সকল ব্যক্তি রিপুর কুমন্ত্রণা থেকে মুক্ত, যাদের প্রতি মহান রব দয়া করেছেন।’ (সূরা ইউছুপ: ৫৩) আল্লাহ্ পাক (জ.) দয়া করেন, রহমত, বরকত দান করেন, মুহাব্বত করেন, নৈকট্য দান করেন। তাওয়া পরহেজগারিতা দান করেন। অনন্তে হায়াত দান করেন যাদেরকে, তাঁদেরকে পবিত্র কোরআনের ভাষায় মুত্তাকীন, সালেহীন, মোখলেছিন, সাদেকীন, মোমেনীন, তাওয়াবিন, মুতাতাহেরীন, মুমিনীন বলা হয়েছে। আল্লাহর বাণী; অর্থঃ নিশ্চয় আল্লাহর রহমত রয়েছে মোহর্সেনিনদের নিকটে। আল্লাহর অসংখ্য গুণাবলী অর্জনকারীগণের গুণবাচক নাম পবিত্র কোরআন থেকে আমরা জানতে পারলাম। তরিকৃত ও তাসাউফের ভাষায় তাঁহারাই গাউছ, গাউছুল আজম, কুতুব, কুতুবুল আলম, অলিউল্লাহ, আবদাল। এক কথায় ছুফীয়ায়ে কেরাম নামে পরিচিত।
পরিশেষে বাংলাদেশে যতগুলো ইসলামি দল রয়েছে সকলের উদ্দেশ্যে বলা যায়, সবাই স্বীয় অবস্থানে বসে অন্তরের অন্তস্থল থেকে ইসলামের মূল ও বৃহৎ জামাত আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আক্বিদা হৃদয়ে ধারণ পূর্বক মুত্তাকীর গুণাবলী অর্জন করলে আল্লাহর পক্ষ থেকে ঈমানের বদৌলতে আমাদের মাঝে ঐক্য হয়ে যাবে। বিজয় তো মুত্তাকীনদের জন্য। সফলতা, প্রশান্তি আমরা ফিরে পাবোই ইনশাআল্লাহ। ইহাতো আল্লাহর ওয়াদা। আমিন।
লেখক : সাজ্জাদানশীন,
আস্তানায়ে নজির ভান্ডার, চট্টগ্রাম