কাজী আবু মোহাম্মদ খালেদ নিজাম
২০২৪ এর ছাত্র-গণ আন্দোলনের সূচনা করে তরুণ শিক্ষার্থীরা। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের নজিরবিহীন ও রাজপথ কাঁপানো এই আন্দোলনে পরবর্তিতে যোগ দেয় আমজনতা। এতে সফলও হয় তারা। যদিও শত, হাজার প্রাণ ঝরে গেলো। আহত হন হাজার হাজার মানুষ। যা কাঁদিয়েছে, কাঁদাচ্ছে সবাইকে। এ দেশের ইতিহাসে কোন আন্দোলনে এত রক্ত, এত প্রাণ ঝরেনি। এমন রক্ত ঝরার দিনগুলোর কথা মনে হতেই ডুকরে কেঁদে উঠে মন-প্রাণ। একেকটি মৃত্যুর দৃশ্য দেখলে ছিঁড়ে যায় কলিজা। এমনতো হওয়ার কথা ছিলনা। আল্লাহ সবার প্রাণ বিসর্জনকে কবুল করুন। তরুণরা চাইলে কী না পারেন তা এই আন্দোলনের মাধ্যমে তা আরো একবার প্রমাণ হয়েছে। আসলে পরিবর্তন আর অধিকার আদায়ের যে কোন আন্দোলন সফল করতে তরুণরাই এগিয়ে। ছাত্ররা যুগে যুগে নানা আন্দোলনের অগ্রভাগে ছিল। সে কারণে এ দেশ আর আগামির বিশ্বকে গড়তে হলে তরুণদের হাতেই ছেড়ে দিতে হবে স্থান। তারাই নিজেদের মতো করে সাজাবে এ ধরণী, নিজের মাতৃভূমি। বর্তমান অন্তর্র্বতীকালীন সরকারেও রয়েছে তরুণদের অংশগ্রহণ। শিক্ষিত তরুণ ও যুবকদের বেশিই প্রয়োজন দেশ গঠনে।
এ সময়টা আসলে খুবই ক্রিটিক্যাল। পত্রিকা, ইলেকট্রনিক মিডিয়া, ফেসবুকসহ নানা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন অপরাধের সবিস্তার বর্ণনা ফলাও করে প্রচার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এ সময়েই অপরাধ তার পূর্ণ শক্তি নিয়ে প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। হানাহানি, অনৈতিক কর্মকান্ড ব্যাপৃত চারদিক। সমাজের এ অবস্থা বদলাতে তরুণ ও যুব সমাজকে বিশেষ করে শিক্ষিত এবং যারা সৎ তাদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে। যারা ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত হবে। মানুষের উপকারে নিজেদের জীবন বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত থাকবে। এজন্য প্রথমেই শিক্ষা অর্জনের কোন বিকল্প নেই। তাছাড়া, এমনিতে শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার। এ অধিকার থেকে কাউকেই বঞ্চিত করার কোনই সুযোগ নেই। সমাজ ও রাষ্ট্রে শিক্ষিত লোক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে শিক্ষিত তরুণ সমাজের প্রয়োজনিয়তা অপরিসীম। তারা সমাজটাকে বদলে দিতে পারে। বদলে দিতে পারে সব ধরনের কুসংস্কার।
মানুষের পুরো জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে তার তারুণ্যের সময়টুকু। বলা চলে, সুনির্দিষ্ট এই সময়েই মানুষের জীবনের মোড় ঘোরে। জীবনের স্বর্ণালী সময় এই যৌবনকাল। এখন যারা তরুণ (বিশেষ করে যারা শিক্ষা অর্জনে ব্যাপৃত রয়েছে, শিক্ষার্থী) তাদের ভাবতে হবে ভবিষ্যত নিয়ে। হেলায়, খেলায় এই যৌবনকাল কেটে গেলে জীবনে সফলতা আসবে না। সামর্থ্য ও মেধাকে কাজে লাগিয়ে জীবনের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ করে সেখানে নোঙর ফেলতে হবে। অনেক তরুণ মনে করে, বোধ হয় এই সময়টাই আনন্দ ফ‚র্তি করার মোক্ষম সুযোগ। আর মনে করাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মনে রাখতে হবে, ভালো কিংবা খারাপ হওয়ারও উপযুক্ত সময় একাল! ফলে মন যা চায় তা করতে থাকলে শেষ জীবনে অনুশোচনা করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকবেনা। অনেক তরুণ, যুবককে দেখা যায় নেশার ঘোরে মাতাল হয়ে রঙিন দুনিয়ার স্বপ্ন দেখতে। সততা সত্যবাদিতা আর চারিত্রিক সৌন্দর্যকে পায়ে ঠেলে জীবনের মানে খুঁজে ফেরে। সব ধরনের অশ্লীলতা ও অনৈতিকতাকে নিজের জন্য উপযোগী মনে করে। অথচ এসব কিছু যে জীবন ধ্বংসের উপাদান তা যৌবনের তাড়নায় বুঝে উঠতে পারে না যুবক বৈকি! বুঝলেও তখন আর সময় থাকে না। এবারের ছাত্র-গণ আন্দোলনে অবশ্য তরুণদের অসাধারণ ও আপোষহীন ভূমিকা প্রশংসিত হয়েছে সবদিকে। যে শিক্ষার্থী বা তরুণ অনলাইন বা অকাজে সময় ব্যয় করতো সারাদিন তাদের মাঝেই কিন্তু অধিকার আদায়ের স্পৃহা এবং দেশপ্রেম জেগে উঠার এমন দৃশ্য মুগ্ধ করেছে সবাইকে। এমন তরুণদেরই চেয়েছিলাম!
সমাজ ও দেশের কল্যাণে তরুণদের সুশিক্ষার পাশাপাশি নৈতিক চরিত্রে হতে হবে আদর্শবান। সমাজের অনিয়ম আর দুর্নীতি ও মাদকমুক্ত সমাজ গড়তে তাদের ভূমিকা রাখতে হবে। তাদের অবশ্যই সব ধরনের অপরাধ ও অনৈতিক কর্মকান্ড থেকে ফিরে আসতেই হবে। নিজের মা-বাবা, দেশ ও মানুষের স্বপ্ন পূরণে, জাতি গঠনে নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে। কারণ, সবাই তাদের নিয়ে স্বপ্ন দেখে। তারাই নেতৃত্ব দেবে জাতিকে। নানা আন্দোলনে শিক্ষিত তরুণ এবং যুবকদেরই অংশগ্রহণ থাকে সব থেকে বেশি। তারাই দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র নিপীড়ণের বিরুদ্ধে রূখে দাঁড়িয়েছিল। এসব আন্দোলন ও প্রতিবাদ সাধারণ মানুষের মাঝে সচেতনতা বাড়িয়েছে। এবারের ছাতজনতার আন্দোলন যার তরতাজা প্রমাণ।
তরুণদের হতে হবে সাহসী। ধর্মীয় অনুশাসনের অনুসরণ, সৎ ও যোগ্য করে নিজেকে তৈরী করার মানসিকতাসস্পন্ন। কোন ধরনের মাদকতা স্পর্শ করতে পারবে না তাদের। মাদকের বিরুদ্ধে অবস্থান হতে হবে আপসহীন। সময়ের সাহসী পুরুষ হিসেবে দেশ ও জাতির আলোকবর্তিকা হয়েই উদ্ভাসিত হতে হবে। অসহায় জনগণ তাদের দিকেই তাকিয়ে। জাতির স্বপ্ন পূরণে শিক্ষিত তরুণদেরই নেতৃত্বের আসনে সমাসীন হতে হবে। নেশার ঘোরে জীবনের মানে নেই। চরিত্র গঠন ও মানুষের কল্যাণের মাঝেই জীবনের অর্থ খুঁজতে হবে। তবেই বদলে যাবে জীবন, বদলে যাবে মন ও মনন। তবে তরুণদের প্রতিও রাষ্ট্র ও সমাজের অনেক দায়িত্ব রয়েছে। কর্মসংস্থানের পাশাপাশি সবধরনের ভালো কাজ ও সমাজের কল্যাণে তাদের সম্পৃক্ত করতে হবে। জ্বালাতে হবে আশার বাতিঘর।
আধুনিকতার নামে যাবতীয় বেলাল্লাপনা আর নষ্টামিকে ছুঁড়ে ফেলে একজন শিক্ষিত তরুণ তার জীবনকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে পারে। দূরে ঠেলবে সব অপসংস্কৃতিকে। এড়িয়ে চলতে হবে মন্দ লোকের সংস্পর্শ। যে আদর্শ বিপথগামী করবে, পথহারা করবে সে আদর্শ পরিত্যাগ করতে হবে। আদর্শের প্রশ্নে আপসহীন, চরিত্রবান তরুণ নেতৃত্ব চাই। তরুণ ভালোবাসবে নিজেকে, নিজের পরিবার, সমাজ ও দেশকে। তবেই সার্থক হবে জীবন-যৌবন। তবেই দিশাহীন মানুষ দিশা পাবে। তোমরা যারা শিক্ষিত তরুণ, যুবক-তোমাদের কাছেই এ প্রত্যাশা সবার। তোমরাই সমাজটাকে, দেশটাকে এমনকি পুরো বিশ্বটাকেই বদলে দিতে পারো।
লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট