
অমল বড়ুয়া
এক নিশ্চল নির্দয় নিদারুণ আলুলায়িত ক্ষণ পার করছে সময়। কিংকর্তব্যবিমূঢ় নির্বাক সংকোচে-দ্বিধায় আড়ষ্ট সমাজ। অবরুদ্ধতার অবগুণ্ঠনে তন্দ্রালস কাতরতায় বোধ ও বোধি। চেতনার গহব্বরে বিবশ খরা। অন্ধকার বিদিশায় পথভ্রষ্ট পথিক। আত্মশ্লাঘা, আত্মবিকার আর আত্মপরতায় নিমগ্ন মানুষ। ক্রোধ, হিংসা, বৈষম্য আর জিঘাংসার অর্হনিশ অনলে পুড়ছে জনসমাজ। মাৎস্যন্যায় জেঁকে বসেছে মনে-জনে সমাজে। দুঃসময়ের এই দুর্লঙ্ঘ্য প্রস্তর দেয়াল ভাঙÍতে হবে, জাগতে হবে মুক্তির বরাভয়ে। আর এই মুক্তির অন্বেষার প্রদীপ্ত সারথী হলেন দুরন্ত তরুণ, আগুনে যুবশক্তি, সাহসী তারুণ্য। এই ঘোর অন্ধকার বিদিশার অন্তসাধনে জাগতে হবে নবচেতনার তরুণকে। সময়ের অনন্য দিশারী হতে হবে তরুণদের। ‘তরুণ’ শব্দের অর্থ হলো প্রেরণার উৎস, চেতনার বহ্নিশিখা, বোধির স্ফুরণ, আঁধার ভাঙ্গার মার্তন্ড আর সত্য-সুন্দরের মনন-সৃজনের মহানায়ক, মহাকালের অগ্রদূত। তারুণ্য মানে শুধু বয়স নয়, বরং একটি মনোভাবও বটে। পাবলো পিকাসো বলেছিলেন- ‘তারুণ্যের কোনো বয়স নেই।’ তরুণরা সাধারণত উদ্দীপ্ত, উৎসাহী, সাহসী এবং ঝুঁকি নিতে পছন্দ করে। তারা নতুন অভিজ্ঞতা চায় এবং বিশ্ব পরিবর্তন করতে চায়। বাংলা সাহিত্যে তরুণ্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অনেক কবি ও লেখক তারুণ্যের সৌন্দর্য, উৎসাহ এবং আকাঙ্ক্ষা তুলে ধরেছেন। তরুণরা সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাদের শক্তি এবং উদ্দীপনা দিয়ে তারা সমাজের অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কবি কণ্ঠে তাই শুনি তারুণ্যের উচ্ছ্বাস কথন-
‘আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে
মোর মুখ হাসে মোর চোখ হাসে
মোর টগবগিয়ে খুন হাসে
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে।’
পৃথিবীর যত মহৎ কার্য সাধিত হয়েছে, বিমুক্তির দুরন্ত লিলুয়া বাতাস যত প্রান্তর ধরে প্রবাহিত হয়েছে তার প্রতিটির সাথে সংলগ্ন হয়ে আছে তরুণদের অসামান্য অবদান। সুন্দর শুভ্র ও অমিত শক্তির দ্যুতি ছড়িয়ে মহমম এক পৃথিবীর জন্ম দিতে তরুণদের এগিয়ে যেতে হবে আলোর পথে, মুক্তির পথে। বিশ্ব পরিবর্তনের চাবিকাঠি তরুণদের হাতে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) ‘গ্লোবাল এমপ্লয়মেন্ট ট্রেন্ডস ফর ইয়ুথ ২০২০’ শীর্ষক প্রতিবেদন মতে, ১৯৯৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বিশ্বে তরুণ জনগোষ্ঠী ১০০ কোটি থেকে ১৩০ কোটিতে পৌঁছেছে। আইএলও বলছে, বর্তমানে সারা বিশ্বের ১২৭ কোটি ৩০ লাখ তরুণ-তরুণী আছেন। জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিলের স্টেট অব ওয়ার্ল্ড পপুলেশন ২০২৫ এর মতে, বর্তমানে বিশ্বে ১ দশমিক ২৮৩ বিলিয়ন মানুষ ১৫-২৪ বছর বয়সী তরুণ-যুবাগোষ্ঠী, যা ২০৩৪ সাল পর্যন্ত বাড়তে থাকবে বলে জনসংখ্যা প্রক্ষেপণ নির্দেশ করছে। আর তারুণ্যের এই বিশাল অংশ কালে কালে বিশ্ব পরিবর্তনের নিয়ামক হিসেবে অগ্রণী ভ‚মিকা পালন করে চলেছে। এই যাবতকালের বিশ্বের সমস্ত বৃহৎ পরিবর্তনে, স্বর্ণালী দিন আনয়নে ও সুশোভিত সভ্যতার পথকে রক্তে-ঘামে, কর্মে ত্যাগে মহিমান্বিত করতে তারুণ্যের শক্তিই দ্রোহের অগ্নিধারা হিসেবে কাজ করেছে। দাইসাকু ইকেদা মত দিয়েছেন- ‘ইতিহাস সব সময়ই তারুণ্যের শক্তির জোরেই রূপ নিয়েছে।’ বীরকন্যা জোয়ান অফ আর্ক ১৯ বছর বয়সে পরাধীন ফ্রান্সের মুক্তিদাত্রী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তৃতীয় মোগল সম্রাট আকবর মাত্র ১৩ বছর বয়সে দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং ১৯ বছর বয়সে একচ্ছত্র ক্ষমতা প্রয়োগ শুরু করেছিলেন। তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, ক‚টনৈতিক বুদ্ধিদীপ্ততা ও সামরিক দুরদর্শিতার ফলেই ভারতবর্ষে বৃহৎ আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রথম সোপানটি গড়ে উঠেছিল। লিড ট্রটস্কি ১৯১৭ সালে মাত্র ৩৮ বছর বয়সে সেন্ট পিটার্সবার্গে সফল অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বিশ্বের প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। মিসরে গামাল আবদেল নাসের মাত্র ৩৮ বছর বয়সে রাষ্ট্রের হাল ধরেছিলেন। কিউবায় ফিদেল কাস্ত্রো ৩২ বয়সে বিপ্লবের নেতা হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তাঁর অন্যতম সহযোগী চে’ গুয়েভারার বয়স ছিল মাত্র ৩০ বছর। মুয়াম্মার গাদ্দাফি মাত্র ২৩ বছর বয়সে লিবিয়ায় রাজতন্ত্র উচ্ছেদ করে আদিম যাযাবর সমাজের পালাবদল ঘটিয়েছিলেন।
তারুণ্য জাগলেই জেগে ওঠে বিশ্ব সভ্যতা। জেগে ওঠে ন্যায়-নৈতিকতা। তারুণ্যের অনবদ্য আলোয় জ্বলে-পুড়ে ছারখার হয় অন্যায়-অবিচার আর মিথ্যার বেসাতি। আমাদের বাংলাদেশও তারুণ্যের অনাবিল বজ্রদীপ্ত শক্তিতে বলিয়ান। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর শুমারি ও গৃহগণনা-২০২৩ অনুসারে বাংলাদেশে মোট তরুণের সংখ্যা ৪ কোটি ৭৪ লাখ। অর্থাৎ দেশের মোট জনসংখ্যার মধ্যে ২৮ শতাংশ তরুণ। মোট জনসংখ্যার ৪ ভাগের ১ ভাগ এখন তরুণ, যাঁদের বয়স ১৫ থেকে ২৯ বছরের মধ্যে। জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) জানিয়েছে, ২০২৫ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যার ১৯ শতাংশ অর্থাৎ ৩ কোটি ৩০ লাখ (প্রায় ৩৩ মিলিয়ন) কিশোর-কিশোরী এবং ১০-২৪ বছর বয়সী তরুণের সংখ্যা প্রায় পাঁচ কোটি (৫০ মিলিয়ন), যা জনসংখ্যার ২৮ শতাংশ। এই ্িবশাল তরুণ জনগোষ্ঠীর বদৌলতে আগামীর বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি সবই নির্ভর করছে তরুণ সমাজের ওপর। তাই এই বিশাল তরুণশক্তিকে কাজে লাগিয়ে নতুন করে নব উদ্দীপনায় গড়তে হবে সমাজ ও দেশ। আর এই জন্য তরুণদেরকে বিকশিত হবার প্রয়োজনীয় অধিক্ষেত্র ও সুবিধাদি প্রদান করতে হবে। কবি আল মাহমুদ বলেছিলেন- ‘তরুণদের মুখ্য কাজ হওয়া উচিত ‘পড়া’। সময় পেলেই পড়তে হবে। তাহলেই জ্ঞান অর্জন হবে, জীবনে অনেক বড় হওয়া যাবে। আর সব সময় মনে রাখতে হবে, পড়ার কোনো বিকল্প নেই।’ সমাজ পরিবর্তনের জন্য তরুণদের জন্য শিক্ষা একটি মূল যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে আবির্ভ‚ত হয়। শিক্ষা মানে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও গণিত শিক্ষা। যা এই চারটি মূল শৃঙ্খলাকে একীভূত করে, বিশ্বের বাস্তব সমস্যা সমাধানের ওপর জোর দেয়। শিক্ষা সমালোচনামূলক চিন্তা ও দক্ষতা বিকাশে উৎসাহিত করে। আর এই শিক্ষার মাধ্যমে তরুণদের চিন্তা ও মননে পরমত সহিষ্ণুতা, সকলের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং দেশপ্রেমর মত মৌলিক মূল্যবোধগুলো গেঁথে দিতে হবে। জাতির মেরুদন্ড হলো শিক্ষা। ডিওজেনিস বলেছেন- ‘প্রত্যেক রাষ্ট্রেরই ভিত্তি হলো সেই রাষ্ট্রের তরুণদের শিক্ষাব্যবস্থা।’
একটি সমাজকে পরিবর্তন করতে হলে প্রথমে পরিবর্তন আনতে হয় যুবকদের মাঝে। কারণ তারা-ই ভবিষ্যতের চালক, নেতৃত্বের প্রতীক। সমাজ হতে হবে পুরোপুরি জ্ঞানভিত্তিক ও তথ্যভিত্তিক। জ্ঞানভিত্তিক সমাজ তৈরিতে এগিয়ে আসতে হবে তরুণদের। শিক্ষার সাথে নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধ অপরিহার্য। তরুণরা শিক্ষা অর্জনের পাশাপাশি নিজেরা মানবিক হবে ও মানুষের বিপদে পাশে দাঁড়াবে। প্রকৃত শিক্ষার মাধ্যমেই তরুণদের মেধার বিকাশ ঘটবে, গড়ে ওঠবে উদ্ভাবনী চিন্তাশক্তি। তাদের সাহসিকতা, নিরলস শ্রম ও সুদৃঢ় মনোভাবের মাধ্যমে ভবিষ্যতের পৃথিবীকে গড়ে তুলবে। বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তন, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে তরুণদের ভ‚মিকা অপরিসীম এবং তারা নতুন দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম। বর্তমান বিশ্বের নানা সংকট ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তরুণরা নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, উদ্ভাবনী চিন্তা ও সাহসিকতার মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তরুণদের মধ্যে অন্তর্নিহিত উদ্ভাবন এবং ঝুঁকি গ্রহণের চেতনা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে চালিত করে। তরুণদের প্রভাবে অর্থনীতির গতিধারায় পরিবর্তন ও পরিবর্ধন ঘটে। তরুণ উদ্যোক্তাদের উদ্যোগ, নবতর কর্মধারা ও পরিকল্পপনা শিল্পকে নতুন আকার দেওয়ার জন্য একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হয়ে ওঠে। যা অর্থনীতিতে জীবনীশক্তি প্রবেশ করায়, চাকরির সুযোগ তৈরি করে, সৃজনশীলতা ও স্থিতিস্থাপকতার সংস্কৃতিকে উৎসাহিত করে। তরুণরাই আগামী দিনের নেতা, উদ্ভাবক এবং সমাজ সংস্কারক। তাদের উদ্যম, সাহস এবং নতুনত্বের আকাক্সক্ষা সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রধান চালিকাশক্তি। বৈচিত্র্য, অন্তর্ভুক্তি এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রতি তরুণ প্রজন্মের প্রগতিশীল মানসিকতায় মানবিকতার শিকড় খুঁজে পায়। শুদ্ধ সাংস্কৃতিক চর্চা তরুণদের সৃজনশীলতা আর বিদ্রোহী চেতনাকে উদ্বুদ্ধ করে, যা সমাজের ক্রমবর্ধমান নীতির প্রতিফলন হয়ে ওঠে। শিল্প, সঙ্গীত এবং সাহিত্যের মাধ্যমে তরুণরা তাদের আশা-আকাঙক্ষা প্রকাশ করে। তাই বলা হয়- ‘যুব সমাজ একটি জাতির হৃদয়। তারা জেগে থাকলে জাতি বেঁচে থাকে, আর যদি তারা ঘুমিয়ে যায়, তবে জাতি ধ্বংসের মুখে পতিত হয়।’
লেখক: প্রাবন্ধিক, গবেষক ও কলামিস্ট











