মনিরুল ইসলাম মুন্না
সময় দুপুর ১২টা। সূর্য রুদ্রমূর্তি ধারণ করেছে। নগরীতে তাপমাত্রা ৩৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি। কিন্তু গরম অনুভূত হচ্ছিল এর চেয়ে বেশি। টাইগার পাস মোড়ে তীব্র গরমের মধ্যে ডিউটিরত অবস্থায় ছটফট করতে দেখা যায় ট্রাফিক পুলিশের সার্জেন্ট আহমদ আলী খানকে। হাতে একটা পস মেশিন আর একটা ‘টো স্লিপের’ বই হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। শরীরে যে সরকারি ইউনিফর্ম (পোশাক) আছে, তা ঘামে ভিজে গেছে। কিন্তু গাড়ির চাপের কারণে নড়াচড়ার সুযোগ নেই। একপাশ বন্ধ করলে অপর পাশ চালু করতে হচ্ছে।
কথা হয় ওই সার্জেন্টের সাথে। তিনি বলেন, ‘আমাদের (সার্জেন্টদের) একটা দায়িত্ব-কর্তব্য রয়েছে। সেটা আমাদের কাছে অনেক বড়। আমরা দেশসেবার জন্য শপথ গ্রহণ করেছি। এরপরও তীব্র গরমের কারণে কবে যে অসুস্থ হয়ে পড়ি তা আল্লাহ জানেন।’
গত শুক্র ও শনিবার নগরীর কয়েকটি এলাকায় কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশের সার্জেন্ট, পরিদর্শক ও সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে তাদের গরমের অনুভূতি সম্পর্কে জানা যায়। সিএমপি’র অতিরিক্ত উপ কমিশনার (মিডিয়া) মাহমুদা বেগম বলেন, ‘আমাদের কাজ করতে হবে। তবে সবাইকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। কেউ যেন অসুস্থ হয়ে না পড়েন। রাস্তার ট্রাফিক শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রচন্ড রোদে তাদের কাজ করতে হয়। তবে কিছু কিছু সময় কেউ কেউ অসুস্থ হতে পারেন। সে ক্ষেত্রে রেস্ট এবং চিকিৎসার পরামর্শ বা সুযোগ দেয়া হচ্ছে। আমাদের পক্ষ থেকে প্রতিটি ট্রাফিক বক্সে পানি রাখা হয়েছে। প্রতিটি সদস্যকে ছাতা ও সানগ্লাস সরবরাহের পাশাপাশি গরমে খাবার স্যালাইন সরবরাহ করা হচ্ছে।’
ট্রাফিক পুলিশের এসব সমস্যা নিয়ে সচেতন মহল ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন,ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা মানুষের সেবা দিতে রোদে পুড়ে গরমের মধ্যে কষ্ট করছেন এবং বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। সারাদিন ট্রাফিক পুলিশকে মোটা কাপড়ে থাকতে হয়, যেটা খুবই কষ্টকর। বিশেষ করে ট্রাফিকের জন্য সরকারের উচিত ডিউটি কমিয়ে দেওয়া অথবা তিন শিফটে ডিউটির ব্যবস্থা করা। এতে সংশ্লিষ্ট সবাই প্রশান্তি পেতেন।
ট্রাফিক পুলিশদের দাবি, তীব্র এই গরমের মধ্যে মোটা কাপড়ের ইউনিফর্ম পরে একটানা ডিউটি করতে কষ্ট হয়। ঘামে ভিজে নিরলসভাবে কাজ করতে হয় রোজ। নির্দিষ্ট সময়ের বাইরেও তপ্ত রোদে রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয় যানবাহনের চাকা। সেটা যদি যথাসময়ে না করা যায়, তাহলে সাধারণ মানুষের গালমন্দও হজম করতে হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে নগরীর একাধিক ট্রাফিক সার্জেন্ট বলেন, তীব্র এই দাবদাহে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে মাথা প্রচন্ড গরম হয়ে যায়। পায়ের জুতা পর্যন্ত গরম হয়ে যায়। অনেক সময় কানেও কম শুনি। প্রচন্ড গরমে অনেক ক্লান্ত লাগে। মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে ডিউটি করতে হয়। হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি আমাদের। তারপরও মানুষের যাতায়াতের সুবিধার কথা চিন্তা করে দায়িত্ব পালনের জন্য এই সেবা দিতে হয়। আমরা জনগণের বন্ধু হয়ে থাকতে চাই।
তারা আরও বলেন, আমাদের অনেক বক্সের পাশে কোনো শৌচালয় নেই। শৌচালয় না থাকায় প্রকৃতির ডাকে সারা দিলে কষ্টকর হয়ে পড়ে। তাছাড়া অনেক সময় ডিউটিতে থাকতে হয় বিধায় দীর্ঘ ৬-৮ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। এ কারণে আমাদের অনেক সদস্য কিডনিজনিত রোগসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত। সংশ্লিষ্টদের প্রতি অনুরোধ থাকবে, আমরা যারা সড়কে থাকি, মৌলিক বিষয়গুলো যেনো নজরে রাখেন।
সরেজমিনে কর্ণফুলী এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, কর্ণফুলী মইজ্জারটেক এলাকায় রাস্তার চারপাশ যেন আগুনে পুড়ে যাচ্ছিল। তপ্ত রোদে দাঁড়িয়ে যানবাহন নিয়ন্ত্রণে কাজ করছিলেন ট্রাফিক পরিদর্শক আবু সাঈদ বাকার। ঘামে পুরো ইউনিফর্ম ভিজে গেছে তার। পুরো শরীর থেকে ঘাম ঝরছে। তবুও দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়াননি এক মুহূর্তের জন্যও। তিনি বলেন, ‘আমাদের কাজ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই করতে হয়। বসার কোনো সুযোগ নেই। যতই গরম হোক, দায়িত্ব তো পালন করতে হবে।’
গরমে আপনাদের কোন ধরনের অসুবিধায় পড়তে হয়? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘গরমে যেন অসুস্থ না হই, এ জন্য স্যালাইন ও পানি খাচ্ছি। সবই আমাদের সিএমপি কমিশনার ব্যবস্থা করেছেন। গরম মোকাবিলার জন্য আলাদা করে একটি ছাতাও পেয়েছি। তবে শরীর অনেক সময় পেরে ওঠে না। স্বাস্থ্যগত কিছু সমস্যা তৈরি হচ্ছে অনেকের।’
গত শুক্র ও শনিবার পতেঙ্গা সি-বিচ এলাকায় কর্তব্যরত ছিলেন সার্জেন্ট মহসিন ও সার্জেন্ট আরিফুল হক। তারা টানেলের মুখে, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে এবং সি-বিচ এলাকায় যানজট নিরসনে কাজ করে যান। এসময় তারা বলেন, ছুটির দিনে এখানে দর্শনার্থী থাকে প্রচুর। গাড়িও বেশি আসে। তখন একটু জিরিয়ে নেয়ারও সুযোগ পাই না।
এ কে খান এলাকায় গিয়ে কথা হয় আলমগীর হোসেন নামে আরেক ট্রাফিক পরিদর্শকের সাথে। তিনি বলেন, ‘আমরা রাস্তায় যারা কাজ করি তাদের হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি সবচাইতে বেশি। আমরা তারপরও জনগণের কথা চিন্তা করে, আমাদের সেবার কথা চিন্তা করে রাস্তায় এই সেবা দিতে হয়।’
ট্রাফিক বন্দর বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার কবীর আহম্মেদ বলেন, ‘অতিরিক্ত গরমে ট্রাফিক সদস্যদের সতর্কতার সাথে দায়িত্ব পালন করতে পরামর্শ দেয়া হয়েছে।’
চিকিৎসকেরা বলছেন, তপ্ত রোদে একটানা কাজ করা ঠিক নয়। শরীর সুস্থ রাখতে, থাকতে হবে বিশ্রামের ব্যবস্থা।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের ডা. ইমরুল কায়সার বলেন, ‘ট্রাফিক পুলিশ সারাদিন যেভাবে কাজ করছে, প্রথমে তাদের ধন্যবাদ দিতে চাই। তবে গরমে ট্রাফিক পুলিশকে মোটা কাপড়ে থাকতে হয় যেটা আসলেই ভীষণ অস্বস্তির। তাছাড়া প্রচন্ড গরমে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের শরীর ঘেমে যায়। এ জন্য তাদের একটু পর পর পানি খেতে হবে। শুধু পানি খাওয়া নয়, মাঝে মাঝে হাত ও মুখে পানি দিতে হবে।’