সৈয়দ মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দীন
অসাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বন্ধনের দার্শনিক রমেশ বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতিতে ব্রাত্যজনের কণ্ঠস্বর। জাতে ধর্মে, কথায়- কর্মে তিনি ‘লোক’ সমাজের প্রতিনিধি। বাংলা লোকগানে তথা বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতিতে তাঁর যুগান্তকারী অবদান সত্তেও এপার – ওপার বাংলার প্রতিষ্ঠান সমূহের তাঁর প্রতি অনাগ্রহ বৈষম্য বিকাশকারী মনকে বিক্ষুব্ধ করে। বাংলাদেশের সংস্কৃতির অগ্রযাত্রায় লোককবি রমেশ শীলের ‘জীবন ও সৃষ্টির’ প্রভাব বিস্ময়করভাবে স্পষ্ট। এ স্পষ্টতার প্রেক্ষাপট হচ্ছে রমেশ শীলের মৃত্তিকা সংলগ্নতা। রমেশ শীলের একুশে পদক প্রাপ্তি আমাদের সাংস্কৃতিকর কুলীন কান্ডারীদের জাতমান। সর্বজনীন বিশুদ্ধ সাংস্কৃতিক উত্তরণের জন্য যা অপরিহার্য। রমেশ একজন দারিদ্র পরিবারের সন্তান। বাল্যশিক্ষাই তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া। পারিবারিক পেশায় ক্ষৌরকর্মে অংশ নেন। পৈতৃক ব্যবসা কবিরাজি চিকিৎসায়ও মনোনিবেশ করেন। দুসপ্তাহের মধ্যে ফল পাওয়া যাবে এমন নিশ্চয়তা দিয়ে যৌন শক্তি বর্ধন বটিকা ও মালিশের তৈলবিক্রি করতেন। এ দুটি পেশা তাঁকে মানুষের নিকট ঘনিষ্ঠজনে পরিণত করেছে। শত বছরের সাম্রাজ্যবাদী শাসন শোষণে ক্লিষ্ট চারিদিকের সমাজকে তিনি আত্মস্থ করেছেন। তাঁর গানের পরতে পরতে। তাঁর কবিগানের স্বভাবরীতি ভাষার সারল্য প্রকাশের সহজাত ভঙ্গি তাঁর গানকে আবহমান বাংলার ব্রাত্যমানুষের নিত্যদিনের কথোপকথনে পরিণত করেছে। ‘এই হইল শিক্ষা আমার প্রাইমারি পরীক্ষার ভাগ্যে না জুটিল আর’। এমন ব্যক্তিটি কিন্তু ছিলেন জাতীয় ইতিহাস সচেতন। অনেক সময়ত্র ইতিহাস চেতনা জাতীয় শান্তি অতিক্রম করেছে। ১৯৬০ সালে রচিত তাঁর দীর্ঘ কবিতা “জাতীয় আন্দোলন” তিনি ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধ থেকে শুরু করে ১৯৫৮ সালের পাকিস্তানি সাময়িক শাসন পর্যন্ত সকল ঐতিহাসিক ঘটনা নিয়েই। তিনি গান লিখেছেন। রাজনৈতিক ঘটনার পাশাপাশি বন্যা – দুর্ভিক্ষ, সাইক্লোন যা এতদঞ্চলের জীবনকে পর্যদুস্ত করেছে তা নিয়েও তিনি লিখেছেন। রাজনীতি ও অর্থনীতি নিয়ে লিখা তাঁর কবিতা ও গান স্বভাব সুলভ বাংলার গ্রামীণ সরলতা ফুটে উঠেছে। এখানে আপাতত দার্শনিকতা স্থান পায়নি কিংবা কোন রকম শিল্পিত মোর প্যাচও নেই। লাঙ্গলের ফলার মতো স্পষ্ট সুঁচালো বক্তব্য। এ বক্তব্যের টগবগে সমসাময়িকতা ছিল। ঠিক গ্রাম বাংলার কৃষক ভোটারের সরল রাজনীতি মতো, রমেশ শীল সমগ্র সৃষ্টির এক বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে আধ্যাত্মিকতা। হিন্দু গুরু সাধু পুরুষ কিংবা মুসলিম পীরের সংস্পর্শে এসে তিনি সহজ কৃষকের মতো শিহরিত হয়েছেন। তাঁর আত্মা দোল লেগেছে পরমাত্মায়। বাংলা লোকগানে মাইজভান্ডারি ধারার প্রবর্তক রমেশ। এসব আধ্যাত্মিক গানে তিনি তাঁর বিশ্বাসকে প্রস্ফুটিত করেছেন। সাধু পুরুষের পদতলে তিনি নিজেকে সপে দিয়ে প্রশান্তি লাভ করেছেন। রমেশ গণমানুষের কথা বলেছেন তাঁর গানে। তাঁর মরমী গানে ভক্তিরসের প্লাবন আনে দরগাহ আর আস্তানায়। তাঁর দেশাত্মক গান নাগরিকের চেতনাকে আজো শানিত করে। তাঁর পল্লী গান মাটি ও মানুষের কথা বলে। হাজার বছরের নিগৃহীত কৃষকের কথা বলে। শ্যামল ছায়ায়, লতাগুলো বিজড়িত অভাবের অজগর পুষে যে কৃষক কংকালসার তাঁর জীবন কবিতা রমেশের কন্ঠেরগান। এই মহান আধ্যাত্মিক সাধকের ৫৮ তম মৃত্যুবার্ষিকী একেবারে ছোট পরিসরে পালন করা হয়। বোয়ালখালীর পূর্ব গোমদন্ডীস্থ কবির সমাধি বটতলায় শুয়ে আছে আমাদের বটবৃক্ষ রমেশ। ৬ এপ্রিল রবিবার ২০২৫ রমেশের তিরোধান দিবস উপলক্ষে কবি পরিবারের পক্ষ থেকে সংক্ষিপ্ত পরিসরে সমাধির এক কোনায় একক রমেশ রচিত গান পরিবেশন করেন কবি পরিবারের সদস্য সুমন শীল। ‘বাজলো আমার হৃদয়ে বাজনা গাউছে মাইজভান্ডারি’, ‘আমার জীবন তরী কান্ডারী এক গাউছে মাইজভান্ডারি’, ‘মাইজভান্ডারির মহন বাঁশি কে বাজাইলোরে’, ‘নিশি পোহাইয়া গেল বন্ধু এলো না’, ‘মাওলানা তুইরে তুই’, ‘এই ভূবনে নাইরে তুলোনা’, ‘আমার মনে আর নাইরে ভয়’, ‘দরখাস্ত করিতে আইলাম’, ‘আমার বন্ধু যে এলোনা মনের দুঃখ গেলোনা’ গান গুলো পরিবেশন করেন। অন্নান্য বার দিন ব্যাপি নানা অনুষ্ঠান মালার মাধ্যমে রমেশ শীলকে স্মরণ করলেও এইবার একেবারে সাদামাটাভাবে এ গুনি কবিকে স্মরণ করা হয়। যেটা কবি ভক্তরা মানতে পারতেছে না। কবি পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলে জানা যায় অর্থ সংকটের কারনে তারা এই বার বড় পরিসরে রমেশ শীলের মৃত্যুবার্ষিকী উদযাপন করতে পারেনি। কবিয়াল রমেশ শীল স্মৃতি সংসদের সাবেক সাধারণ সম্পাদক বিশিষ্ট সংগঠন ও সাংবাদিক আবুল ফজল বাবুল বলেন, আমরা যখন দায়িত্বে ছিলাম তখন আমরা তিন দিন ব্যাপি রমেশ মেলার আয়োজন করেছিলাম। রমেশ রচিত গান, নৃত্য, কবিগানের আসর, বিশিষ্ট গুণিজনকে আমত্রণ করিয়ে রমেশ স্মরণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই গুণিকবি স্মরণ করা হয়। কবির জন্মবার্ষিকী আর মৃত্যুবার্ষিকী রমেশ শীলের সমাধি প্রাঙ্গণ বটতলায় আর চট্টগ্রাম শহরে মহা আয়োজনের মাধ্যমে আমরা উদযাপন করেছিলাম। বর্তমানে কর্মপরিকল্পনা অভাবে রমেশ শীলের অনুষ্ঠান এই বারের অনুষ্ঠানমালার বেহাল দশা। সরকারি বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে এই কালজয়ী লোককবি রমেশ শীলের জন্মবার্ষিকী মৃত্যুবার্ষিকী উদযাপন করার দাবি জানাচ্ছি।
হাওলা কুতুবিয়া সিনিয়র আলিম মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য বিশিষ্ট সংগঠন সাংবাদিক এস এম মোদাচ্ছের বলেন, কবি গানের লড়াই আর লোকজ সংস্কৃতি ও জীবন সংগ্রামে গ্রাম বাংলার গণমানুষের বাহক হিসেবে লোকসমাজে লোককবি হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন কবিয়াল রমেশ শীল। একদিন শ্রোতার কাতারে বসে দেখছেন কবিগান। এরি মধ্যথেকে মঞ্চে উঠে দক্ষ কুশলি কবিয়াল মোহন বাঁশির সঙ্গে দীর্ঘ ১৮ ঘণ্টা লড়াই করে নিজেও কবিয়াল বনে যায়। এর পরের গল্প রীতিমত ইতিহাস। আরো বলেন মনুষ্যত্ব না থাকলে অর্থাৎ মানুষ মানুষকে ভাল না বাসলে সংস্কৃতি চর্চা হয় না। রমেশ শীল আত্মচিন্তা, সচেতনতা ও অসাম্প্রদায়িক চিন্তা চেতনায় গণমানুষের জয়গান গেয়েছেন। তিনি ধনী – দরিদ্র, কৃষক – মজুর, শ্রমিক – মালিক ও সাম্য মৈত্রী জনজাগরণের মাধ্যমে মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছিলেন। তাই তিনি আজ জাতীয় লোককবি। অধিকার এবং অর্থ – দুই সংস্কৃতি চর্চার নিয়ামক। পরে পদ লেহনকে সংস্কৃতি চর্চা বলা যায় না। রমেশ স্বকীয়তায় নিজস্ব সংস্কৃতি শেকড়কে তুলে এনেছে। তিনি শুধু বোয়ালখালী বা চট্টগ্রামের কবি নন, তিনি উপমহাদেশের কিংবদন্তি লোককবি। প্রাইমারি স্কুল পাশ করেও রমেশ লিখে গেছেন কালজয়ী অসংখ্য কবিতা – গান। উচ্চ শিক্ষিত হলে সমগ্র জগৎ জয় করতেন। তথ্য প্রযুক্তির উৎকর্ষতার সাথে রমেশ শীলকে নিয়ে যেতে হবে অনেক দুরে। বিশ্বের গণমানুষের দোর গোড়ায় রমেশ শীলের সৃষ্টি কর্ম নিয়ে ব্যাপকভাবে গবেষণা ও জাতীয়ভাবে স্বীকৃতি প্রদানের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান। রমেশের তিরোধান দিবস দেখতে আসা এক ভক্ত দর্শনার্থী বলেন, আজকের এ আয়োজন ক্ষুদ্র পরিসরে হওয়াই আমি মনঃক্ষুণœ হয়েছি। রমেশের মৃত্যুর এতবছর পরেও আমরা রমেশকে তাঁর উপযুক্ত আসনে নিয়ে যেতে পারিনি। এটা আমাদের ব্যর্থতা। এর দায় আমাদের সকলকে নিতে হবে। রমেশ পরিবারের নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন বলেন, রমেশ পরিবারের দ্ব›েদ্বর আর আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে এ বছর রমেশের তিরোধান দিবসের বেহাল দশা। তিনি আরো বলেন, রমেশ শীলের ৪০ জনের মত নাতি আছে সকলে যদি ১০০০ টাকা করে দিত তাহলে আজকে রমেশের অনুষ্ঠানটি সুন্দর করে করা যেত। ভক্তরা এসে তেমন কোন অনুষ্ঠান না দেখে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এ অনুষ্ঠান জাতীয়ভাবে সরকার রাষ্ট্রের উদ্যোগে আয়োজনের প্রয়োজন ছিল। যদি বাংলাদেশ সত্য, মাটি সত্য এবং রমেশ যদি একজন বাঙালির মনে নাড়া দিতে পারে তাহলে একদিন দেশব্যাপী এ অনুষ্ঠানের ব্যাপকতা ছড়িয়ে পড়বে।
লেখক : সংগঠক ও প্রাবন্ধিক