ড. মোঃ রফিকুল ইসলাম
বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হয়েছে। এ যুগের সাথে পাল্লা দিয়ে দুর্বার গতিতে বাংলাদেশ এগিয়ে চলছে। আর প্রযুক্তি দিক থেকেও বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে রয়েছে। বর্তমানে দেশে ফোরজি চালুর পর সম্প্রতি বাংলাদেশের ফাইভজির উপর পরীক্ষামূলক পর্যালোচনা সম্পন্ন করা হয়েছে। সুতরাং বাংলাদেশ অতি দ্রূত ফাইভজির জগতে পদার্পণ করতে যাচ্ছে। একদিকে প্রযুক্তির বদৌলতে বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়ে যাচ্ছে। যা মানুষের অসচেতনতার কার্যকলাপের কারণে তা বিপরীত প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখা দিয়েছে।
বিশেষ করে অপরিকল্পিত নগরায়ণ, শব্দ-বায়ু-দূষণ ও লক্কর-ঝক্কর গণপরিবহনের কারণে এমনিতেই যেন শ্রীহীন রাজধানী ঢাকা শহর। এর মধ্যে নগর জুড়ে তারের জঞ্জালে হচ্ছে দৃশ্য দূষণ। তাই একটি দৃষ্টিনন্দন আধুনিক নগরী গড়ার ক্ষেত্রে ঝুলন্ত তার কিন্তু ব্যাপক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। যা শহরের অপরিকল্পিত ও সমম্বয়হীনভাবে সম্প্রসারিত বিভিন্ন সেবা সংস্থার ঝুলন্ত তারের কারণে প্রায়ই বিভিন্ন সময় দুর্ঘটনা ঘটছে। অর্থাৎ ঢাকা শহরে বিদ্যুতের লাইনের পাশাপাশি ডিশ, ইন্টারনেট ও টেলিফোনের ক্যাবল যত্রতত্র জায়গায় ছড়িয়ে রয়েছে। এছাড়া বাসা-বাড়ির জানালার পাশে কিংবা রাস্তার উপরে ডিশ, টেলিফোন, ইন্টারনেটের ক্যাবল ও বিদ্যুতের তার পেঁচিয়ে ভয়ঙ্কর এক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। যা বাসা থেকে বেরোলেই অলিগলি কিংবা পথে এসব সঞ্চালন লাইনের রাজত্ব। অনেক সময় দেখা যায় যে, পুরনো ক্যাবল বা তারে ক্রটি দেখা দিলেও সেগুলো না সরিয়ে নতুন তার লাগিয়ে দিচ্ছে। এতে করে তারের তৈরি জঞ্জাল দিন দিন বেড়েই চলছে। এর ফলে ফুটপাত দিয়ে চলতে-ফিরতে মাথার উপর ঝুলে থাকা জটলা পাকানো তার চোখকে স্বস্তি দেয় না। এ জটলা তারের ভারে বিভিন্ন স্থানে নুয়ে পড়ছে বৈদ্যুতিক ও সড়ক বাতির খুঁটি। তাছাড়া প্রায় প্রতিটি এলাকার বৈদ্যুতিক খুঁটির গায়ে টিনের তৈরি কতগুলো বক্স বিদ্যমান রয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে ডিশ বা ইন্টারনেটের সিগনাল এমপ্লিফায়ার। তবে এ ডিশ বা ইন্টারনেট ব্যবসায়ীরা কিন্তু সিগনাল এমপ্লিফায়ারের বৈদ্যুতিক সংযোগ সরাসরি বিদ্যুতের মেইন লাইন থেকে নিয়েছে। যা বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে কোনো ধরনের অনুমতি নেওয়া হয়নি। এর ফলে অবাধে বিদ্যুৎ চুরি হচ্ছে। এর সাথে জড়িত রয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগের একশ্রেণি দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারিরা। এ কারণে জাতীয় গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ চুরির কোনো তথ্য বিদ্যুৎ বিভাগে নেই। ফলে বিদ্যুৎ বিভাগকে প্রতিবছরই কোটি কোটি টাকা লোকসান দিতে হচ্ছে। আর এর ভতুর্কি দিচ্ছে আপাময় সাধারণ জনগণ। এজন্য বিদ্যুৎ বিভাগের কোনো ধরনের মাথা ব্যথা নেই। এর প্রধান কারণ জবাবদিহির বড় অভাব। এছাড়াও অনেক সময় সিগনাল এমপ্লিফায়ার অবৈধ সংযোগ লাইনের ক্রটির কারণে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট হয়ে অগ্নি ও বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার নষ্ট হওয়ার মতো অনাকাক্সিক্ষত দুর্ঘটনা ঘটছে। এমনকি প্রাণহানি ঘটনার নজিরও রয়েছে। এক্ষেত্রে একদিকে যেমন ঝুঁকিপূর্ণ অন্যদিকে নগরের অন্যান্য সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ ম্লান হয়ে যায়। অর্থাৎ ঢাকার শহরের সৌন্দর্য হানি হচ্ছে। কাজেই এ তারের জঞ্জাল থেকে সহসা নগরবাসীর মুক্তি মিলছে না। উল্লেখ্য যে, ক্যাবল অপারেটর ও ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার (আইএসপি) প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে প্রত্যাশিত সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না বলে এখনও ক্যাবল অপসারণ করা সম্ভব হচ্ছে না। এর সাথে ন্যাশনওয়াইড টেলিকমিউনিকেশন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক (এনটিটিএন) এর অপারেটরদের প্রযুক্তিগত দুর্বলতাও রয়েছে। এছাড়াও ডিশ অপারেটর ও আইএসপিদের কাছে এক ধরনের জিম্মি সরকারি এ সংস্থাগুলো। আবার ক্যাবল অপারেটর ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সহযোগিতা না পাওয়ার ফলে মাটির নিচ দিয়ে লাইনগুলো নেওয়াও সম্ভব হচ্ছে না। তবে সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তারা বিভিন্ন সময় ক্যাবল অপারেটরের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করার পরও আশানুরুপ কোনো অগ্রগতি হয়নি। এখানে প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ ডিশ সংযোগ, টিভি এন্টেনা ও ইন্টারনেট ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু পরিকল্পিত উপায়ে ব্যবহারের কোনো চিত্র এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তবে সিটি কর্পোরেশনের তথ্য অনুযায়ী বৈদ্যুতিক সংযোগ বাদে ইন্টারনেট সংযোগের ব্রডব্যান্ড লাইন ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ, ক্যাবল নেটওয়ার্ক ১৫ থেকে ২০ শতাংশ ও অন্যান্য তার ১০ থেকে ১৫ শতাংশ রয়েছে। তথাপি নগর জুড়ে যখন আধুনিকতা আর উন্নয়নের ছোঁয়া সেখানে দীর্ঘদিন ধরে ঝুলতে থাকা এসব তার বড়ই দৃষ্টিকটূ। আর রাজধানীতে অগ্রিসংযোগ হলেও অত্যাধুনিক টার্ন টেবিল থাকা সত্তে¡ও সড়কে ছড়িয়ে থাকা তারের জঞ্জালের কারণে ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তা-কর্মচারিরা আটকেপড়াদের সহজে উদ্ধার করতে পারে না। এর মূল কারণ নগরে মাকড়সার জালের মতো এ তারের জঞ্জাল যেনো নগরবাসীদের গলার কাঁটা। অন্যদিকে ঘনত্বের দিক থেকে ঢাকা শহর বাংলাদেশের অন্যতম। অর্থাৎ ঢাকা শহরের অতিরিক্ত জনসংখ্যার বসবাস। এসব সমস্যার ফলে ক্যাবল বিভিন্ন সময়ে অপসারণ নিয়ে কথা হলেও বছর পর বছর ধরে এর কোনো অগ্রগতি নেই। এক্ষেত্রে দায়িত্ব প্রাপ্ত কর্তা ব্যক্তিরা একে অপরকে দোষারুপ করে আসছে। এজন্য ঝুলন্ত জঞ্জাল এখনও দূর করা সম্ভব হচ্ছে না। এতে পথচারীদের চরম ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। এসব তারের কারণে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে সড়কের দামি বৈদ্যুতিক খুঁটি ও সড়ক বাতি। তবে যদি দেশের বাইরের মতো বাংলাদেশের সকল জেলায় মাটির নিচ দিয়ে সকল ধরনের লাইনগুলো বসানো যেতো। সেক্ষেত্রে আপাময় জনগণ উপকৃত হতো।
বিশেষ করে গত এক দশক ধরে তারের জঞ্জাল সরানোর জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা ও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর প্রেক্ষিতে বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা সম্প্রসারণ ও শক্তিশালীকরণ শীর্ষক একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ ক্যাবল নেটওয়ার্ক তৈরি করে রাজধানীর একটি বড় অংশের বিদ্যুৎ সরবরাহ করার পরিকল্পনা করা হয়। এ লক্ষ্যে ন্যাশনওয়াইড টেলিকমিউনিকেশন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক (এনটিটিএন) প্রকল্পের আওতায় দু’টি প্রতিষ্ঠান ফাইবার আট হোম ও সামিট কমিউনিকেশনকে মাটির নিচে তার সরিয়ে অবকাঠামো স্থাপনের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ সংস্থাগুলো ভূগর্ভস্থ ফাইবার অপটিকসের সঙ্গে যুক্ত করে নগরবাসীদের সেবা দিবে। তবে এর মধ্যে বেশ কিছু এলাকায় বৈদ্যুতিক লাইন মাটির নিচ দিয়ে নেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে ক্যাবল সংযোগ ও ঝুঁকিপূর্ণ জনজীবন দুর্ঘটনা বড় আকার ধারণ করার আগেই শতভাগ তার ভূগর্ভস্থে স্থানাস্তর করতে হবে। এছাড়া এর বিকল্প হিসেবে ওয়্যারলেস সংযোগের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। বিশেষত রাজধানীতে ঝুলে থাকা বিদ্যুৎ, ডিশ ক্যাবল, ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার, মোবাইল কোম্পানি ও বিটিসিএলের ল্যান্ড ফোনের তারসহ সব ধরনের তার মাটির নিচে বসানো জরুরি। এর ফলে উন্নত বিশ্বের বড় বড় শহরের মতো ঢাকা শহরকে উন্নত করা সম্ভব হবে। এতে করে একটি দৃষ্টিনন্দন আধুনিক নগরী গড়ার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে। ফলে শহরের মূল সৌন্দর্য ফিরিয়ে আসবে। বিশেষ করে দেশের পেশিশক্তি ও বিদ্যুৎ বিভাগের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারিদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে হবে। অর্থাৎ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সে সাথে বিদ্যুৎ চুরি রোধ করতে হবে। এর ফলে নিরবচ্ছিন্নভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। সর্বোপরি, দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রকল্পের কাজগুলো সম্পন্ন করার জোড় দাবি করছে নাগরিক সমাজ। এ সকল বিষয় উত্তরণের জন্য সিটি কর্পোরেশনকে উদ্যোগ নিতে হবে। এর ফলে পরিকল্পিত ও বিশ্বমানের নগরায়ণ গড়ে তোলা সম্ভব হবে। এতে নগরবাসীদের দীর্ঘদিনের দাবি পূরণ হবে।
লেখক : গ্রন্থাগার বিভাগের প্রধান,
সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, চট্টগ্রাম