ড. মুহাম্মদ ইউনূস ম্যাজিক : কূটনীতিতে চালকের আসনে বাংলাদেশ

0

জসিম উদ্দিন মনছুরি

ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিশ্বব্যাপী সর্বজন স্বীকৃত শিক্ষাবিদ ও সম্মানীয় একজন মানুষ এটা সবার জানা কথা। পাঁচ আগস্ট পরবর্তী বাংলাদেশের ক্রান্তিলগ্নে ড.মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পদ গ্রহণ করেন। ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতনের পর দেশের সংকটময় মুহূর্তে তিনি ক্ষমতা গ্রহণ করে দেশকে অরাজকতার হাত থেকে রক্ষা করেন। ছাত্র জনতার দুর্বার আন্দোলনে ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতনের ফলে দেশে নেতৃত্বের শূন্যতা সৃষ্টি হয়। অরাজক পরিস্থিতিতে ক্ষমতা গ্রহণ করে ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশের মান বাঁচিয়েছেন। আওয়ামী সরকার ক্ষমতা থাকাকালীন ও ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর একের পর এক ইস্যু তুলে দেশকে অরাজকতার দিকে ঠেলে দিতে চেয়েছিল। সব বিশৃঙ্খলা কঠিন হস্তে দমন করে তিনি দেশকে সুশৃঙ্খল পরিস্থিতির দিকে ধাবিত করেন। যদিও পতিত আওয়ামীরা একের পর এক অজুহাতে দেশকে বিশৃঙ্খলতার দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য পাঁয়তারা করে আসছে। এই সংকটময় মুহূর্তে ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশের জন্য ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হন। তাঁর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে সকল বিশৃঙ্খলা দূরীভূত করে দেশকে শান্তির দিকে নিয়ে গেছেন অবলীলাক্রমে। ভঙ্গুর অর্থনীতিতে বাংলাদেশ যখন বিপর্যস্ত তখন তিনি অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে তোলেন। তাঁর ক্ষমতা গ্রহণের মাত্র আট মাসের মাথায় রিজার্ভে দেশ সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে পঁচিশ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক স্পর্শ করে। দ্রব্যমূল্যের লাগাম ঠেনে ধরে তিনি সকল কালোবাজারি ও মজুদদারদের সিন্ডিকেটকে চরম ভাবে আঘাত হানেন। সাম্প্রতিক শেষ হওয়া রমজান মাসে দ্রব্যমূল্যের নাকাল পেতে হয়নি জনগণকে। এর আগের বছরগুলিতে রমজান আসলেই যেন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে দিশেহারা হয়ে যেত জনগণ। সিন্ডিকেটের কবলে পরে জনগণ বিপর্যস্ত হতো। এবারের রমজানে জনগণ দারুণভাবে স্বস্তি পেয়েছে। স্বাভাবিক বাজারদর, সুশৃঙ্খল পরিবেশ ও লোডশেডিংমুক্ত রমজান উপহার দিয়েছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস এর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। ফলে দেশের জনগণ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছে এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রয়োজনীয়তা দারুণভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছেন।
বিশেষ করে কূটনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান ছিলো নতজানু প্রকৃতির। বিগত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নতজানু পররাষ্ট্রনীতির কারণে বাংলাদেশ চরম পর্যায়ে পৌঁছেছিলো। রোহিঙ্গা ইস্যু , সীমান্ত ইস্যু , ফারাক্কার পানি বন্টন চুক্তি ইত্যাদি সমস্যা দীর্ঘদিনের সমস্যা। এই সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের জন্য ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতিসংঘ মহাসচিব এন্তেনিও গুতরেচকে আমন্ত্রণ জানান বাংলাদেশে আসার জন্য। বাংলাদেশে এসেই অন্তেনিও গুতরেচ রোহিঙ্গাদের সাথে ইফতার করেন। ড. মুহাম্মদ ইউনূস রোহিঙ্গা ভাষায় বক্তব্য দিয়ে সবার মন আকৃষ্ট করেন। তিনি রোহিঙ্গাদেরকে আশ্বস্ত করেন, তারা যেন আগামী বছর তাদের দেশে গিয়ে ঈদ উদযাপন করতে পারেন। কথা যেমন কাজও তাই। সা¤প্রতিক বিমেস্টেক সম্মেলনে মায়ানমারের উপপ্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশকে জানান তারা প্রথম ধাপে এক লক্ষ আশি হাজার রোহিঙ্গাকে তাদের দেশে প্রত্যাবর্তনে ইচ্ছুক। রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের সমস্যা হলেও কোন রাষ্ট্রপ্রধান তার কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেননি বলে রোহিঙ্গা সমস্যা রোহিঙ্গা সমস্যাই রয়ে যায়। অথচ ড মুহাম্মদ ইউনূস ক্ষমতা গ্রহণের ৮ মাসের মাথায় রোহিঙ্গাদের নিয়ে বিশাল সুখবরটি দিলেন। এতদিন বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক ছিল রাজা ও ভৃত্যের সম্পর্ক। ড. মুহাম্মদ ইউনূস ক্ষমতা গ্রহণ করে ভারতকে সাফ জানিয়ে দেন সকল সম্পর্ক হবে ন্যায্যতা ও সমতার ভিত্তিতে। এ জন্য ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্কের টানা পোড়েন দেখা দেয়।
সাম্প্রতিক থাইল্যান্ডে বিমেস্টেক সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও ড, মুহাম্মদ ইউনূস এর মধ্যে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা হয়। আলোচনায় ড. মুহাম্মদ ইউনূস নরেন্দ্র মোদীকে স্পষ্ট ভাষায় খুনি শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে ফেরত চান। আরো জানিয়ে দেন ফারাক্কার পানি বন্টন চুক্তি সমাধান করতে হবে এবং সীমান্ত হত্যা বন্ধ করতে হবে। যদিও এর আগে ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এর মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক ও আলোচনার মধ্যে বিবিধ বিষয় স্থান পায়। তন্মধ্যে ফারাক্কার স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের কথাটি সর্বাগ্রে অগ্রাধিকার পায়। অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিকভাবে চীনের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপিত হলে ভারতের টনক নড়ে। ভারত এতদিন শেখ হাসিনাকে ভৃত্যের চেয়ারে বসিয়ে যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা আদায় করে নিয়েছিল। কিন্তু ড. মুহাম্মদ ইউনূস ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর ভারতের সাথে সম্পর্কের টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়। ভারতের নেতাদের উদ্ভট কথাবার্তা ও বাংলাদেশ বিরোধী প্রোপাগান্ডায় বাংলাদেশের জনগণ ভারতের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়েন। বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে ভারত বিরোধিতা তুঙ্গে উঠে। ভারতের স্বেচ্ছাচারীতা এবং সীমান্ত হত্যা, সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া প্রদান ও পানি বন্টন চুক্তির অন্যায্যতায় জনগণ ভারতের বিরুদ্ধে ফোঁসে ওঠে। তাছাড়া অসম বাণিজ্য ঘাটতি। ভারতের সুবিধা প্রদানের জন্য বিগত ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ট্রানজিট প্রদান বাংলাদেশের জনগণকে মর্মাহত ও ব্যতীত করেছে। বাংলাদেশের যোগ্য প্রতিনিধি ড. মুহাম্মদ ইউনূস জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়ে ভারতের সাথে ন্যায্যতার ভিত্তিতে সম্পর্ক উন্নয়নে আগ্রহী বলে সাফ জানিয়ে দেন। ভারতের চোখে চোখ রেখে কথা বলাকে নরেন্দ্র মোদী সরকার কোনভাবেই মেনে নিতে পারেনি। কিন্তু কূটনীতির চালে পরাজিত হয়ে অবশেষে ড. মুহাম্মদ ইউনূস এর সাথে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করতে বাধ্য হয়। সাম্প্রতিক সময়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কূটনীতি বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হচ্ছে এবং কূটনীতির চালে ভারত পরাভূত হয়। দেশে-বিদেশে ড.মুহাম্মদ ইউনূসের সুযোগ্য নেতৃত্ব প্রশংসিত হয়ে আসছে। সাম্প্রতিক সময়ে ঈদের জমাতের সময় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে সাধারণ মানুষের কথোপকথন ও আগ্রহ চোখে পড়ার মতো। সাধারণ জনগণের অনুরোধ তিনি যেন অন্তত পাঁচটি বছর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকেন। ড. মুহাম্মদ ইউনূস যেভাবে দেশকে অর্থনীতি ও সুশৃঙ্খলতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন এভাবে তিনি আর কিছুদিন ক্ষমতায় থাকলে হয়তো অচিরেই বাংলাদেশ সিঙ্গাপুর কিবা মালয়েশিয়া হতে বেশিদূর নয়। তিনি দেশের জনগণের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি দুর্নীতিমুক্ত ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট রয়েছেন। দেশের অধিকাংশ জনগণ তার গৃহীত পদক্ষেপ ও দেশ পরিচালনায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। দেশের জনগণ চায় বাংলাদেশকে পৃথিবীর কাছে রোল মডেল হিসেবে গড়ে তুলতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে প্রয়োজন যথাযথ সংস্কার।
সংস্কার বিনে নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা কখনো সম্ভবপর নয় বলে বোদ্ধামহলের ধারণা। ইতোমধ্যেই তিনি বিভিন্ন কমিশন গঠন করে সংস্কারের রোডম্যাপ জনসমক্ষে ও রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে প্রেরণ করেছেন। আশা করি অধিকাংশ জনগণের মতামতের ভিত্তিতে সংবিধান সংস্কারসহ গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার শেষে সবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন সম্পন্ন করা সম্ভব হবে। এরই মধ্যে পতিত স্বৈরাচারের দোসররা দেশে অরাজকতা সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে। তাদেরকে কঠিন হস্তে দমন করে আইনের আওতায় এনে কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করা সময়ের প্রত্যাশিত দাবি।তার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও কূটনৈতিক দক্ষতায় বাংলাদেশ বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে এমতই প্রত্যাশা বাংলাদেশের সকল জনগণের। বাংলাদেশ দীর্ঘজীবী হোক, দীর্ঘজীবী হোক ড. মোহাম্মদ ইউনূস।
লেখক : প্রাবন্ধিক