রশীদ এনাম
আমাকে যদি প্রশ্ন করা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর কি ? আমি উত্তরে বলব প্রথমে শিশু, ২য় শিশু এবং ৩য় শিশু। শিশু এবং বাগানের ফুলের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। ফুল হাসলে যেমন পুরো বাগান হেসে উঠে, ঠিক তেমনি শিশু হাসলে পুরো পৃথিবী হেসে উঠে। শিশুবিহীন ঘর মানে জেলখানা কিংবা মরুভূমি। শিশুদের মনের যতœ কি আমরা নিতে পারছি, প্রকৃতিবান্ধব খেলার মাঠ রাখছি। গত বছরে কিছুদিন আগেও রাজধানীতে খেলার মাঠ রক্ষার জন্য দেশের সম্ভাবনাময়ী ফুলের মতো শিশুদেরকে তাঁদের পিতামাতাকে রাস্তায় নেমে মানববন্ধন করতে হয়েছে।
পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো গ্রাম সুন্দর শহরের নাম কি যদি প্রশ্ন করা হয় ? যে কেউ বলবে চট্টগ্রাম। এ শহরের রয়েছে প্রাচীন ইতিহাস চাটগাঁ শহরের বয়স প্রায় পাঁচ হাজার বছর। সৃষ্টিকর্তার পরম যতেœ বড়ো আদর করে তুলির স্পর্শে অপরূপা সৌন্দর্যরানী চট্টগ্রামকে ঢেলে সাজিয়েছেন। পাহাড়, নদী, দরিয়ানগর বেষ্টিত দেশের প্রবেশদ্বার চট্টগ্রাম। এই শহরে আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমিয়ে পড়ে। সবুজ অরণ্যরাণীতে পশু পাখির অভয়ারণ্য। দেশের বাণিজ্য রাজধানী চট্টগ্রাম। দেশের সিংহভাগ আয় চট্টগ্রাম থেকে আসে। চট্টগ্রামের উন্নয়ন মানে সমগ্র দেশের উন্নয়ন। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন, ৫২ ভাষা আন্দোলন, ৭১-র স্বাধীনতা আন্দোলন, স্বাধীনতার ঘোষণা, স্বৈরাচার আন্দোলন প্রত্যেকটি সূচনা কিন্তু চট্টগ্রাম থেকে। এ জন্য বোধহয় একদা মহাত্না গান্ধী (মোহন দাশ করমচাঁদ) বাংলাদেশ সফর করতে এসে চট্টগ্রাম কে নিয়ে উচ্ছ¡সিত প্রশংসা করতে গিয়ে বলেছিলেন, Chittagong to the fore- চট্টগ্রাম সর্বত্রে এগিয়ে।
“ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে আকাশ আলোর আমরা সুত, নূতন বাণীর অগ্রদূত কতই কি যে করবো মোরা, নাই কো তার অন্তরে”! কবি গোলাম মোস্তফার লেখা কবিতাটির ভাব সম্প্রসারণ আমরা ইশকুলবেলায় পড়ে এসেছি। কবি বুঝাতে চেয়েছেন, শিশুরাই জাতির ভবিষ্যৎ অথচ আগামী প্রজন্মদের জন্য আমরা একটু ভাবছি না। খুব দুঃসময় চলে এসেছে আজ, শিশুদের কাছ থেকে আমরা জ্ঞান কেড়ে নিয়েছি তুলে দিয়েছি যন্ত্র, প্রকৃতি কেড়ে নিয়েছি, খেলার মাঠ গ্রাস করে নিয়েছি, একান্নবর্তী পরিবারের ভালোবাসা কবর হয়েগেছে অনেক আগে। চারিদিকে শুধু আত্মকেন্দ্রীকতা অস্থিরতা চলছে। কবি রবী ঠাকুর লিখেছিলেন, “এ জগতে হায় সে বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি”। চারিদিকে অসুস্থ প্রতিযোগিতা। আহা শিশু ! শিশুদের কথা আমরা ভাবছি না। কথাসাহিত্যিক আহমদ ছফা বলেছিলেন, “আমরা এমন এক যুগে বাস করছি, যখন রক্ত দিয়েই চিন্তা করতে বাধ্য হচ্ছি। চারিদিকে অন্যায়, অবিচার, এত মূঢ়তা ও কাপুরুষতা ওঁৎ পেতে আছে যে, এ ধরনের পরিবেশে নিত্যন্ত সহযে বোঝা যায়। এমন সহজ কথাও চেঁচিয়ে না বললে কেউ কানে তোলে না”।
চট্টগ্রাম শহরে ব্যাঙের ছাতার মতো অপরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে স্থাপনা। চট্টগ্রামে ড্রেনেজ ব্যবস্থা খুবই খারাপ । কত জনপ্রতিনিধি এলোগেলো কেউ কথা রাখেনি। বর্ষা মৌসুম এলে জন দুর্ভোগের শেষ থাকে না। একুট বৃষ্টি হলে পানিতে টইটম্বুর। নগরীর রাস্তা-ঘাটে আমরা দেখি মানুষের কাপড়-চোপড় হাটুর উপরের তুলতে তুলতে বিপদ সীমার উপরে তুলে ফেলতে হয়। যাদের বসবাস নিচতলায় দেখা যায়, বর্ষামৌসুমে মানুষের সাথে সাথে সোনা ব্যাঙ, কুনো ব্যাঙ ও খাটের উপরে চলে আসে। মানুষের কাতা কম্বলে প্রবেশ করে ব্যাঙ।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকায় বিশেষ করে শহরের মাঝখানে ও আশে পাশে উন্মুক্ত নালা নর্দমা রয়েছে প্রচুর। প্রায় ৫ হাজারের ও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ স্থান চিহ্নিত করা হয়েছে যার দৈর্ঘ প্রায় ১০ হাজার ২৩৪ মিটার। নগরীর ৪১টি ওয়ার্ডে নালা-নর্দমায় কয়েক হাজার মরণফাঁদ রয়েছে। প্রতি বছর নালা নর্দমায় পড়ে শিশু থেকে বয়স্ক লোক পর্যন্ত পানিতে তলিয়ে যায়। সম্প্রতি নগরের কাপাসগোলা এলাকায় মায়ের কোলে থাকা ছয় মাস বয়সি শিশু সেহরিশসহ তিনজন ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা খালে পড়ে যায়। শিশুটি মা ও তাঁর আত্মীয় খাল থেকে উঠে এলেও সেহরিশের লাশ পাওয়া যায় পরদিন চাকতাই খালে।
এ ঘটনা নতুন নয়। প্রতি বছর ধারবাহিকভাবে ঘটছে। গত বছর দুয়েক আগে পাহাড়তলী ফতেপুর ইসলামী হাট সংলগ্ন বাদামতলা এলকায় নালায় পড়ে নিপা নামে এক কলেজ ছাত্রী, ২০২১ সালে চশমা খালে অটোরিকশাচালক ও এক যাত্রীর মৃত্যু হয়। গত বছর দুয়েক আগে আগ্রাবাদে রঙ্গিপাড়ায় ড্রেনে পড়ে শিশু মৃত্যুও খবর আমরা দেখেছি। ২০২১সালে মুরাদপুর এলাকায় সবজি বিক্রেতা ছালেহ আহমেদ পা পিছলে পড়ে তলিয়ে যান । বয়স্কলোকটির মরদেহ পাওয়া যায়নি। একই খালে কামাল উদ্দিন নামে এক শিশু পড়ে গিয়ে মারা যান। আগ্রাবাদ মাজারগেট এলাকায় ফুটপাত পা পিছলে নালায় পড়ে মৃত্যু হয় বিশ^বিদ্যালয় ছাত্রী শেহেরীন মাহমুদ সাদিয়ার। গত ২০২৩ সালে নগরীর ডবলমুরিং থানা সিডিএ আবাসিক এলাকায় খালে নেমে নিখোঁজ হয় আবদুল্লাহ(৫) পরদিন তার মৃতদেহ পাওয়া যায়। নগরী চাক্তাই খালে দুই শিশু নিখোঁজ হয়। একজন গোসল করতে নামলে পানির স্রোতে ভেসে যাওয়ার সময় অন্য আরেকজন তাঁকে বাচাতে লাফ দেন তার বন্ধু।
পরে দুজনই নিখোঁজ হয়। আগ্রাবাদ এলাকায় জসিম নামে সাত বছর বয়সী এক শিশু খালে পড়ে মারা যায়। আছাদগঞ্জের কলাবাগিচা খালে পড়ে এক যুবকে মৃত্যু হয়। এক পরিসংখ্যানে দেখাগেছে গত চার বছরে চট্টগ্রামে নগরীর নালা ও খালে পড়ে অন্তত ১৩ জনেরও বেশি মৃত্যু হয়েছে।
চট্টগ্রামের সিটি কর্পোরেশনের মাননীয় মেয়র মহোদয় প্রতিমন্ত্রী মর্যাদা পেয়েছেন এটা চাটগাঁবাসীর জন্য আনন্দের সংবাদ অভিনন্দন ও লালগোলাপ শুভেচ্ছা আপনাকে। আপনার প্রতি আমাদের সবিনয় নিবেদন। চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতাদূর করনের জন্য জরুরিভিত্তিতে চট্টগ্রামের নগরপরিকল্পনাবিদ ও প্রকৌশলীসহ সহ সিটি কর্পোরেশনের সকল কর্মকর্তাদের আপনি দিকনির্দেশনা দিন প্লিজ। বর্ষামৌসুম শুরু হওয়ার আগে চাটগাঁবাসীর জন্য এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। আমাদের প্রত্যাশা চট্টগ্রাম আপনার শেকড় আপনার হাত ধরে চট্টগ্রাম এগিয়ে যাবে। আমাদের বিশ্বাস চট্টগ্রামের নগরীর প্রতি আপনার ভালোবাসার হাত প্রসারিত করতে কখনো কৃপণতা করবেন না। সেহেরিশের মতো আরেকটি শিশুও যেন অকালে ঝরে না যায়। চট্টগ্রাম নগরীর যে সমস্থ নালা, খাল বেদখল হয়ে আছে তা উদ্ধারকরত এবং যে সমস্ত খোলা ড্রেন বিপদজনক অবস্থায় রয়েছে প্রত্যেকটি খাল ও ড্রেন চিহ্নিত করে এবং খোলা ড্রেনের উপর স্লেপ স্থাপনসহ এবং খালের দু পাশে রেলিং এর ব্যবস্থা করার জরুরি। মাননীয় সিটি মেয়র মহোদয়ের প্রতি সু দৃষ্টি কামনা করছি।
লেখক : প্রাবন্ধিক