এম এ হোসাইন
‘পানির অপর নাম জীবন’ হলেও, চট্টগ্রামে বোতলজাত ও জার পানির নামে চলছে ভয়ংকর প্রতারণা। নোংরা পানি পরিশোধন ছাড়াই বোতলজাত করে ‘ড্রিংকিং ওয়াটার’ নামে বিক্রি করছে বহু অসাধু প্রতিষ্ঠান। তদারকির অভাবে যত্রতত্র গড়ে ওঠা এসব কারখানায় তৈরি পানি পান করে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে নগরবাসীর। প্রতিদিন হোটেল, রেস্তোরাঁ, অফিস, বাসাবাড়ি, এমনকি বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও ব্যবহৃত হচ্ছে এসব ভেজাল পানি। নগরে প্রায় একশটির মতো বোতলজাত পানির কারখানা রয়েছে, যাদের অধিকাংশই তদারকির বাইরে।
স¤প্রতি বাকলিয়া থানাধীন এক্সেস রোড এলাকায় ‘ইভাইন ড্রিংকিং ওয়াটার’ নামক একটি প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালায় জেলা প্রশাসন ও বিএসটিআই। জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা (এনএসআই) এর তথ্যের ভিত্তিতে পরিচালিত এই অভিযানে পরিশোধন ছাড়াই নোংরা পানি বোতলজাত করার প্রমাণ পাওয়া যায়।
জেলা প্রশাসনের এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট মাসুমা আক্তার কণা জানান, ‘ইভাইন ড্রিংকিং ওয়াটার’ পরিশোধন ছাড়াই নোংরা পানি বিশুদ্ধ হিসেবে বিক্রি করছিল। মেয়াদোত্তীর্ণ লাইসেন্স থাকার কারণে প্রতিষ্ঠানটিকে ৭০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে এবং কারখানার মান উন্নয়নের জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
চট্টগ্রামে প্রায় ৯৭টি প্রতিষ্ঠান অবৈধভাবে পানির ব্যবসায় জড়িত। বিএসটিআইয়ের মান সনদ আছে মাত্র ৫টি প্রতিষ্ঠানের। লাইসেন্সবিহীন এসব প্রতিষ্ঠান একদিকে জনস্বাস্থ্যকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে, অন্যদিকে সরকারের রাজস্বও ফাঁকি দিচ্ছে। প্রায়ই এসব প্রতিষ্ঠানে সরাসরি ওয়াসা’র পানি জারে ভরে বিক্রি করার অভিযোগ পাওয়া যায়।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ড্রিংকিং ওয়াটার সেক্টরে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে। বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই লাইসেন্সবিহীন এবং কোনো মান রক্ষা করছে না। অবিলম্বে এসব মানহীন প্রতিষ্ঠান সিলগালা করা উচিত। বিএসটিআইয়ের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা, তদারকি বাড়ানো এবং ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান জোরদার করা প্রয়োজন।
অবৈধ পানি সরবরাহকারীরা কম দামে পানি বিক্রি করার ফাঁদ পেতেছে। এই কম দামের কারণে প্রায় সকল হোটেল, রেস্টুরেন্ট, ছোট দোকান, এমনকি অনেক বাসাবাড়িতেও এখন এসব প্রতিষ্ঠানের ভেজাল পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, বেশিরভাগ পানির জারে প্রতিষ্ঠানের নাম-ঠিকানাই নেই। কিউসি পাস স্টিকার লাগিয়ে বিক্রি হচ্ছে এসব পানির জার। সাধারণ ভোক্তারা সরল বিশ্বাসে এই পানি পান করছেন এবং প্রতারিত হচ্ছেন। তারা পানির মান নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলার প্রয়োজনও মনে করছেন না। এই প্রতারণার ফলে ক্রেতারা শুধু আর্থিকভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন না, একই সাথে মারাত্মক পানিবাহিত রোগেরও শিকার হচ্ছেন।চিটাগাং ড্রিংকিং ওয়াটার ম্যানুফ্যাকচারার্স এসোসিয়েশন এর সাধারণ সম্পাদক ফয়সল আবদুল্লাহ জানান, চট্টগ্রামে ১১৭টি ড্রিংকিং ওয়াটার কারখানা আছে, যার মধ্যে মাত্র ৫টির বিএসটিআই লাইসেন্স আছে এবং ১৫টির লাইসেন্স প্রক্রিয়াধীন। বাকি কারখানাগুলো মানহীন পানি উৎপাদন করছে। গত দুই বছর ধরে এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রশাসনের অভিযানও বন্ধ রয়েছে।
মিনারেল ওয়াটার ব্যবসার সাথে জড়িত একাধিক ব্যবসায়ী জানান, চট্টগ্রামে প্রতিদিন ১০ লাখ লিটার বোতলজাত পানি বিক্রি হয়, যার বাৎসরিক বাজার ৩৬ কোটি লিটার এবং আর্থিক মূল্য প্রায় ১ হাজার ৮০ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি)-এর গবেষণায় বোতলজাত ও জার পানিতে ই-কলি’র মতো রোগ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এই ব্যাকটেরিয়া ডায়রিয়া, মাথাব্যথা, বমিভাব, পেটব্যথা, জ্বর-ঠাÐাসহ বিভিন্ন রোগের কারণ হতে পারে এবং শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। বিএআরসি’র গবেষণায় আরও দেখা গেছে, ব্র্যান্ডের বোতলজাত পানিও বিডিএস মান যথাযথভাবে অনুসরণ করে না এবং জারের পানিতে কোনো গুণগত মানই বজায় রাখা হয় না।