চট্টগ্রামসহ রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে দেশের সর্বত্র লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী। সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরে দেখা গেছে গত সোমবার ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন ৬ জন। আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধিন আছেন ১ হাজার ২৯৭জন। এ নিয়ে চলতি বছরে ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে ৩২০ জনের। হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন ৬৫ হাজার ৭৬৮ জন। অপরদিকে চট্টগ্রামেও সমানে বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী।
একথা সত্য যে, ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব এটি নতুন নয়। আগে চট্টগ্রাম সিটি ও রাজধানীর দুই সিটি কর্পোরেশন এলাকার মানুষকে বেশি আক্রান্ত হতে দেখা যেত। কিন্তু ২০১৭ সালের পর থেকে ধীরে ধীরে এর বিস্তার লাভ করে। শহর থেকে ছড়িয়ে পড়ে গ্রামেও। বলা যায় এটা এখন আর সহনীয় পর্যায়ে নেই। কারণ ঘনত্ব বেশি হওয়ার কারণে জেনেটিক কারণে শক্তিশালী হচ্ছে এডিস মশা। আগে যেখানে পরিষ্কার ও স্বচ্ছপানিতে ডেঙ্গু বিস্তার লাভ করত, সেখানে এখন ময়লার স্তূপ, নালা, নর্দমা ও নোংরা পানিতেও এডিস মশার লার্ভা জন্মাচ্ছে। এছাড়া আগে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা যেত বর্ষাকালসহ চারমাস অর্থাৎ জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গুজ্বরের প্রকোপ থাকে। কারণ এ সময়ে এডিস মশার বিস্তার ঘটে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে ডিসেম্বর-জানুয়ারিতেও আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। এককথায় পুরো বারো মাসে চলছে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব। ফলে উল্টো পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছে দেশের মানুষ। এ কথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে জলবায়ু পরিবর্তনে পরিবেশগত ক্ষতির কারণে এডিস মশা বেড়েছে। এতে বৃদ্ধি পাচ্ছে ডেঙ্গুর প্রকোপ। ডেঙ্গুজ্বরে ক্রমেই মৃত্যুহারও বাড়ছে। স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞরা বলছেন, এডিস মশার লার্ভার ধরনে পরিবর্তন এসেছে। এডিস মশার লার্ভা ধ্বংস ও নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষমতা অর্জন করতে না পারায় কাক্সিক্ষত সুফল মিলছে না। ফলে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা ও প্রাণহানি বাড়ছে।
করোনা মহামারি শুরুর পরের বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ২৮ হাজার ৪২৮। এর মধ্যে মারা যান ১০৫ জন। মৃতের হার ছিল শূন্য দশমিক ৩৭। পরের বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন ৬২ হাজার ৩৮২ জন। এর মধ্যে মারা যান ২৮১ জন। এ বছর আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বেড়ে যায়। একই সঙ্গে বাড়ে মৃত্যুহার। মৃত্যুহার ছিল শূন্য দশমিক ৪৫। ২০২৩ সালে ডেঙ্গুর সব রেকর্ড ভেঙে যায়। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন ৩ লাখ ২১ হাজার ২৭ জন। এর মধ্যে মারা যান ১ হাজার ৭০৫ জন। মৃত্যুহার বেড়ে হয় শূন্য দশমিক ৫৩ শতাংশ। সা¤প্রতিক পরিস্থিতিতে দেখা যাচ্ছে, দেশে প্রতি বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, মৃত্যুহারও বেড়ে চলেছে। মৃত্যুর এই উচ্চহার বিশ্বের আর কোথাও নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি কিছুটা জটিল হচ্ছে। অভিযোগ উঠেছে, সমস্যা মোকাবিলায় যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। দেশব্যাপী জোরদার প্রতিরোধ কার্যক্রম চোখে পড়ছে না। চিকিৎসার ক্ষেত্রেও অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। আশার কথা ডেঙ্গু প্রতিরোধে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বেশ কিছু উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে রাজধানী ঢাকায় দুটি বিশেষজ্ঞ টিমকে ডেঙ্গু প্রতিরোধে কার্যকর উদ্যোগ নেয়ার জন্য নিয়োগ দেয়া হয়েছে। চট্টগ্রামের নব নিযুক্ত মেয়র ডাঃ শাহাদাত হোসেন গতকাল মঙ্গলবার মেয়রের দায়িত্ব নিয়ে চট্টগ্রামে ডেঙ্গু প্রতিরোধে জনসচেতনতা সৃষ্টি ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন অভিযান পরিচালনার ঘোষণা দেন। তিনি সিটি কর্পোশেনের মশার ওষুধের গুনগত মান যাচাই বাছাই করা হবে বলেও সাংবাদিকদের জানান। আমরা মেয়রের উদ্যোগগুলোর সফলতা কামনা করি। বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, ডেঙ্গু প্রতিরোধে এখন কার্যকর ব্যবস্থা গড়ে তোলা সময়ের দাবি। সরকার এবং জনগণের সমন্বিত উদ্যোগই পারে এডিস মশা থেকে আমাদের সুরক্ষিত রাখতে। পরিবেশের পরিচ্ছন্নতা, মশার জৈবিক নিয়ন্ত্রণ, মশক নিধন কীটনাশক প্রয়োগ এবং গণসচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে পরিপূর্ণভাবে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে সবাইকেই একসঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে হবে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের আবহাওয়া প্রায় সারা বছরই ডেঙ্গু ভাইরাসের জন্য সহায়ক। সুতরাং রোগ নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজন মশার উৎস নির্মূল করা। ব্যক্তিপর্যায়ে খুব সাধারণ কিছু নিয়ম মেনেই ডেঙ্গুকে রুখে দেওয়া সম্ভব। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এতে সবাইকেই উদাসীন দেখা যায়।
বর্ষাকাল আসলেই ডেঙ্গু প্রতিরোধের উদ্যোগের দিন শেষ। সম্প্রতি ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব আমাদের তাই ইঙ্গিত দিচ্ছে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূলে সারা দেশে এর প্রতিরোধব্যবস্থা জোরদার করা জরুরি। ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে সমষ্টিগতভাবে এগিয়ে আসা আবশ্যক। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় পরিস্থিতি বহুলাংশে মোকাবিলা করা যায় বলে আমাদের বিশ্বাস।