নিজস্ব প্রতিবেদক
নগরীতে খোলা বাজারে খাদ্যশস্য (ওএমএস) বিক্রির ডিলার নিয়োগ নিয়ে খাদ্য বিভাগে তোলপাড় চলছে। গত ২৬ জুন ২৯টি ওয়ার্ডে ডিলার নিয়োগের জন্য মনোনীত প্রতিষ্ঠানের নাম প্রকাশের পর এ প্রক্রিয়া নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন ডিলার প্রত্যাশীরা। খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ওএমএস ডিলার নিয়োগে আর্থিক অনিয়ম, ডিলার নিয়োগে শর্ত অমান্য করা, পছন্দের ব্যক্তিদের ডিলার নিয়োগ ও আওয়ামী লীগের দোসর হিসেবে পরিচিত ডিলারদের পুনরায় নিয়োগের অভিযোগ তুলেছেন। এর আগে গত ৫ মে নগরীর ১২টি ওয়ার্ডের ওএমএস ডিলার মনোনীত করা হয়। ইতোমধ্যে ডিলার নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে কয়েকজন ওএমএস ডিলার নিয়োগ কমিটির সভাপতি ও বিভাগীয় কমিশনার বরাবরে অভিযোগও দিয়েছেন।
চট্টগ্রামের আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক এসএম কায়ছার আলী পূর্বদেশকে বলেন, ‘কেউ অভিযোগ দিলে সেগুলো বিভাগীয় কমিশনার বরাবরে পাঠাতে হবে। অভিযোগকারী এসে নিজে দেখে যাবে তার আবেদনে কি সমস্যা আছে এবং কেন বাদ পড়েছে। কোন খাদ্য পরিদর্শক আর্থিক লেনদেন করেছেন এমন অভিযোগ প্রমাণ দিতে পারলে সাথে সাথে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
জানা যায়, নগরে ৪১টি ওয়ার্ডে ডিলার নিয়োগে ৪২০টি আবেদন জমা পড়ে। আবেদনের প্রেক্ষিতে তদন্ত করে প্রথমধাপে গত ৫ মে ১২টি ওয়ার্ডে এবং গত ২৬ জুন ২৯টি ওয়ার্ডে ডিলার মনোনীত করা হয়। সর্বশেষ মনোনীত করা ২৯টি ওয়ার্ডের মধ্যে মোহরা, উত্তর কাট্টলী, উত্তর হালিশহর, পাঠানটুলী, উত্তর মধ্য হালিশহর, দক্ষিণ মধ্য হালিশহর, দক্ষিণ হালিশহর, উত্তর পতেঙ্গায় যোগ্য আবেদনকারী থাকায় ২-৪ জনকে ডিলার মনোনয়ন করা হয়েছে। এর আগেও ১২জন ডিলার মনোনয়নেও বাগমনিরাম ও শুলকবহরে একাধিক ডিলার মনোনীত করা হয়। লটারির মাধ্যমেই একজনকে যোগ্য আবেদনকারী হিসেবে বেছে নেয়া হবে বলে নিজেদের ওয়েবসাইটে জানায় খাদ্য অধিদপ্তর।
অভিযোগ উঠেছে, খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তারা প্রতিজন ডিলার আবেদনকারী ডিলার হিসেবে মনোনয়নের যোগ্য কিনা ওয়ার্ড ভিত্তিক পরিদর্শনে যান। পরিদর্শনকালে খাদ্য কর্মকর্তারা প্রতিজন ডিলার প্রত্যাশী থেকে আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করেন। পরে ডিলার নিয়োগ দিতে পারলে ৩০ হাজার থেকে এক লক্ষ টাকা পর্যন্ত প্রস্তাব দেন। এই টাকা যারাই যোগান দিতে পেরেছে তারাই শর্ত অমান্য করে নিয়োগ পেয়েছে।
এরকম দুটি ওয়ার্ডে কয়েকজন ডিলার প্রত্যাশীর সাথে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। এ দুটি ওয়ার্ডের তদন্তের দায়িত্বে ছিলেন খাদ্য পরিদর্শক মনছুর হাবীব ও বিদ্যুৎ চৌধুরী। এই দুই কর্মকর্তা তদন্তকালে ডিলারদের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করেছেন। তাঁরা নিজেদের পছন্দের ব্যক্তিদের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়ে ডিলার নিয়োগে সুপারিশ করেছেন। অন্যদের বাতিলে যে অজুহাত তুলে ধরা হয়েছে এমন কোন শর্ত ডিলার নিয়োগে উল্লেখ ছিল না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন বাদ পড়া ডিলার প্রত্যাশী বলেন, খাদ্য পরিদর্শক মনছুর হাবীব দুটি ওয়ার্ডের দায়িত্বে থাকলেও তিনি পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করেন। খাদ্য বিভাগের অন্যান্য তদন্ত কর্মকর্তাদের সাথে যোগসাজশ করে কয়েকজন আওয়ামী লীগপন্থি পুরানো ডিলারদের সাথে নিয়ে পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করেছেন। মনছুর যাদের কাছ থেকে অর্থ নিতে পেরেছেন তাদেরকেই নিয়োগ সুপারিশ করেছেন তদন্ত কর্মকর্তারা। মাঝখানে নিতে তবলছড়ি বদলি হলেও পুনরায় চট্টগ্রামে চলে এসে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন।
চট্টগ্রামের আরেক খাদ্য পরিদর্শক মনছুর হাবীব পূর্বদেশকে বলেন, ‘আমি বদলি হয়ে আসছি এক মাসও হয়নি। ৬জুন যোগদান করেছি। ওএমএস ডিলার নিয়োগে আমি তেমন সম্পৃক্ত ছিলাম না। আমি শুধু ৯নং ও ৫নং ওয়ার্ডের দায়িত্বে ছিলাম। আমি কারো সাথে আর্থিক লেনদেন করার কোন প্রশ্নই আসে না। এগুলো মিথ্যা অভিযোগ।’
২০নং ওয়ার্ডের ডিলার নিয়োগ পেতে আবেদনকারী মোহাম্মদ আলী আব্বাছ বলেন, ‘আমি কখনো ডিলার ছিলাম না, এবারই প্রথম ডিলারশীপের আবেদন করি। সিন্ডিকেট করে টাকা নিয়ে লটারী ছাড়াই সিলেক্টেট করে দিয়েছে। বিগত ১৭ বছর ধরে যে ডিলার ছিল এবারও তাকে ডিলার দেয়া হয়েছে। আগে সবুরের মায়ের নামে ছিল এবার সবুরকে ডিলারশীপ দেয়া হয়েছে। নীতিমালায় আছে পরিবারের কেউ আগে ডিলার থাকলে আর হতে পারবে না। খাদ্য পরিদর্শক বিদ্যুৎ চৌধুরী নামে একজন তদন্তে এসেছিল। উনি আমার দোকান দেখে সব ঠিক আছে বলে তিন হাজার টাকা নিয়েছে। পরে ডিলারশীপ দিবে বলে টাকার প্রস্তাব দিয়েছিল। আমি টাকা দিব না বলাতে ডিলারশীপ দেয়নি। আমি বিভাগীয় কমিশনারের কাছে পুনতদন্তের জন্য আবেদন করেছি।’
চট্টগ্রামের খাদ্য পরিদর্শক বিদ্যুৎ চৌধুরী পূর্বদেশকে বলেন, ‘ডিলার নিয়োগ হয়েছে মিটিংয়ের মাধ্যমে। কোন অভিযোগ থাকলে আপনি আরসি ফুড স্যারের সাথে কথা বলেন। উনি ডিলার নিয়োগ কমিটির সদস্য সচিব। আমি শুধু মাঠপর্যায়ে ২০ ও ১০নং ওয়ার্ডে তদন্তে গিয়েছিলাম। আমি কারও কাছ থেকে টাকা নিইনি। অন্ততপক্ষে আমার বেলায় সেটা বলতে পারি। আমার টাকা নেয়ার মতো কোন রেকর্ড নাই।’
এদিকে পুরানো ডিলাররা একত্রিত হয়ে পুনরায় আগের ডিলারশিপ ২০২৫-২৬ সালের জন্য নবায়ন করতে আদালতের ধারস্থ হয়েছেন। রিট আবেদনটি আদালতে শুনানীর অপেক্ষায় রয়েছে। এরমধ্যে রিটের ৭নং বিবাদী ওএমএস কমিটির সদস্য ও জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রককে অনুলিপি প্রাপ্তির সাত দিনের মধ্যে আবেদনকারীদের আবেদন নিষ্পত্তি করে জানাতে বলেছে আদালত। এ বিষয়ে জানতে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক সুমাইয়া নাজনীনকে দুইদফা ফোন দেয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি।