বিপ্লব কান্তি নাথ
অনুকূলচন্দ্র চক্রবর্তী, যিনি ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র নামেও পরিচিত। অনুকূলচন্দ্র চক্রবর্তী সৎসঙ্গ নামক সংগঠনের প্রবর্তক। অনুক‚লচন্দ্র ব্রিটিশ ভারতের বঙ্গ প্রদেশের পাবনা জেলার হিমায়তপুরে জন্মগ্রহণ করেন, যা বর্তমানে বাংলাদেশের অন্তর্গত। ঝাড়খন্ডের দেওঘরে মৃত্যুবরণ করেন। ইনি ইষ্টভৃতির মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহের ব্যবস্থাপনা উদ্ভাবন করেন।
অনুক‚লচন্দ্র পাবনা ইনস্টিটিউশনে নবম শ্রেণি পর্যন্ত অধ্যয়ন করার পর পশ্চিমবঙ্গের নৈহাটি উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি কলকাতার ন্যাশনাল মেডিক্যাল স্কুল থেকে হোমিওপ্যাথিতে ডিগ্রি অর্জন করে নিজ গ্রামে প্র্যাক্টিস শুরু করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন: মানুষ শারীরিক, মানসিক ও আত্মিক এ তিন প্রকার ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। তাই তিনি মানসিক ব্যাধির চিকিৎসার প্রতিই বেশি জোর দিতেন, কারণ শারীরিক সুস্থতা অনেকটাই মানসিক সুস্থতার ওপর নির্ভর করে। তাই মায়ের নিকট দীক্ষা নেওয়ার পর অনুকূলচন্দ্র মানুষের আত্মিক উন্নয়নের জন্য কীর্তনদল গঠন করেন। কীর্তনের সময় তিনি মাঝে মাঝে দিব্যভাবে আবিষ্ট হয়ে পড়তেন। ওই সময় তাঁর মুখ থেকে উচ্চারিত বাণীসমূহ পরে সংগৃহীত হয়ে পুণ্যপুঁথি নামে প্রকাশিত হয়। তখন থেকেই লোকে তাঁকে ‘ঠাকুর’ বলে সম্বোধন করত।
সত্যনিষ্ঠা, সৎকর্মানুষ্ঠান এবং দীক্ষা গ্রহণের মধ্য দিয়ে মানুষের আত্মিক উন্নতি বিধানের উদ্দেশ্যে তিনি পাবনায় প্রতিষ্ঠা করেন সৎসঙ্গ আশ্রম। শিক্ষা, কৃষি, শিল্প এবং সুবিবাহ- এ চারটি বিষয় হলো সৎসঙ্গের আদর্শ। অনুকূলচন্দ্র লোকহিতার্থে তপোবন বিদ্যালয়, দাতব্য চিকিৎসালয়, ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ, পাবলিশিং হাউজ, ছাপাখানা ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করেন।
অনুকুলচন্দ্র ১৮৮৮ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর বঙ্গ প্রদেশের পাবনা জেলার হিমায়তপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা হলেন শিবচন্দ্র চক্রবর্তী এবং মাতা হলেন মনমোহিনী দেবী। ১৮৯৩ সালে তিনি হিমায়তপুর গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু করেন। ১৮৯৮ সালে তিনি পাবনা ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন এবং সেখানে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। তিনি অমিতাবাদের রায়পুর উচ্চ বিদ্যালয়ে অল্প সময়ের জন্য পড়েন এবং তারপরে পশ্চিমবঙ্গের ২৪ পরগনার নৈহাটি উচ্চ বিদ্যালয়ে ১৯০৫ সাল পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। পরে তিনি কলকাতার ন্যাশনাল মেডিক্যাল স্কুলে ভর্তি হন এবং সেখান হোমিওপ্যাথিতে ডিগ্রি অর্জন করে। অনুকূলচন্দ্র দেওঘরে তপোবন বিদ্যালয়, দাতব্য চিকিৎসালয়, ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ, পাবলিশিং হাউজ, ছাপাখানা ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
১৯৪৬ সালে তিনি বিহারের দেওঘরে যান এবং সেখানে সৎসঙ্গের আদর্শপুষ্ট একটি নতুন আশ্রম গড়ে তোলেন। ১৯৪৭ সালে বাংলা ভাগ হলে তিনি আর ফিরে আসেননি। অনুকূলচন্দ্র বিপুল সংখ্যক গ্রন্থ রচনা করেছেন। এক হিসাব মতে, তাঁর রচিত বাংলা গ্রন্থের সংখ্যা ৮২ এবং ইংরেজি গ্রন্থের সংখ্যা ১২। এসবের মধ্যে পুণ্যপুঁথি, অনুশ্রুতি (৬খন্ড), চলার সাথী, শাশ্বতী (৩খন্ড), প্রীতিবিনায়ক (২খন্ড) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। ঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের শিষ্যসম্প্রদায় এবং সৎসঙ্গের সাংগঠনিক কর্মকান্ড উভয় বাংলার নানা অঞ্চলে আজও সক্রিয়। ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন শহরে এর আশ্রম ও কার্যালয় রয়েছে।
সৎসঙ্গের প্রতিষ্ঠাতা শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র। প্রতিষ্ঠানটির নামের তাৎপর্য ব্যখ্যা করে তিনি বলেন, ‘সৎ ও সংযুক্তির সহিত তদগতিসম্পন্ন যাঁরা তাঁরাই সৎসঙ্গী, আর তাদের মিলনক্ষেত্র হল সৎসঙ্গ। শুরু হল মানুষ তৈরির আবাদ। কর্মের মাধ্যমে যোগ্যতর মানুষ গড়ে তোলাই হল এর লক্ষ্য। সৎসঙ্গ ‘ইষ্টভৃতি’-এর মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করে; এক বিরল প্রথা।
ধর্ম কর্মের অপূর্ব সমন্বয়ে সৎসঙ্গ আশ্রম। শিক্ষা, কৃষি, শিল্প, সুবিবাহ আস্তিকের এই চার স্তম্ভের অভিব্যক্তি। এই আশ্রমে বিভিন্নমুখী কর্ম প্রতিষ্ঠানের বিদ্যায়তন গড়ে উঠল, প্রাচীন ঋষিদের তপোবনের নবতর সংস্করণ যেন। ব্রহ্মচর্য্য, গার্হস্থ্য, বানপ্রস্থ ও সন্ন্যাস সনাতন আর্য জীবনের এই চারটি স্তরই সৎসঙ্গ আশ্রমভূমিতে এক সামঞ্জস্যপূর্ণ যুগোপযোগী রূপ লাভ করে।
ঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের আধ্যাত্মিক প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দলে দলে মানুষ এসে তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, মহাত্মা গান্ধী, লাল বাহাদুর শাস্ত্রী, গুলজারীলাল নন্দা এই সৎসঙ্গের কর্মকান্ড দর্শন করে ভূয়শী প্রশংসা করেন।
অনুকূলচন্দ্র ঠাকুর প্রায় ৪৬টি পুস্তক রচনা করেন। এগুলোতে ধর্মশিক্ষা, সমাজ সংস্কার প্রচলন প্রভৃতি বিষয়ে আদর্শ ও উপদেশসমূহ বর্ণিত হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য : * সত্যানুসরণ * পুণ্যপুথি * অনুশ্রুতি (৬ খন্ড) * চলার সাথী * শাশ্বতী (৩ খন্ড) * বিবাহ বিধায়না * সমাজ সন্দীপন * যতি অভিধর্ম ইত্যাদি।
১৯৬৯ সনের ২৭ জানুয়ারী তারিখে ৮১ বছর বয়সে তাঁরই প্রতিষ্ঠিত আশ্রম ভারতের বিহার রাজ্যে দেওঘরে ঠাকুর দেহ ত্যাগ করেন।
লেখক : সাধারণ সম্পাদক, রুদ্রজ ব্রাহ্মণ পুরোহিত সংঘ, বাংলাদেশ