ট্রাম্পের নোবেল বিলাস, বিশ্বমানবতার প্রতি এক নির্মম রসিকতা

1

আকতার কামাল চৌধুরী

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের এবারের নোবেল প্রত্যাশা ছিল চোখে পড়ার মত। তিনি রাখঢাক না রেখেই বলেছেন, ‘আমি আটটি যুদ্ধ থামিয়েছি। তাই শান্তির জন্য আমিই নোবেলের উপযুক্ত। প্রেসিডেন্ট ওবামা তো কিছু না করেই নোবেল পেয়েছেন’। কিন্তু আসলেই কি ট্রাম্প বিশ্ব শান্তির জন্য এমন কিছু করেছেন, যে জন্যে তিনি নোবেল পুরস্কার পাওয়ার দাবি করতে পারেন?
গাজা যুদ্ধের পরিসমাপ্তি টানতে ট্রাম্পের ২০ দফা শান্তি পরিকল্পনা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এখানে বারংবার হামাসকেই নিরস্ত্র হতে বলা হয়েছে। আরও বলা হয়েছে ‘হামাস ইসরায়েলের জন্য হুমকি নয়’- এমন অবস্থা দেখা দিলেই কেবল ইসরায়েলী সৈন্য প্রত্যাহার করবে’। অথচ, ৬৭ হাজার ফিলিস্তিনির মৃত্যু, আরও ২ লক্ষাধিক ফিলিস্তিনির আহত ও পঙ্গুত্ববরণ, ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনিদের ত্রাণ সংগ্রহকালে নির্বিচারে গুলি করে মারা, জাতিসংঘের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ত্রাণকর্মী ও সাংবাদিককে টার্গেট করে হত্যা, সীমান্তে ত্রাণের বহর আটকে রেখে গাজাবাসীকে অনাহারে মৃত্যুর মুখে ফেলে দেওয়া, পুরো গাজাকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করাসহ এমন কোনো গর্হিত অপরাধ নেই যা ইসরায়েল করেনি।
জাতিসংঘ জানিয়েছে, গাজা পুনর্গঠনে কমপক্ষে ৭০ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হবে। অথচ, ট্রাম্পের ২০ দফায় এ ভয়াবহ অপরাধের জন্য ইসরায়েলকে বিচারের মুখোমুখি করার কোনো শব্দ নাই। এমনকি ২০ দফার কোনো অংশে ইসরায়েলকে কোনোভাবেই দায়ী করা হয়নি। বলতে গেলে সবকিছুতে ইসরায়েলকে একতরফাভাবে দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। বলতেই হয়, ইসরায়েল এত বেপরোয়া হওয়ার পেছনে একমাত্র ট্রাম্প-ই দায়ী। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তাঁর শাসনামলে ব্যাপক প্রাণহানির আশংকায় ইসরায়েলকে প্রাণঘাতী মারনাস্ত্র সরবরাহ করেননি। মার্কিন ক্ষমতার পালাবদল হলে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সেসব মারণাস্ত্র নির্দ্বিধায় পাঠিয়ে দেন ইসরায়েলে।আর ইসরায়েল সেসব মারণাস্ত্র নিয়ে দ্বিগুণ উৎসাহে ঝাঁপিয়ে পড়ে গাজাবাসীর উপর। শুরু হয় ইতিহাসের জঘন্য গণহত্যা। এর দায় কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না ট্রাম্প। এখন সেই ট্রাম্প কি না শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কারের জপ শুরু করেছিলেন। আফসোস! এটা বিশ্বমানবতার প্রতি এক চরম উপহাস।
হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র স্টিভেন চেউং নোবেল কমিটির সমালোচনা করে লিখেছেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মানবিক হৃদয়ের অধিকারী। তার মতো আর কেউ কখনো আসবেন না, যিনি শুধু তার ইচ্ছাশক্তি দিয়ে পাহাড়ও টলিয়ে দিতে পারেন। নোবেল কমিটি প্রমাণ করেছে, তারা শান্তির চেয়ে রাজনীতিকে বেশি গুরুত্ব দেয় এটা হোয়াইট হাউজের হাপিত্যেস। হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরের পরেও ইসরায়েল নিজের গোঁয়ার্তুমি ছাড়েনি। বারবার যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে একই পরিবার ১১জনসহ আরএ ৯৭ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। নেথানিয়াহু নিজেই বলেছেন, এ হামলা চালানোর জন্য নিজেই আদেশ দিয়েছেন এবং তাঁর বাহিনী গত রোববার একদিনেই গাজায় ১৫৩টন বোমা ফেলেছে। এরজন্যে ট্রাম্পের কোনো বিকার নেই।বরং উল্টো হোমসকেই হুমকি দিয়ে রেখেছেন, ‘প্রয়োজনে তিনি ইসরায়েলকে আবারও হামলা চালাতে বলবেন’। বাহ্‌! শান্তির দূত বাহ!
ট্রাম্প জাতিয়তাবাদের ধুয়া তুলে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা অভিবাসীদের হাতপা বেঁধে অত্যন্ত অপমানজনকভাবে নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠান। যা অত্যন্ত নেক্কারজনক। নিজ দেশের ইউনিভার্সিটির কর্তৃত্ব কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন, তহবিল বন্ধ করেন। যা মার্কিন ইতিহাসে আর কখনো ঘটেছে বলে জানা যায় না। ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোকে তলে তলে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
ট্রাম্প সরাসরি না বললেও কয়েকজন কর্মকর্তা বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন। তাদের বরাত দিয়ে নিউ ইয়র্ক টাইমস বলছে, সিআইএকে অভিযানের অনুমতি দেওয়াটা নিকোলাস মাদুরো সরকারের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বশেষ পদক্ষেপ। এই অভিযানের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো মাদুরোকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করা। আরও রহস্যজনক হলো, ভেনিজুয়েলার সরকার বিরোধী নেত্রী মারিয়া করিনা মাচাদোকে এবার নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভ‚ষিত করা হয়।মাচুদো সে পুরস্কার ট্রামকে উৎসর্গ করেন। চমৎকার তো! শান্তি পুরস্কারের রহস্য এখানেই।
ট্রাম্প ‘শুল্ক’কে ট্রামকার্ড হিসেবে ব্যবহার করেছেন। যা একটি দেশের অর্থনীতিতে মারাত্মক প্রভাব পড়ে। ভারত-পাকিস্থান বন্ধু বাছাইয়েও ট্রাম্প এটি কাজে লাগান। যা বিশ্বশান্তির পথে বিরাট অন্তরায়। একটি দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করা মানে ওই দেশের সাথে যুদ্ধ করার শামিল। ভারত,চীন, ব্রাজিল, রাশিয়সহ কয়েকটি দেশের উপর যে মাত্রাতিরিক্ত ও অন্যাহ্য শুল্ক চাপিয়েছেন তা বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের একক আধিপত্য ও চোখ রাঙানোর শামিল। অর্থনীতি যে শান্তিরও পরিচায়ক তা নোবেল কমিটি বাংলাদেশের অর্থনীতিবিধ ড.মুহাম্মদ ইউনুসকে শান্তিতে পুরস্কার দিয়েই প্রমাণ করেছেন। ইসরায়েল হঠাৎ ইরান আক্রমণ করে সেদেশে কয়েকজন পরমাণু বিজ্ঞানী, সেনা কর্মকর্তাসহ প্রায় ১৩ শ মানুষকে হত্যা করে। এ আক্রমণ যে ট্রাম্পের পূর্বানুমতি ছাড়া হয়নি তা বিশ্বাস করার প্রভ‚ত কারণ আছে।
ট্রাম্প নিজেই বলেছেন, তিনি অনুমতি দেননি বলে আলী খামেনীকে ইসরায়েল হত্যা করেনি। ইরান আক্রমণে যে ট্রাম্পের হাত ছিল তাঁর এই স্বীকারোক্তিতেই স্পষ্ট। শুধু তাই নয়,কোনো রাখঢাক না রেখে ইরানের পরমাণু স্থাপনা গুঁড়িয়ে দিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বি-২ যুদ্ধবিমান নিয়ে নিজেই বাঙ্কার-বিধ্বংসী বোমা ফেলে। অর্থাৎ, ট্রাম্প-নেথানিয়াহু গং ইরানের সার্বভৌমত্বকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখান। ইসরায়েলকে সাথে নিয়ে যিনি অন্যদেশের সার্বভৌমত্বকে পায়ে দলে সরাসরি আক্রমণ করতে পারেন, তাঁর নোবেল প্রত্যাশা কি যুক্তিসঙ্গত?
ও-দিকে জেলেনস্কিকে চাপ দিচ্ছেন পুতিনের শর্ত মেনে যুদ্ধবিরতি চুক্তি করতে। অথচ জেলেনস্কির পক্ষে এটি হবে বিষ খাওয়ার-ই নামান্তর। এখানে মনস্তত্ব হলো -জেলেনস্কি ট্রাম্পের পছন্দের ব্যক্তি নন। এভাবে ট্রাম্প নিজের জেদ ও পছন্দকে প্রাধান্য দিয়ে চলেছেন। তিনি এমন কোনো কাজ করেননি যা বিশ্বমানবতার পক্ষে যায়। কিছু বিশ্বনেতা ট্রাম্পের নোবেল না পাওয়ায় অস্বস্তি ও উষ্ম প্রকাশ করেছেন। তাঁদের মূল উদ্দেশ্য সবার জানা।কেউ ক্ষমতায় টিকে থাকতে, আর কেউ বা সম্পর্কের তিক্ততা কমাতে। এরমধ্যে এগিয়ে আছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ। তিনি ট্রাম্পকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তি হিসেবে উল্লেখ করেন। তাঁর এ বক্তব্য যে সম্প্রতি দুদেশের ঘনিষ্ঠ রসায়ন থেকে উৎসারিত তা সবারই জানা। গাজায় গণহত্যার জন্য আন্তর্জাতিক আদালত নেথানিয়াহুর বিরুদ্ধে যে গ্রেফতারি পরওয়ানা জারি করেছে, আমার মতে এ গণহত্যার পৃষ্ঠপোষক হিসেবে ট্রাম্পের বিরুদ্ধেও একই গ্রেফতারী পরওয়ানা জারি করা উচিত।
লেখক : প্রাবন্ধিক