মনিরুল ইসলাম মুন্না
চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন অফিসে জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য সংশোধন বা তথ্য বদলাতে তৈরি হয়েছে একটি সিন্ডিকেট। ওই সিন্ডিকেট নকল কাগজপত্র, হলফনামা ও প্রত্যয়নপত্র তৈরি করে নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে নাম-বয়সসহ যাবতীয় তথ্যাদি পরিবর্তন করে যাচ্ছে। আর এসব অপকর্মের নেপথ্যে সিনিয়র জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা বশির আহমদ রয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। গত এক মাস অনুসন্ধানে বিভিন্ন হলফনামা, ভুয়া কাগজপত্র ও দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগের ভিত্তিতে এসব তথ্য পাওয়া যায়।
নির্বাচন কমিশনার বেগম তাহমিদা আহমদ পূর্বদেশকে বলেন, ‘এনআইডি সংশোধনের জন্য প্রয়োজনীয় সব তথ্য অনলাইনে সাবমিট করতে হবে। এতে যদি জাল হয়, তবে সংশোধন অযোগ্য। সেক্ষেত্রে আমাদের কর্মকর্তারা যাচাই-বাছাই করবেন। তবে কর্মকর্তারা যদি জালিয়াতিতে যুক্ত হন, তা দুঃখজনক। এতে যদি আর্থিক লেনদেন হয় বা অভিযোগ থাকে, তাহলে সেসব কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কমিশন ব্যবস্থা নিবে। সরকারের যেকোনো তদন্ত সংস্থার কাছেও যদি অভিযোগ থাকে, তারাও তদন্ত করুক। আমাদের হাতে আসলে আমরাও করব। প্রমাণ হলে ছাড় নয়।’
কেইস স্টাডি-১ : চন্দনাইশ উপজেলার সাজেদা আক্তার মুন্নি। যার জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) নং- ৮২০৯৫৬৫৯৬২। গত ৭ ফেব্রæয়ারি তিনি এনআইডির বয়স সংশোধনের জন্য আবেদন করেন। পূর্বের বয়স ছিল ১০ আগস্ট ১৯৮৫ ইং, যা পরিবর্তন হয়ে করা হয় ১০ আগস্ট ১৯৯০ ইং। অর্থাৎ, পূর্বের বয়সের তুলনায় ৫ বছর কমানো হয়। এতে সিভিল সার্জন কর্তৃক বয়স প্রমাণের জন্য রেডিওলজিক্যাল প্রত্যয়ন চাওয়া হয়। কিন্তু যে প্রত্যয়ন সংযুক্ত করা হয়েছে, তা সম্পূর্ণ নকল। এছাড়া চট্টগ্রামের চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত থেকে ২০২২ সালের ২৪ এপ্রিল ২৩৩ নম্বর সিরিয়ালের যে হলফ নামা করা হয়েছে তাও নকল। আর এ আবেদন ‘খ’ ক্যাটাগরিতে থাকাতে অনুমোদনের দায়িত্ব আসে সিনিয়র জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা বশির আহমদর ইউজার প্যানেলে। তিনি নকল কাগজপত্র সংযুক্ত থাকা সত্বেও অনুমোদন দিয়ে দেন।
কেস স্টাডি-২ : গত ৩১ ডিসেম্বর চন্দনাইশ উপজেলার আরেকটি বয়স সংশোধনের আবেদন করেন মোহাম্মদ ইমন। যার এনআইডি নং- ৬০০৮৪৯৫৬৯৬। তিনি সংশোধনের সময় অনলাইনে দুটি পৃথক জন্ম সনদ পাওয়া যায়। যেটি জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধন আইনের সম্পূর্ণ পরিপন্থী হিসেবে ধরা হয়। পাশাপাশি চট্টগ্রামের চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত থেকে ২০২২ সালের ২৪ এপ্রিল ২৩৩ নম্বর সিরিয়ালের যে হলফ নামা করা হয়েছে তাও নকল। এরপরও ‘খ’ ক্যাটাগরিতে থাকাতে অনুমোদনের দায়িত্ব আসে সিনিয়র জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা বশির আহমদের ইউজার প্যানেলে। তিনি নকল কাগজপত্র সংযুক্ত থাকা সত্বেও প্রবাসী বিবেচনায় অনুমোদন দিয়ে দেন।
উপরের দুইটি কেস স্টাডিতে জালিয়াতি আরও স্পষ্ট হয়ে যায়। সেটা হচ্ছে- একটি ৩০০ টাকার স্ট্যাম্প সেট, দুইটি কেসে ব্যবহৃত হয়েছে। প্রতিটি স্ট্যাম্পের মূল্য ১০০ টাকা করে। আর দুইটি কেসে স্ট্যাম্পের ক্রমিক নম্বর ছিল একই। সেগুলো হচ্ছে- খঞ ০২৫২৬৪৮, খঞ ০২৫২৬৪৯ এবং খঞ ০২৫২৬৫০। দুই কেসে একই স্ট্যাম্প, সিরিয়াল নং- ২৩৩ এবং ২০২২ সালের ২৪ এপ্রিল তারিখ একই রয়েছে।
কেস স্টাডি-৩ : গত ১৪ জানুয়ারি এনআইডির বয়স ও শিক্ষাগত যোগ্যতা সংশোধনের তথ্য পর্যালোচনায় উঠে আসে আরো ভয়াবহ চিত্র। আবেদনকারীর নাম আবুল কাশেম চৌধুরী। এনআইডি নং- ৬৪৩৪০৪৪০৫০। প্রথম আবেদনে তিনি মাধ্যমিকের ভূয়া সনদ দাখিল করলেও পরবর্তীতে মাধ্যমিকের স্থানে অষ্টম শ্রেণি পাশ চাওয়া আবেদন মঞ্জুর করেন বশির আহমদ। এছাড়া বয়সের যে সংশোধন করে দেওয়া হয়, ওই ভূয়া সনদেও তার মিল নেই। এতেও কোনো নোট না দিয়ে ‘খ’ ক্যাটাগরিতে থাকাতে এনআইডি সংশোধন করে দিয়েছেন বশির আহমদ।
কেস স্টাডি-৪ : গত ১৬ জানুয়ারি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এলাকার হাসিনা বেগম, এনআইডি নং- ৯১১৫৩২৪২০৫ ও সাতকানিয়া উপজেলার শাহানাজ পারভিন শান্তা, এনআইডি নং- ৫০৬৬৮৮১৪০৯, পৃথক দুটি এনআইডি সংশোধন করা হয়। যেখানে উভয় আবেদনে দাখিলকৃত সিভিল সার্জনের প্রত্যয়ন দুটি নকল এবং হলফনামা দুটি জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক সম্পাদিত নয়। এরপরও কোনো নোট না দিয়ে ‘খ’ ক্যাটাগরিতে থাকাতে এনআইডি সংশোধন করে দিয়েছেন বশির আহমদ।
এভাবে আরও অসংখ্য জাল-জালিয়াতি করা এনআইডি সংশোধন করে দিচ্ছেন এ নির্বাচন কর্মকর্তা। যা সম্পূর্ণ অর্থের বিনিময়ে করা হচ্ছে বলে বিভিন্ন অভিযোগে উঠে এসেছে। তেমনি গত ১৫ মে দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয় চট্টগ্রাম-১ এ চট্টগ্রাম জেলা সিনিয়র নির্বাচন কর্মকর্তা বশির আহমদের ব্যাপক অনিয়ম দুর্নীতি নিয়ে বেনামে একটি অভিযোগ দেওয়া হয়।
অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, বশির আহমদ ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসে জেলা সিনিয়র নির্বাচন কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করার পর থেকেই ব্যাপক আকারে দুর্নীতি ও ঘুষ আদায় করেছেন। বিশেষ করে জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য সংশোধনের ক্ষেত্রে ঘুষ আদায় করেছেন এবং এসব ঘুষের টাকা তার হাত পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার জন্য নিজস্ব সিন্ডিকেট তৈরি করেছেন। বর্তমান সময়ে যারা বিভিন্ন জায়গায় কম্পিউটার নিয়ে অনলাইনের কাজ করেন তাদের জন্য বশির আহমদ এখন আশির্বাদের পাত্র। জনমুখে এখন একটি কথার প্রচলন হয়েছে যে, ২০ হাজার টাকা দিলে বশির সাহেবের অফিসে দিনে দিনে এনআইডির তথ্য সংশোধন হয়ে যায়।
অপরদিকে এসব তথ্য সংশোধনের সুযোগে কারো কারো নিজ পরিবারের ভিতর সম্পত্তি সংক্রান্ত ঝামেলার সৃষ্টি হচ্ছে, আর কেউ অবৈধভাবে সরকারি সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছে। এছাড়া শত শত এনআইডি প্রতিনিয়ত সংশোধন হচ্ছে কোন প্রকার কাগজপত্রের তোয়াক্কা না করে। শুধু টাকার বিনিময়ে এসব তথ্য বদলে যাচ্ছে বলে অভিযোগ জনমুখে।
এসব তথ্য বদলে দিতে ঘুষ আদায়ের মাধ্যমে যেসব ব্যাংক হিসাব ব্যবহার করা হয়েছে, তার মধ্যে প্রতিবেদকের হাতে আসা কয়েকটি হলো- ০০৪৭১৩৬০০০০০০০৮ (মুনাসির ট্রেডার্স, সাউথইস্ট ব্যাংক পিএলসি), ২০৫০৩৮০০২০০৬৯৫২০২ (বুরহান উদ্দিন, ইসলামী ব্যাংক পিএলসি) ২০৫০২২১০২০১৩২৭২০৮ (মোহাম্মদ সেলিম উদ্দিন, ইসলামী ব্যাংক পিএলসি), ০২১০০২৫৫২১৮১১ (বুরহান শান্তা, আএফআইসি ব্যাংক পিএলসি), সাউথইস্ট ব্যাংকের হিসাব মুনাসির ট্রেডার্সে গত ১৬ জানুয়ারি বাকি তিনটি ব্যাংক হিসাব থেকে ২০ হাজার টাকা করে পৃথক লেনদেনের মাধ্যমে পাঠানো হয়। যা আইডি সংশোধনের টাকা হিসেবে প্রাথমিক তথ্য পাওয়া যায়। ওইসব হিসাবধারীদের জিজ্ঞাসাবাদ করলেও অনেক তথ্য বেরিয়ে আসার সম্ভাবনা রয়েছে।
এছাড়া বশির আহমদের নির্দিষ্ট রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা রয়েছে। তার অফিসে যাদের মাধ্যমে তিনি সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন, তারা নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের অনুসারী। যদি দুদক তদন্ত করে তাহলে নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তির নিয়মিত চট্টগ্রাম আঞ্চলিক অফিসে যাওয়া আসা লক্ষ্য করতে পারবে এবং এরাই হলো ওই সকল সিন্ডিকেটের সদস্য। তাছাড়া বশির আহমদ গত কয়েক মাসে চট্টগ্রাম থেকে অবৈধভাবে অর্জিত ঘুষের টাকায় দেশে-বিদেশে ও নামে-বেনামে টাকা পাচার এবং অবৈধ সম্পত্তি গড়েন বলে অনেকের মুখে মুখে।
অভিযোগের বিষয়ে চট্টগ্রাম সিনিয়র জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা বশির আহমদ বলেন, ‘অনলাইনে যেগুলো যাচাই করা যায়, আমরা সেগুলো করি। অনলাইনে না থাকলে সেগুলো যাচাই করার সুযোগ থাকে না। তারপরও আমরা সন্দেহ হলে বাদ দিয়ে দিচ্ছি। সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র আনার জন্য বলে দিই।’
টাকা পয়সা লেনদেনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বাইরে থেকে আমরা এসব শুনি। যদি স্পেসিফিক অভিযোগ পাওয়া যেতো, তবে আমরা ব্যবস্থা নিতে পারতাম। তাছাড়া আমরা অনেক কিছু বিবেচনা করে চেষ্টা করি। অনেক ক্ষেত্রে মানবিক বিবেচনা করে দিতে হয়, আবার দীর্ঘদিন ধরে কষ্ট পাচ্ছে, সেজন্য ছোটোখাটো অনেক বিষয় এড়িয়ে চলারও চেষ্টা করি। সবদিক মিলিয়ে কাজ করি আরকি। মানুষ বাইরে থেকে টাকা লেনদেনের কথা বলে, কিন্তু স্পেসিফিক অভিযোগ তো পাই না। অভিযোগ পেলে আমরা এলার্ট হতাম, আর ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করতাম।’
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সমন্বিত জেলা কার্যালয় চট্টগ্রাম-১ এর উপ-পরিচালক সুবেল আহমদ পূর্বদেশকে বলেন, ‘অভিযোগ গ্রহণের পর আমরা তা কমিশনে পাঠাই। পরে বিধি অনুযায়ী কমিশন যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নিবে’।