টাইফয়েড টিকা নিয়ে গুজব কাম্য নয়

2

চলতি মাসের ১২ তারিখ থেকে শুরু হওয়া টাইফয়েড টিকাদান কর্মসূচি চট্টগ্রামসহ দেশব্যাপী অব্যাহত আছে। সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি (ইপিআই), ইউনিসেফ বাংলাদেশ এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষা ফাউন্ডেশন-এর যৌথ আয়োজনে টাইফয়েড টিকাদান কর্মসূচি অভাবিত সাড়া পাওয়া গেছে। তবে পাশাপাশি টিকার বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা গুজব ছড়ানো হচ্ছে। বাস্তবতা হচ্ছে, এ গুজবের কোন ভিত্তি নেই। গুজব বা টিকা নিয়ে ছড়িয়ে পড়া তথ্যের পক্ষে সত্যতা কোথাও পাওয়া যায় নি। খবর পাওয়া গেছে, এখন পর্যন্ত যারা টিকা নিয়েছেন, তাদের মধ্যে বড় কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। শিশু-কিশোরিরা সকল ভয়-ভীতি দূর করে উৎসাহের সাথে টিকা গ্রহণ করছেন বলে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার (২৩ অক্টোবর) রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে টিকাদান কর্মসূচি নিয়ে আয়োজিত এক সভায় জানানো হয়, সারা দেশে গত দশ দিনে অন্তত ১ কোটি ৭০ লাখ শিশুকে টাইফয়েডের টিকা দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। ৯ মাস থেকে ১৫ বছর বয়সী সকল শিশুকে বিনামূল্যে এ টিকা দেওয়া হচ্ছে। সভায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলেন, ‘দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো পরিচালিত টাইফয়েড টিকাদান কর্মসূচিতে এখন পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রার ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ সাফল্য অর্জিত হয়েছে। তবে শিক্ষকদের আন্দোলনের কারণে কিছু মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে টিকাদানের হার তুলনামূলক কম।’ স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানান, ‘বাংলাদেশে এক মাস থেকে ১৫ বছরের কম বয়সী শিশুরাই টাইফয়েড জ্বরে বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে। সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০২১ সালে বাংলাদেশে আট হাজার মানুষ টাইফয়েড জ্বরে মৃত্যুবরণ করেছেন। এর মধ্যে প্রায় ছয় হাজার জনের বয়স ১৫ বছরের নিচে।’ মূলত, দূষিত পানি ও অস্বাস্থ্যকর খাবারের মাধ্যমে মূলত টাইফয়েড ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু টাইফয়েড মোকাবেলায় দীর্ঘদিন কোন টিকা ও ভ্যাকসিন তৈরি না হওয়ায় তা প্রয়োগ করা সম্ভব হয়নি। তবে দুর্ভাগ্য যে, যখনি টিকার সুযোগটা আমাদের কাছে এসেছে, তখনি পুরনো সেই গুজব ছড়ানো হয়েছে, বলা হচ্ছে, এই টিকা নিলে মেয়েরা ভবিষ্যতে মা হতে পারবে না, ছেলেশিশুরা হারাবে পুরুষত্ব, এই টিকার পেছনে বৈশ্বিক বাণিজ্যের খেলা আছে, বাংলাদেশ গরিব দেশ বলে শিশুদের গিনিপিগ বানানো হচ্ছে এমন সব গুজবে অভিভাবকেরা হয়ে পড়েছেন বিভ্রান্তিতে।
তবে অতীত ইতিহাস জানলে দেখা যাবে, এমন গুজব নতুন নয়। কোভিড টিকা নিয়েও তেমন গুজব ছড়ানোর দিকটি দেখিয়ে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক তাহমিদ আহমেদ একটি জাতীয় দৈনিককে জানিয়েছেন, ‘বলতে গেলে বাংলাদেশে তেমন কিছুই হয়নি; যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যে নেতিবাচক প্রচারে হইচই পড়ে গিয়েছিল। আমরা যখন ছোট ছিলাম, তখন বন্দুকের মতো যন্ত্র দিয়ে কলেরার টিকা দেওয়া হতো। তখনো গুজব ছিল, এ টিকা নিলে মেয়েদের আর বাচ্চা হবে না। এগুলো সবই ভুল তথ্য।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে বলা হয়েছে, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরীক্ষিত ও অনুমোদিত এ টিকা নিরাপদ ও কার্যকর। বাংলাদেশে এ টিকা পরীক্ষামূলকভাবে দেওয়া হচ্ছে না। এটি প্রোটিন ও শর্করা উপাদানে গঠিত, যা শরীরে দীর্ঘস্থায়ী রোগ প্রতিরোধক্ষমতা তৈরি করে। এতে শরিয়ত নিষিদ্ধ কোনো উপকরণ নেই।’
উল্লেখ্য যে, প্রতিরোধযোগ্য মারাত্মক সংক্রামক রোগগুলোর মধ্যে টাইফয়েড জ্বর অন্যতম। ‘সালমোনেলা টাইফি’ নামে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে এই রোগ হয়। দূষিত পানি, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাব ও খাবারের মাধ্যমে টাইফয়েড ছড়ায়। সরকারি এক জরিপের তথ্য তুলে ধরে ইপিআইর উপপরিচালক মো. শাহারিয়ার সাজ্জাদ বলেন, এবার ক্যাম্পেইনে ৪ কোটি ৯০ লাখ শিশুকে টিকা দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। টিকা নেওয়ার জন্য নিবন্ধন অব্যাহত আছে। ১৮ অক্টোবর রাত ১২টা পর্যন্ত ২ কোটির বেশি শিশু নিবন্ধনের আওতায় আসে। এর মধ্যে টিকা নিয়েছে ১ কোটি ৪ লাখের বেশি শিশু। ক্যাম্পেইন চলবে আগামী ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত।
গত বছর জরায়ুমুখ ক্যানসার প্রতিরোধে কিশোরীদের হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস (এইচপিভি) টিকা দেওয়াকে কেন্দ্র করেও নানা গুজব ছড়িয়েছিল। তখনো সংবাদ সম্মেলন করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক গুজব না ছড়ানোর আহবান জানিয়েছিলেন। আমরা লক্ষ করছি, গুজব প্রতিরোধসহ টিকা দিতে উৎসাহিত করতে সরকারের পক্ষ থেকে ধারাবাহিক প্রচারণামূলক কার্যক্রম, জাতীয় অ্যাডভোকেসি সভা, জোরালো রাজনৈতিক সমর্থন আদায়, সংবাদ সম্মেলন, বিভিন্ন পর্যায়ে কমিটি গঠনসহ নানান কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তবে প্রান্তিক পর্যায়ে এ প্রচারণা বেশ দুর্বল বলে মনে হয়ে। এক্ষেত্রে সরকারের মিডিয়া সম্প্রচারসহ বিভিন্ন মসজিদ, উপাসনালয়, মন্দির ও স্কুল-কলেজকে কাজে লাগাতে পারে। পাশাপাশি প্রশাসন ও স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলো পোস্টার, লিফলেট ইত্যাদির মাধ্যমে প্রচারণা জোরদার করতে পারে। আমরা টিকাদান কার্যক্রমের সফলতা কামনা করছি।