জসীম উদ্দিন তালুকদার
দেশবরেণ্য খ্যাতিমান শিক্ষাবিদ ও বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. মো. আহসানুল হক। জ্ঞানের প্রসন্ন প্রভায় আলোকবর্তিকা হয়ে তিনি দেশ-বিদেশে উচ্চ শিক্ষায় ছড়াচ্ছেন জ্ঞানের দ্যুতি। তিনি যেমনি বিদ্বান, জ্ঞানী ও দূরদর্শী তেমনি জ্ঞান-সাধনায় নিবেদিত অসাধারণ পান্ডিত্যের অধিকারী। তাঁর সৌম্য ও প্রশান্ত বিশাল ব্যক্তিত্বের ছায়াতলে শিক্ষালাভ করে জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে আদর্শ মানুষরূপে গড়ে উঠছে অগণিত শিক্ষার্থী। তিনি একজন গুণি, প্রাজ্ঞ শিক্ষক ও গবেষক হিসেবে সর্বজনবিদিত। প্রায় তিন যুগের শিক্ষকতা ও গবেষণায় তিনি দেশ-বিদেশে কুড়িয়েছেন অনেক সুনাম। অধ্যাপক ড. মো. আহসানুল হক বৃহত্তর ঢাকার গাজীপুর জেলার শ্রীপুর উপজেলায় ১৯৭০ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বর্তমানে চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ^বিদ্যালয়ের (সিভাসু) মেডিসিন ও সার্জারি বিভাগে ইপিডেমিওলজি বিষয়ের অধ্যাপক। প্রায় তিন দশকের অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ বরেণ্য এই বিজ্ঞানী গত ১২ আগস্ট থেকে সিভাসু’র ওয়ান হেল্থ ইনস্টিটিউট এর পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। অধ্যাপক ড. হক বাংলাদেশ কৃষি বিশ^বিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সাথে ডক্টর অফ ভেটেরিনারি মেডিসিন(ডিভিএম) এবং ফার্মাকোলজি বিষয়ে এমএস ডিগ্রী অর্জন করেন। পরবর্তীতে যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অফ লন্ডনের অধিনস্থ দ্যা রয়্যাল ভেটেরিনারি কলেজ এবং লন্ডন স্কুল অফ হাইজিন এন্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিন থেকে ইপিডেমিওলজি বিষয়ে দ্বিতীয় এমএসসি ডিগ্রী এবং অস্ট্রেলিয়ার জেমস কুক বিশ^বিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন। অধ্যাপক আহসানুল হক ১৯৯৫ থেকে ১৯৯৮ পর্যন্ত তিন বছর প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ভেটেরিনারি সার্জন হিসেবে রাঙামাটির বিলাইছড়ি উপজেলায় দায়িত্ব পালন করেছিলেন। রাঙামাটিতে তিন বছরের কর্ম জীবনে ড. হক পার্বত্য অঞ্চলের সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করার সুবাদে তিনি পরবর্তীতে শিক্ষকতা ও গবেষণায় বিশেষ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হন। তিনি ১৯৯৮ সালে সেপ্টেম্বর মাসে তৎকালীন চট্টগ্রাম সরকারি ভেটেরিনারি কলেজে ফার্মাকোলজির প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। ২০০৬ সালে কলেজটি বিশ^বিদ্যালয়ে উন্নীত হলে ক্রমান্বয়ে তিনি বিশ^বিদ্যালয়টির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। ২০১৫ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত দুই বছর মেয়াদে অধ্যাপক হক সিভাসু’র ভেটেরিনারি মেডিসিন অনুষদের ডিন এবং ন্যাশনাল ভেটেরিনারি ডিনস কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এর আগে দু’বছর মেয়াদে তিনি বিজ্ঞানের দ্যুতি ছড়ানো আলোকিত শিক্ষক অধ্যাপক ড. মো. আহসানুল হকবিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় পরিচালক (কোর্ডিনেটর) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। দুই মেয়াদে অধ্যাপক হক বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিওলজি, বায়োকেমিস্ট্রি ও ফার্মোকোলজি বিভাগীয় প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়ান হেল্থ ইনস্টিটিউটের একাডেমিক ও রিসার্চ কমিটিরও একজন সদস্য। এছাড়াও তিনি উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা বিষয়ক বোর্ড এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা সাময়িকীর সম্পাদনা পরিষদের সদস্য। চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ^বিদ্যালয়ে ইপিডেমিওলজি এবং এপ্লাইড ইপিডেমিওলজি বিষয়ে এমএস ডিগ্রী এবং জনস্বাস্থ্য (পাবলিক হেল্থ) বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রী (এমপিএইচ) চালুর ব্যাপারে অধ্যাপক হক অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। সিভাসু ও বাংলাদেশের অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আধুনিক শিক্ষা পদ্ধতি যেমন প্রবলেম বেইসড লার্নিং (পিবিএল) ও ইভিডেন্স বেইসড ভেটেরিনারি মেডিসিন (ইবিভিএম) পদ্ধতি চালুর ব্যাপারে তাঁর ভূমিকা ছিল মুখ্য। সিভাসুতে দেশের প্রথম ওয়ান হেল্থ ইনস্টিটিউট স্থাপনের ব্যাপারে অন্যতম প্রধান সংগঠক ছিলেন। তাঁর উদ্যোগে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় সিভাসুতে দেশের প্রথম ভেটেরিনারি ক্লিনিক্যাল স্কিলস ল্যাব স্থাপিত হয়। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক মানের একবছর মেয়াদী ভেটেরিনারি ইন্টার্নশিপ চালু এবং নিয়মিত গবেষণার মাধ্যমে ইন্টার্নশিপকে কার্যকর ও ফলপ্রসূ রাখতে তিনি বিশেষ অবদান রাখেন। ইন্টার্ন ভেটেরিনারিয়ানদের ভারত, থাইল্যান্ড ও য্ক্তুরাষ্ট্রে বিশেষ ক্লিনিক্যাল ট্রেইনিং আয়োজনেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। বিশ্ব প্রাণিস্বাস্থ্য সংস্থার অর্থায়নে সিভাসু এবং যুক্তরাষ্ট্রের টাফটস বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বিনিময় কর্মসূচীর মাধ্যমে সিভাসুর বিভিন্ন ব্যাচের ১৬ জন শিক্ষার্থী যুক্তরাষ্ট্রে উন্নত প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। টাফটস বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০ জন শিক্ষার্থী তাদের সামার রিসার্চ কার্যক্রমের আওতায় বাংলাদেশে আসে। শিক্ষা, গবেষণা ও দক্ষতা আদান প্রদানের মেলবন্ধন হিসেবে কাজ করা উক্ত প্রকল্পের বাংলাদেশে জাতীয় সমন্বয়ক ছিলেন অধ্যাপক ড. হক। সিভাসুতে আন্তর্জাতিক মানের গবেষণাকাজ বেগবান করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং দেশ বিদেশের গবেষকদের অংশগ্রহণে বার্ষিক রিসার্চ কনফারেন্সের মুখ্য উদ্যোক্তাদের একজন অধ্যাপক আহসানুল হক। অধ্যাপক আহসানুল হকের তত্ত্বাবধানে অদ্যাবধি নয়জন শিক্ষার্থী পিএইচডি, তিন জন শিক্ষার্থী এমফিল, ৩৮ জন শিক্ষার্থী এমএস ডিগ্রী অর্জন করেন। তাঁর শিক্ষার্থীদের মাঝে সিভাসু ছাড়াও ওঈউউজই, যুক্তরাজ্যের রয়্যাল ভেটেরিনারি কলেজ, লন্ডন স্কুল অফ হাইজিন এন্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিন, অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়, ডিয়াকিন বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রয়েছে। দেশে এবং আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে অধ্যাপক হক বেশ সমাদৃত তাঁর আধুনিক এবং উদার শিক্ষানীতির জন্যে। অধ্যাপক আহসানুল হক দুই দশক যাবত দেশীয় ও আন্তর্জাতিক অর্থায়নে বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছেন। এখন পর্যন্ত তিনি ১৩টি আন্তর্জাতিক এবং আন্তঃবিভাগীয় গবেষণা প্রকল্পের জাতীয় সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেছেন। যার মধ্যে ১০টি প্রকল্পের কাজ সাফল্যের সাথে শেষ হয়েছে। এছাড়াও লোকাল কোঅর্ডিনেটর এবং কো-ইনভেস্টিগেটর হিসেবে তিনি দশের বেশি গবেষণায় অংশ নিয়েছেন। এই বিস্তৃত গবেষণা কাজের সুবাদে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি বিষয়ক সংস্থা; যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া ও সুইডেনের সরকারি সংস্থা; বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থার সাথে তাঁর কাজ করার সুযোগ হয়েছে। বিভিন্ন গবেষণা ও উন্নয়ন প্রকল্পের আওয়তায় প্রাণিসম্পদ, প্রাণিস্বাস্থ্য, পোলট্রি খাত উন্নয়ন, এন্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স, ওয়ান হেলথ, প্রাণিবাহিত রোগসংক্রমণ ইত্যাদি বিষয়ে তিনি দশটির বেশি পলিসি ডায়ালগ, স্টেকহোল্ডার মিটিং এবং গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করেছেন। পোলট্রি খাতে কর্মরত ভেটেরিনারি ডাক্তারদের দক্ষতাবৃদ্ধির জন্য দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের অংশগ্রহণে ২৫টির বেশি ভার্চুয়াল এবং হ্যান্ডস-অন প্রশিক্ষণের আয়োজন করেছেন। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পোলট্রি খামারিদের জৈবনিরাপত্তা ও খামার ব্যবস্থাপনা বিষয়ে দশের অধিক প্রশিক্ষণের আয়োজন করেছেন। ওয়ান হেলথ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কমিউনিটি হেলথ ওয়ার্কারদের প্রশিক্ষণের আয়োজন করেছেন অধ্যাপক হক।
বাংলাদেশে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়া বার্ড ফ্লু রোগবিষয়ক গবেষণার অন্যতম দিকপাল অধ্যাপক আহসানুল হক এই বিষয়ক গবেষণা ও খামারী পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্যে কাজ করছেন চট্টগ্রাম, ঢাকা, কুমিল্লা, সিলেট, কক্সবাজার, গাজীপুর, ঝিনাইদহ, সাতক্ষীরা, দিনাজপুরসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়। বাংলাদেশে বার্ড ফ্লু প্রস্তুতি বিষয়ক নির্দেশিকা তৈরিতে তাঁর অসাধারণ ভূমিকা রয়েছে। যুক্তরাজ্যের স্বাধীন পলিসি বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান চ্যাথাম হাউজের সাথে যৌথ গবেষণায় অধ্যাপক হক বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি সেক্টরে কর্মরত ভেটেরিনারিয়ানদের কর্মপরিবেশ উন্নয়ন, পোলট্রি খামারিদের আইন কানুন বিষয়ক সচেতনতা এবং ওয়ান হেলথ বিষয়ক পলিসি নিয়ে কাজ করছেন। এর আওতায় বাংলাদেশের ভেটেরিনারি শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং তরুণ ভেটেরিয়ানদের পলিসি বিষয়ক গবেষণা এবং পলিসি ডায়ালগে আরো সক্রিয় অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরি হচ্ছে। তিনি ইস্টার্ন মেডিটারেনিয়ান পাবলিক হেলথ নেটওয়ার্ক এবং যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন(সিডিসি) এর অর্থায়নে বিভিন্ন মেয়াদে ফিল্ড ইপিডেমিওলজি ট্রেনিং প্রোগ্রামের কোর্স ইন্ট্রাকটরদের একজন। মানুষ, প্রাণী ও পরিবেশ স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ন্ত্রণে বিশ্বজুড়ে সমাদৃত ওয়ান হেলথ এপ্রোচ নিয়ে কাজ করা দেশের অগ্রগণ্য গবেষকদের একজন অধ্যাপক হক। তাঁর নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রের USAID, DAI, ACDI/VOCA সহ বিভিন্ন সংস্থার অর্থায়নে একাধিক গবেষণা প্রকল্প দেশে ওয়ান হেলথ সচেতনতা এবং সমন্বিত গবেষণা কাজে সুযোগ তৈরিতে সহায়তা করছে। অধ্যাপক আহসানুল হক এখন পর্যন্ত ১১০টি আন্তর্জাতিক পিয়ার-রিভিউড গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন এবং তিনটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। ৩০টির বেশি আন্তর্জাতিক রিসার্চ কনফারেন্সে তিনি গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছেন। তাঁর উপস্থাপিত গবেষণা প্রবন্ধ যুক্তরাজ্যেরে প্রাচীনতম ভেটেরিনারি শিক্ষা বিষয়ক সম্মেলনে প্রথম স্থান অর্জন করেছিল।
গবেষণায় বিশেষ কৃতিত্বের জন্য অধ্যাপক আহসানুল হক ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন স্কলারশিপ ইন ভেটেরিনারি ইপিডেমিওলজি এবং অস্ট্রেলিয়ান লিডারশীপ এওয়ার্ডে ভূষিত হয়েছিলেন। তিনি অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ড কলেজ অফ ভেটেরিনারি সাইন্টিস্টের ইপিডেমিওলজি চ্যাপ্টারের আজীবন সদস্য। এছাড়াও ওয়ান হেল্থ বাংলাদেশ, বাংলাদেশ কৃষিবিদ ইনস্টিটিউট এবং বাংলাদেশ ভেটেরিনারি এসোসিয়েশনের আজীবন সদস্য। তিনি বাংলাদেশ ভেটেরিনারি এসোসিয়েশনের আহবায়ক কমিটির সদস্য হিসেবেও কাজ করছেন। অধ্যাপক হক একাধিক গবেষণা জার্নালের সম্পাদক হিসেবেও কাজ করছেন। ওInternational Veterinary Student Association (IVSA) এবং One Health Young Voice Bangladesh এর উপদেষ্টা হিসিবেও দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি কর্মক্ষেত্রে দ্রুততার সাথে সিদ্ধান্ত গ্রহণে পারঙ্গমতাসহ সৃজনশীল ও উদ্ভাবনী কাজে আগ্রহী এবং প্রায় প্রতিটি কর্মক্ষেত্রেই এর ছাপ রেখেছেন। শিক্ষা ও গবেষণায় তাঁর বিশেষ অবদান ও নেতৃত্বের জন্য অধ্যাপক আহসানুল হক দেশে-বিদেশে স্বীকৃত। বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে প্রাণিসম্পদ ও প্রাণিস্বাস্থ্য উন্নয়নে তাঁর ভূমিকা অসামান্য।
লেখক : প্রাবন্ধিক