নারী সংস্কার কমিশনের সুপারিশ যখন ‘অবমাননাকর’ আক্রমণের মুখে পড়ছে, তখনই ‘সমতা ও ন্যায্যতার’ দাবিতে ঐক্যবদ্ধ থাকার বার্তা এল ‘নারীর ডাকে মৈত্রীযাত্রা’ থেকে। গতকাল শুক্রবার বিকেলে ঢাকার মানিক মিয়া এভিনিউয়ে জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে এই সমাবেশে জড়ো হয়েছিলেন হাজারো নারী। শুধু নারী নয়, অন্যান্য লিঙ্গ বৈচিত্র্যের বহু মানুষ এই আয়োজনে অংশ নিয়ে প্ল্যাকার্ডে তুলে ধরেন সাম্যের দাবি। যে ক্ষমতা কাঠামো ‘জুলুমবাজি’ জিইয়ে রাখে, সেই কাঠামো ভাঙার প্রত্যয়ের কথা বলা হয় আয়োজকদের ঘোষণাপত্রে। খবর বিডিনিউজের
সমাবেশে অংশ নিতে আসেন জুলাই অভ্যুত্থানে আহত ও নিহতদের স্বজন, মানবাধিকারকর্মী, পেশাজীবী, শিল্পী, গার্মেন্টস শ্রমিক, চা-বাগানের শ্রমিক, যৌনকর্মী, প্রতিবন্ধী, অধিকারকর্মী, হিজড়া, নানা লিঙ্গ বৈচিত্র্যের মানুষ এবং অন্যান্য প্রান্তিক সম্প্রদায়ের মানুষ। বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনের কর্মীদেরও সমাবেশ প্রাঙ্গণে দেখা যায়। তবে তারা কেউ সংগঠনের ব্যানারে সমাবেশে আসেননি বলে আয়োজকরা জানান। সমাবেশের দর্শক সারিতে দেখা যায় সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি)নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, বাংলাদেশ জাসদের নাজমুল হক প্রধান ও ডা. মুশতাক হোসেন, অধিকারকর্মী খুশি কবির, সংগীতশিল্পী সায়ান, নাট্যকার সামিনা লুৎফা, অধ্যাপক রেহনুমা আহমেদসহ অনেককে। তারা কেউ মঞ্চে উঠে বক্তব্যও দেননি।
কারা আয়োজক : সমাবেশে এসেছিলেন আবৃত্তিশিল্পী কাজী বুশরা আহমেদ তিথি ও আশরাফুল হাসান। বুশরা আহমেদ বলেন, এই সমাবেশের আয়োজক কারা, তা জানি না। তবে এখানে এসেছি, আমার মনে হয়েছে আয়োজনটি খুবই জরুরি। নারীরা ঘরে-বাইরে নানা নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। এখন নানাভাবে নারীদের দমিয়ে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে হবে। এজন্যই সংহতি জানাতে এসেছি।
আয়োজকেরা বলছেন, এই আয়োজনটি ‘সকল মানুষের’ আয়োজন। নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তি বা সংগঠন কিংবা প্রতিষ্ঠান এই মৈত্রীযাত্রার আয়োজক নয়। সমাবেশে প্রাঙ্গণে আলাদা করে আয়োজকদের কেউ গণমাধ্যমের সঙ্গে কথাও বলেননি। তবে অনুষ্ঠান মঞ্চ থেকে ঘোষণা দিয়ে বলা হয়, এখানে নানা শ্রেণিপেশার মানুষ এসেছেন। কেউ যদি গণমাধ্যমে কোনো বক্তব্য দেন, তবে সেই দায় তার ব্যক্তিগত। আয়োজকদের সঙ্গে তার কোনো সম্পৃক্ততা নেই।
প্ল্যাকার্ডে নানা দাবি : অনুষ্ঠানের সূচনা হয় জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে। পরে চা বাগানের শিল্পীরা গানে গানে শোনান তাদের বঞ্চনার কথা। গান, নাচ, পাঠে নারীদের অধিকারের কথাও উঠে আসে। দর্শক সারিতে আসা কেউ কেউ প্ল্যাকার্ডে তুলে ধরেন নানা দাবি। প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল ‘মায়ের আত্মত্যাগ নিয়ে শুধু কবিতা লিখো না, তার শ্রমের মূল্য দাও’; ‘জমি, ঘর, উত্তরাধিকার/ নারীর চাই সম-অধিকার’; ‘কৃষিতে নারীর কাজকে স্বীকৃতি দিতে হবে’; ‘নারী পরিবারে পুরুষের তুলনায় প্রায় ৮ গুণ বেশি কাজ করে- মজুরি নেই, নেই স্বীকৃতি’; ‘তোলো আওয়াজ সমতাভিত্তিক শ্রমের দায়িত্ব পালনে’; ‘নারীর ওপর মবের আঘাত/ইন্টেরিম কি দেবে জবাব ‘; ‘চোখের সংযম কই’; ‘আদিবাসী নারীর অধিকার নিশ্চিত কর’; ‘আমরাই তনু/আমরাই মুনিয়া/আমরাই নুসরাত’; ‘কল্পনা চাকমা কোথায়?’; ‘যৌন কর্মীদের উচ্ছেদ নয়’; ‘পাহাড়িদের পর্যটনের অভিশাপ থেকে মুক্ত কর’; ‘বমদের উপর রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন বন্ধ কর’ এরকম নানা স্লোগান।
সমাবেশে আয়োজকরা যে ঘোষণাপত্র পাঠ করেছেন, তাতে কয়েকটি দাবি তুলে ধরেছেন। সেখানে বলা হয়েছে- অন্তর্বর্তী সরকারকে তার সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করতে হবে। বিশেষত নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সহিংসতার হুমকি, নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন ঘিরে গুজব ও অপপ্রচার, এবং ধর্মীয় মূল্যবোধকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে আতঙ্ক সৃষ্টির বিরুদ্ধে সরকারকে ব্যবস্থা নিতে হবে। যারা আমাদের সমর্থন চায়- নির্বাচনী অঙ্গীকারের মাধ্যমে হোক বা সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে হোক। তাদের স্পষ্ট করতে হবে- নারী, শ্রমিক, জাতিগত, ধর্মীয়, ভাষাগত ও লিঙ্গীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার এবং এসব জনগোষ্ঠীর পূর্ণ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ব্যক্তিগত মুক্তির বিষয়ে তাদের অবস্থান। বিশেষ করে আসন্ন নির্বাচন থেকে তাদের প্রার্থীদের অন্তত শতকরা ৩৩ ভাগ (ক্রমান্বয়ে জনসংখ্যার অনুপাতে) নারী হতে হবে। নারী ও প্রান্তিক জনগণের শিক্ষা, রাস্তা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে অন্তর্বর্তী সরকারকে আশু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।