জসিম উদ্দিন মনছুরি
বিগত স্বৈরাচারী সরকার ক্ষমতার মসনদে টিকে থাকার জন্য জুলাই আন্দোলন দমনে গণহত্যা চালায়। গণহত্যায় ব্যবহার করা হয় মারণাস্ত্র। আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে প্রায় ১৪০০ জনকে হত্যা করা হয়। যার ১৩% শিশু। বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে গণহত্যা পরিচালিত হয়েছে বলে জাতিসংঘ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। গণহত্যায় অংশগ্রহণ করে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও সেনাবাহিনী পর্যন্ত। আন্দোলন দমাতে হেলিকপ্টার থেকে গুলি বর্ষন করা হয়। সাম্প্রতি জেনেভা থেকে জাতিসংঘের তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ১২৩ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের গুরুতর তথ্য উঠে এসেছে। তদন্ত প্রতিবেদন স্বচ্ছ করতে বিকটিম অভিযুক্তসহ তাদের আত্মীয়-স্বজন ও সরকারি কর্মকর্তাদের কাছ থেকে ২৩০ টি জবানবন্দী গ্রহণ করা হয়। গণহত্যার নৃশংসতার তথ্য জনসমক্ষে আসলে গা শিউরে উঠে। অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার ৬ মাস অতিবাহিত করলেও এরই মাঝে ১২ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমসহ সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস আয়নাঘর পরিদর্শন করেন। আয়নাঘর পরিদর্শনের সময় হাই ভ্যালু বন্দিদের সাক্ষাৎকার ও তাদের উপর নির্মম নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র জনসমক্ষে প্রকাশিত হয়।
আয়নাঘর পরিদর্শন শেষে ড. মুহাম্মদ ইউনূস সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন এটা যেন জাহেলিয়া যুগের নির্মমতাকেও হার মানায়। আয়নাঘরে পাওয়া যায় একটি চেয়ার। যেই চেয়ারে ইলেকট্রিক শক দেওয়া হতো। ঢাকায় শুধুমাত্র ৭০০ থেকে ৮০০ আয়না ঘরের সন্ধান পাওয়া যায়। আয়নাঘর পরিদর্শনের সময় ভারতীর সাংবাদিকের একটি ফেসবুক পোস্ট ব্যাপক আকারে ভাইরাল হয়। ভারতীয় মিডিয়া যখন বাংলাদেশ নিয়ে অপপ্রচারে ব্যস্ত তখন তিনি সাহসিকতার সহিত ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের নির্মমতার কথা ফেইসবুক পোস্টে তুলে ধরেন। আয়নাঘর পরিদর্শনের খবর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমসহ জাতীয় ও স্থানীয় গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হতে থাকে। কথিত আয়নাঘরের ভয়াবহতার চিত্র জনসমক্ষে আসলে অনেকেই অশ্রæ সংবরণ করতে পারেননি। জাতিসংঘের তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পেলো হাসিনা সরকারের গণহত্যার ও নির্যাতনের নথিপত্র।
জাতিসংঘ প্রতিবেদনে চট্টগ্রাম, ঢাকা, রাজশাহী, খুলনা, বগুড়াসহ আটটি শহরে সুনিপূণভাবে তদন্ত করা হয়। এসব অঞ্চলে আন্দোলন দমনে নির্মম হত্যাকান্ড পরিচালিত হয়।সেখানে তারা সশরীরে গিয়ে তদন্ত প্রতিবেদন প্রস্তুত করেন। তদন্ত প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয় বিগত সরকারের উচ্চপদস্থ আমলাদের সরাসরি পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে গণহত্যা পরিচালনার ভয়াবহ চিত্র। সরকারের প্রধান হাসিনার নির্দেশে সরাসরি গুলি ও হত্যাকান্ড পরিচালিত হওয়ার খবর জনসমক্ষে প্রকাশিত হয়। একাজে সরাসরি সহায়তা করেছে ডিজিএফআই, এনএসআই, ডিবি, এসিবি, এনটিএমসি, সিটিটিসি এর শীর্ষ কর্মকর্তারা। পতিত স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার সরাসরি অংশগ্রহণ ও নির্দেশে এসব কর্মকর্তারা হত্যাকান্ডে লিপ্ত হয়। হত্যাকান্ডে নারী ও শিশু পর্যন্ত রেহাই পায়নি।
শেখ হাসিনা ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য আন্দোলনকারীদের হত্যা করে লাশ গুম করার জন্য বারবার তাগাদা দেন আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মধ্যে পুলিশ, র্যাব, বিডিআর ও সেনাবাহিনী যুক্ত থাকার খবর প্রকাশিত হয়। এমনকি সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে অন্তত তিনটি স্থানে গুলিবর্ষন করা হয়। সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণে অন্তত একজন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। যা আন্তর্জাতিক আইনের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। তদন্ত প্রতিবেদনে ৪৪ টি সুপারিশ করা হয়। তন্মধ্যে র্যাব ও এমটিসিকে বিলুপ্ত করার সুপারিশ করা হয়। সুপারিশে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করণ তবে মৃত্যুদন্ডের বিরোধিতা করা হয়।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় এটা আন্তর্জাতিক আদালতের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ এভিডেন্স হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। অপরাধীদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়। বিগত আওয়ামী সরকারের ১৬ বছরের দুঃশাসনে হত্যা, গুম ও অপহরণের শিকার হয়েছে অসংখ্য নীরিহ মানুষ। সীমাহীন লুটপাট, অর্থপাচার, দুর্নীতি ও অবৈধ লেনদেনসহ ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হওয়া বাংলাদেশে একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল একমাত্র আওয়ামীলীগ ও শেখ হাসিনার। ভারতের মদদে শেখ হাসিনা ভোটবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে বারবার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে জনগণের উপর যে স্টিম রোলার চালিয়েছে তা ইতিহাসে ভয়াবহ অধ্যায় হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। বিরোধী মদকে দমনের জন্য এমন হেন কাজ নাই শেখ হাসিনা সরকার করেনি। বিরোধীদেরকে দমনের জন্য তার কথিত আয়নাঘর ছিল নির্যাতনের গোপণশেল। এ আয়না ঘরে শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এক যুগেরও বেশি ধরে অনেক বন্দী নির্মমতার শিকার হয়েছে। এই আয়না ঘরের চিত্র এখন দেশ ও বিদেশে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নির্মম ভয়াবহতার চিত্র।
জুলাই আন্দোলনকে প্রতিহত করার জন্য শেখ হাসিনার সরাসরি নির্দেশে ছাত্র জনতার উপর নির্মম হত্যাকান্ড পরিচালিত হয়। এই হত্যাকান্ডের জন্য বরাবরই হাসিনাকে অভিযুক্ত করা হলেও তা ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং এর মাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে ভয়াবহতার চিত্র সারা বিশ্বের কাছে উন্মোচিত হলো। জাতিসংঘ তদন্ত সংস্থার প্রতিবেদনে এও বলা হয় এর চেয়েও ভয়াবহ চিত্রের প্রতিবেদন তাদের কাছে রয়েছে পর্যায়ক্রমে তারা তা সরবরাহ করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন। প্রয়োজনে তারা তা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রকাশ করার এবং সহযোগিতা করার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। জুলাই গণহত্যার তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশিত হলেও জনমনে দেখা দিয়েছে শঙ্কা এই গণহত্যার বিচার আদৌ সম্ভব হবে কিনা? দেশবাসী ও ভুক্তভোগীদের প্রত্যাশা এবং দাবি হচ্ছে অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার এত অকাট্য প্রমাণ পাওয়ার পর যেন থেমে না থাকে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক আদালতে দ্বারস্থ হয়ে শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে কঠিন শাস্তির মুখোমুখি করা। তাহলেই গণঅভ্যুত্থানের শহীদদের আত্মা শান্তি পাবে। ভবিষ্যতে গণহত্যা চালাবার মত সাহসী হবে না আর কেউ। এখন সময় এসেছে গণহত্যার বিচার দ্রæত ত্বরান্বিত করা। দেশের ১৮ কোটি জনগণের দাবি ও প্রত্যাশা অতি দ্রুত সময়ে স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিচারের আওতায় এনে কঠিন শাস্তির মুখোমুখি করা।
লেখক : প্রাবন্ধিক