মহিউদ্দিন ইমন
জীবন! এক অচেনা পথ, বহু রঙের গল্প, অনিশ্চিত পূর্ণতা। আমরা অবিরাম ছুটে চলি এই পথে, হাসি কাঁদি মিশে এক অপূর্ব মেলোডিতে। কখনো জয়, কখনো পরাজয়, কখনো উচ্চবাস, কখনো হতাশা- জীবন ঘটে চলে অবিরাম গতিতে। জীবন হলো এক অদ্ভুত যাত্রা, যেখানে প্রতিটি মুহূর্ত নতুন একটা গল্প লেখে। কখনো হাসির রঙে ভরে ওঠে, কখনো দুঃখের ছায়ায় ঢেকে যায়। এই উত্থান-পতন, সুখ-দুঃখের মাঝেই লুকিয়ে থাকে জীবনের আসল সৌন্দর্য। জীবন নিজেকে খুঁজে পাওয়ার জন্য নয়। জীবন নিজেকে সৃষ্টির মাঝেই। জীবন চলার পথে বাধা আসতেই পারে তাই বলে থেমে যাওয়ার কোনো অবকাশ নেই। যেখানে বাধা আসবে সেখান থেকেই আবার শুরু করতে হবে।
এমন অনেক ব্যর্থ লোক আছে যারা জীবনের হাল ছেড়ে দেওয়ার সময় বুঝতে পারেনি যে তারা সাফল্যের কতটা কাছাকাছি ছিল। জীবন একটা মুদ্রার মতো। আপনি এটি আপনার ইচ্ছামত ব্যয় করতে পারেন, কিন্তু আপনি এটি শুধুমাত্র একবার ব্যয় করেন।মানুষ জীবনে বারবার ব্যর্থ হয় এবং সে কারণেই সফল। জীবন মানে ঝড় কেটে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করা নয়, এটা বৃষ্টিতে নাচতে শেখা।
আমাাদের কোন খারাপ কথা ভাবার আগে, এমন কারো কথা ভাবার দরকার যে কথা বলতে পারে না। কোন খাবারের স্বাদ নিয়ে অভিযোগ করার আগে, এমন কারো কথা ভাবা যার খাওয়ার জন্য কিছুই নেই। জীবন নিয়ে অভিযোগ করার আগে, এমন কারো কথা ভাবা যে খুব অল্প বয়সে মারা গেছে। অপরিচ্ছন্ন ঘর নিয়ে তর্ক করার আগে, রাস্তায় বসবাসকারী মানুষদের কথা ভাবা। কতদূর গাড়ি চলে তা ভাবার আগে, এমন কারো কথা ভাবা যে একই দূরত্ব পায়ে ভ্রমণ করে। যখন হতাশাজনক চিন্তা আমাদের হতাশ করে, তখন মুখে একটা হাসি ফোটানো যাদের কিছুই নেই তাদের তুলনায় আমাদের যা কিছু আছে তার জন্য আল্লাহকে ধন্যবাদ জানানো দরকার। মনে রাখা প্রয়োজন এখন আমার যা কিছু আছে তা অন্য কারো কাছে স্বপ্ন।
জীবনের সবকিছুই আপেক্ষিক,কারো মার্সিডিজ থামছে রাতের গভীরে নিষিদ্ধ পল্লীতে, ঘরে অপেক্ষারত স্ত্রী দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। কেউ ভাঙা ঘরে থেকে স্ত্রীকে নিয়ে অবিরত স্বপ্নের জোয়ারে ভাসছে। কেউ ভাবছে আর কয়েকটা দিন! ডিভোর্স পেপারে সাইন করলেই মুক্তি। কেউ কেউ আবার একটা সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার রজন্য অবিরাম যুদ্ধ করে চলছে। কেউ সদ্যোজাত সন্তানকে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে দায়মুক্ত হতে চাইছে। আবার কেউ একটা সন্তানের জন্য সারাটা জীবন হাহাকার করছে! কেউ বছরে কতোজন ভালবাসার মানুষ বদলে ফেলছে! কেউ আবার তার ভালবাসার মানুষের জন্য বছরের পর বছর অপেক্ষা করে চলছে।
কেউ দামি শাড়ি হাতে পেয়ে তবু খুশি নয়! আবার কেউ তাঁতের নতুন শাড়ির গন্ধ বারবার শুঁকছে। কেউ প্রিয়জন এর কাছ থেকে সোনা বা হিরের চুড়ি পেয়ে খুশি নয়, কেউ প্রিয়জন এর কাছ থেকে পাওয়া কাঁচের চুড়িতে স্বর্গের সুখ খুঁজে পাচ্ছে। কেউ লাখ টাকার ডাইনিং টেবিলে বসেও তৃপ্তি সহকারে খেতে পারছেনা! কেউ পেঁয়াজ, কাঁচালঙ্কা কচলিয়ে গোগ্লাসে পান্তা গিলছে।
কারো দামি খাটে শুয়েও ঘুমের ওষুধ খেতে হচ্ছে! কেউ আবার হিমেল হাওয়ায় অঘোরে ঘুমোচ্ছে।
কারো পড়ার টেবিলে নতুন বইয়ের সমারোহ কিন্তু পড়ার ইচ্ছে নেই। কেউ আবার পুরাতন বইয়ের দোকান চষে বেড়াচ্ছে, পকেট খালি বলে! কেউ বিলাসবহুল গাড়িতে বসে চিন্তিত, সন্তানগুলো মানুষ হলোনা! এতো সম্পত্তি রাখতে পারবেতো? কেউ পায়ে হেঁটে পথ চলছে, আর মনে মনে ভাবছে সন্তানতো মানুষ করতে পেরেছি!
আসলে এটাই বাস্তবতা। সুখ এবং শান্তি সর্বদাই আপেক্ষিক। কারো সব থেকেও ‘সুখ’ জিনিসটাই নাই, আবার কারো বাকি সব ঘাটতি থাকলেও সুখটা আছে! কেউ দুইবেলা খাওয়ার জন্য সারাদিন হাটে, আবার কেউ খাবার হজম করার জন্য হাটে। জীবন যেখানে যেমন। কোন গুনাহতে লিপ্ত হওয়ার ইচ্ছে প্রবল হয়ে উঠলে ভাববেন এই গুনাহের কারণে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা যদি আমার জীবন থেকে বারাকাহ উঠিয়ে নেন? আমাকে দেওয়া নিয়ামতগুলো তিনি যদি এই গুনাহের কারণে ছিনিয়ে নেন আমার কাছ থেকে, তখন কেমন হবে আমার জীবন?
আল্লাহর দেওয়া অনেক নিয়ামত আপনার জীবনে বিদ্যমান- শারীরিক সুস্থতা, বাবা-মা’র বেঁচে থাকা, সন্তানাদি, ভালো একটা চাকরি, ভালো একটা ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান, ভালো একটা ক্যারিয়ার। আপনি ভাববেন- যে পাপে আপনি এখন লিপ্ত হতে যাচ্ছেন তার শাস্তি হিসেবে যদি আপনার শরীরে বাসা বাঁধে কোন মরণব্যধি? যদি বাকি জীবনটা আপনাকে দৌড়াতে হয় হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে কেমন হবে তখন জীবন?
যদি এই পাপের কারণে আল্লাহ আপনাকে আপনার বাবা-মা’র আদর স্নেহ থেকে চিরতরে বঞ্চিত করেন, যদি আপনার সন্তানের বাবা ডাক শোনা থেকে আপনাকে বঞ্চিত করেন, যদি তিনি কেড়ে নেন আপনার প্রিয় চাকরিটা? যদি আপনার ব্যবসায়ে তিনি ধ্বস নামান কেমন উপভোগ্য হবে জীবনের সেই সময়গুলো?
ভাববেন কোনটা অধিক বেশি দরকারি? আল্লাহর ক্রোধ থেকে বেঁচে নিয়ামতগুলো নিয়ে বেঁচে থাকা? নাকি, সাময়িক আনন্দের ওই পাপে নিজেকে ভাসিয়ে দেওয়া?
আত্মসম্মান বা ইজ্জত চলে গেলে আপনার অনেক কিছুই যায় আসে কিন্তু আপনি মানুষটি হঠাৎ করেই চলে গেলে কারোর কিচ্ছু যায় আসে না। একবার দু’চোখ বন্ধ করে ভেবে দেখুন একি ছাদের নিচে বসবাস করা মানুষগুলোর জীবনও জাগতিক সকল কর্মকান্ড আপনি বিহীনও একেবারেই স্বাভাবিক। আপনার কথা ভেবে কেউ এখন আর জ্ঞান হারায় না, আপনার জন্য কারো কোন কিছুই আটকে থাকেনি। অথচ তাদের জন্য এতো সবকিছু করে যাওয়া আপনি ঐখানে ঠিকই আটকে যাবেন! দুনিয়ার দুর্নীতি দমন কমিশন থেকে বাঁচতে পারলেও আখেরাতের প্রথম প্রহরেই আপনি মুনকির নকিরের কমিশনের কাছে ধরা খেয়ে যাবেন, অতএব অর্থহীন নয়” সময় থাকতেই জীবনকে অর্থবহ করে তুলুন।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক