জিমনেসিয়াম মাঠেই প্রাণ ফিরে পাবে পাঠক

1

গত বছর ২০২৪ সালে জিমনেসিয়ামের মাঠ ছেড়ে বাধ্য হয়ে অমর একুশে বইমেলার আয়োজন করতে হয়েছিল সিআরবির সবুজীয়া উদ্যানে। বৈশাখী মেলাসহ বিভিন্ন সময় নানা খেলাধূলা ও মেলার আয়োজন সিআরবির শিরীষতলায় হলেও তা হতো দিনব্যাপী বা কিছু সময়ের জন্য। কিন্তু একাধারে মাসব্যাপী একটি মেলা সিআরবিতে আয়োজনের বিষয়ে বই সংশ্লিষ্ট লেখক, পাঠক, প্রকাশকসহ অনেকের দ্বিমত থাকলেও তৎকালীন আমলাতান্ত্রিকতার ভেড়াজালে আটকে গিয়েছিল জিমনেসিয়ামের মাঠ ব্যবহারের অনুমতি। ফলে সিআরবির বিকল্প মাঠ খুঁজে না পাওয়ায় এখানেই বইমেলার আয়োজন হয়েছিল। মেলাটি শেষ পর্যন্ত জমে উঠলেও মেলায় প্রবেশ পথে সারি সারি খাবারের ভাসমান দোকান, হকার-ফেরিওয়ালা ও নানা বর্ণের টোকাইদের উৎপাতে অতীষ্ট হতে হয়েছিল মেলায় অভ্যাগতদের। এছাড়া ধূলোবালিতো ছিলই। কেনাকাটার চেয়ে দর্শনার্থীদের ভীড়ও ছিল বেশি। আলোচনা মঞ্চ ও সাংস্কৃতিক মঞ্চের মাইকের আওয়াজও বইমেলার গাম্ভির্যতা খুব একটা রক্ষা করা যায় নি। সব মিলে মেলা চলাকালিন চট্টগ্রামের স্থানীয় ও জাতীয় সংবাদপত্রগুলোর প্রতিবেদনে, সম্পাদকীয় ও উপ-সম্পাদকীয়তে বহু লেখালেখি হয়েছিল বইমেলার জন্য একটি স্থায়ী মাঠের বন্দোবস্ত করা নিয়ে। কিন্তু কবে নাগাদ চট্টগ্রামে বইমেলার জন্য একটি মাঠের যোগান হবে, তা বলা মুশকিল। এরমধ্যে এবার জিমনেসিয়ামে অমর একুশে বইমেলার আয়োজন কিছুটা হলেও স্বস্তি দিয়েছে চট্টগ্রামের বইপ্রেমিকদের। এজন্য চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন প্রশংসা পেতে পারেন। আমরা সম্প্রতি মেয়রের নানা তৎপরতা ও ভ‚মিকায় কিছুটা আশাবাদি। তিনি চেষ্টা করলে বইমেলার জন্য চট্টগ্রামে একটি স্থায়ী ব্যবস্থা করা যাবে-এমনটি আশা করা যায়। গতবছর বইমেলা চলাকালীন দৈনিক প্রথম আলোর সম্পাদকীয় পাতায় কবি ও সাংবাদিক ওমর কায়সার চট্টগ্রামে বইমেলার জন্য একটি স্থায়ী জায়গার ব্যবস্থা না হওয়ার কষ্ট থেকে লিখেছিলেন,‘স্বাধীনতার পর অর্ধশতকেরও বেশি বছর পার হয়ে গেল, চট্টগ্রামে বইমেলার জন্য একটি স্থায়ী জায়গা পাওয়া গেল না। এই দুঃখ এখানকার বইপ্রেমী, সংস্কৃতিকর্মী, লেখক, প্রকাশকদের বড় পীড়া দেয়। বিশেষ করে ভাষার মাস কাছে এলে এই বঞ্চনার কথা সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হতো।’ জানিনা চট্টগ্রামবাসীকে এ বঞ্চনা আর কতদিন সয়ে যেতে হবে! উল্লেখ্য যে, চট্টগ্রামের প্রথম বইমেলাটি হয় জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের উদ্যোগে ১৯৭৩ সালে মিউনিসিপ্যাল স্কুলের মাঠে। এরপর জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রকে আর পাওয়া যায় নি, পরবর্তীতে তরুণ কবি-সাহিত্যিকরা চট্টগ্রামের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে টেবিল নিয়ে তাঁদের ছোট কাগজের পসরা সাজাতেন। মানুষ আগ্রহ ভরে এক পয়সা-দুই পয়সায় লিটল ম্যাগাজিনগুলো কিনতেন। ২১ ফেব্রুয়ারির দিনে শহীদ মিনারে টেবিলে বই বিক্রি চলেছে দীর্ঘদিন। এরপর আশির দশকে চট্টগ্রামে আর কোন বইমেলার আয়োজন হয়েছিল কিনা তার সঠিক তথ্য নেই। তবে নব্বই দশক থেকে আবারও বইমেলা শুরু হয় নগরীতে। চট্টগ্রামের মুসলিম ইনস্টিটিউটের মাঠে ১৯৯০ সালে বইমেলা শুরু করে চট্টল ইয়ুথ কয়ার নামের একটি সংগঠন। প্রথম বছর এলোমেলোভাবে হলেও পরবর্তী সময় চট্টল ইয়ুথ কয়ারের এই উদ্যোগকে সহায়তা করেন সাংবাদিক, কবি, লেখক ও সংস্কৃতিকর্মীরা। তখন চট্টগ্রামে দু-একটি প্রকাশনা সংস্থা ছিল। বেশির ভাগ বই লেখকের উদ্যোগেই প্রকাশ পেত। টানা ১২ বছর ইয়ুথ কয়ারের বইমেলা চলেছে। পরবর্তী সময়ে তৎকালীন মেয়র প্রয়াত এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর আগ্রহে বইমেলার উদ্যোগ নেয়া হয়। ১৯৯৯ সাল থেকে তিনি লালদীঘির মাঠে বইমেলার আয়োজন করেন। একইসময়ে ইয়ুথ কয়ার মুসলিম ইনস্টিটিউট মাঠে আবার কিছুদিন পর ডিসি হিলেও সৃজনশীল প্রকাশকদের ব্যানারে বইমেলার আয়োজন শুরু হয়। কাছাকাছি তিন জায়গায় বইমেলার আয়োজন চললেও বাস্তবে কিন্তু কোথাও বই নেই, প্রকাশক নেই, পাঠক নেই একটা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি। ২০০৮ সালে চট্টগ্রামের সৃজনশীল প্রকাশক পরিষদ মুসলিম হলের সামনে আবার বইমেলা শুরু করে। এরকম একাধিক মেলার কারণে বইয়ের পাঠক, লেখক আর প্রকাশকের কোনো উদ্দেশ্য সফল হতো না। এ পরিস্থিতি চলেছে ২০১৮ সাল পর্যন্ত। অবশেষে ২০১৯-এ তৎকালীন মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের হস্তক্ষেপে সিটি করপোরেশন ও চট্টগ্রামের সৃজনশীল প্রকাশনা সমিতি, কবি-লেখকদের সম্মিলিত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে একক এবং অভিন্ন আয়োজনে চট্টগ্রামের বইমেলা অনুষ্ঠিত হয় নগরীর এম এ আজিজ স্টেডিয়ামের জিমনেসিয়াম মাঠে। শতাধিক নামী প্রকাশনা এ বইমেলায় অংশ নেয়। ঢাকা থেকেও দেশখ্যাত অনেক প্রকাশনা অংশগ্রহণ করেন।
এবার আবারও চট্টগ্রাম এম এ আজিজ স্টেডিয়ামের জিমনেসিয়াম মাঠে বইমেলা ফিরে আসায় লেখক, পাঠক ও প্রকাশক সকলে উচ্ছ¡সিত। ইতোমধ্যে ঢাকা থেকে শতাধিক প্রকাশনাসহ চট্টগ্রাম থেকেও বড় সংখ্যায় প্রকাশনা অংশগ্রহণ করার খবর পাওয়া গেছে। আমরা আমা করি, এবারের বইমেলা আরো বেশি আকর্ষণীয় ও পাঠক সমাগম ঘটবে। তবে নিরাপত্তা, শৃঙ্খলা এবং পরিবেশ এ তিনটি বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের গভীর নজর দিতে হবে। আমরা অমর একুশে বইমেলার সফলতা কামনা করছি।