জিনাত আজমের জীবন ও কর্ম

2

রোকসানা বন্যা

চট্টগ্রাম, ২১ জুন ২০২৫ গত শনিবার এক নক্ষত্র পতন হলো বাংলা সাহিত্যের রম্য জগতে। ৭৬ বছর বয়সে পরলোকগমন করলেন চট্টগ্রামের প্রথিতযশা লেখিকা, সংগঠক এবং সমাজসেবিকা জিনাত আজম। তার মৃত্যুতে সাহিত্য অঙ্গনে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। চট্টগ্রামের লেডিস ক্লাবের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট, নারীকণ্ঠের উপদেষ্টা, চট্টগ্রাম একাডেমির জীবন সদস্য, চিটাগাং উইম্যান চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সদস্য, ইনার হুইল ক্লাবসহ অসংখ্য সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এবং চট্টগ্রাম লেখিকা সংঘের সভাপতির মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত জিনাত আজম তার লেখনী ও কর্মের মাধ্যমে অগণিত পাঠকের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছিলেন।

এক বর্ণিল জীবন : জিনাত আজম ছিলেন একাধারে রম্য লেখিকা, কলামিস্ট, সমাজসেবিকা এবং একজন গুণী সংগঠক। তার লেখনীতে যেমন হাস্যরস ও তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ উঠে আসত, তেমনি সামাজিক অসঙ্গতি এবং দৈনন্দিন জীবনের নানা দিকও তিনি তুলে ধরতেন সরস ভঙ্গিমায়। পারিবারিক জীবন, সামাজিক রীতিনীতি, এমনকি নিজের জীবনের ছোট ছোট ঘটনাও তার কলমে হয়ে উঠত এক একটি মজার গল্প। তার লেখার প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল সহজবোধ্যতা এবং সাবলীলতা, যা পাঠককে সহজেই আকৃষ্ট করত। তিনি ভ্রমণ কাহিনী, ছোটগল্প, প্রবন্ধ ও রম্যরচনায় তিনি স্বতঃস্ফ‚র্ত ও সাবলীল। তাঁর প্রকাশিত প্রথম রম্যগ্রন্থ’ আমি তেলেপোকা বলছি। এরপর ছোটগল্প সংকলন ‘অন্য আলোয় অন্য ভুবন’ এবং ‘অন্তরে বাইরে অনিকেত প্রান্তরে’ ভ্রমণ কাহিনী। তারপর ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতো নারীকণ্ঠ পত্রিকায় ‘নজর আলীর সাতকাহন’। এটা এবার রম্যগ্রন্হ হয়ে মলাট বন্দী হলো।

রম্য সাহিত্যে অবদান : রম্য রচনায় জিনাত আজমের অবদান ছিল অনস্বীকার্য। তার প্রকাশিত বইগুলো পাঠকদের মাঝে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। হাস্যরসের মোড়কে তিনি জীবনের গভীর সত্যকে তুলে ধরতেন, যা পাঠককে কেবল আনন্দই দিত না, বরং নতুন করে ভাবতে শেখাত। তার লেখাগুলো প্রমাণ করে যে, হাসির মাধ্যমেও সমাজকে বার্তা দেওয়া সম্ভব।

সাংগঠনিক ব্যক্তিত্ব : সাহিত্যের পাশাপাশি সামাজিক কর্মকাÐেও জিনাত আজমের ছিল সক্রিয় অংশগ্রহণ। চট্টগ্রাম লেডিস ক্লাবের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি নারী সমাজের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। এছাড়া, চট্টগ্রাম লেখিকা সংঘের সভাপতির দায়িত্ব পালনকালে তিনি নবীন লেখিকাদের উৎসাহিত করতে এবং তাদের প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে দিতে নিরলস কাজ করেছেন। তার নেতৃত্বে লেখিকা সংঘ চট্টগ্রামের সাহিত্য অঙ্গনকে আরও সমৃদ্ধ করেছিল। তিনি বলেন, এখন সময় পাল্টে গেছে। নারীরা শিক্ষায় সংস্কৃতিতে অনেক এগিয়েছে। এখন সবার মন মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। নারীকে মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করার বোধ তৈরি করতে হবে। আগে নারীদের লেখার সুযোগ ছিল হাতেগোনা কয়েকটি পত্রিকায় যেমনÑ দৈনিক আজাদী, বেগম, অনন্যা, লাবণ্য, বান্ধবী। আর এখন তো প্রচুর পত্রিকায় লেখার সুযোগ আছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় লেখা পোস্ট করা যাচ্ছে। বিভিন্ন নারী সংগঠনে নিজের প্রতিভা বিকাশের সুযোগ পাচ্ছে। এখন আর পেছন ফিরে তাকানোর কিছু নেই। যার যা প্রতিভা আছে তাই নিয়ে নিজের আত্মপরিচয় সুদৃঢ় করতে হবে। এই সময়ে এসেও অনেক সময় নারীদের সাহিত্যচর্চা সৃজনশীলতা নারীর অর্জনকে কটুক্তির মুখে পড়তে হয়। জিনাত আজম বলেন, পুরুষ যেমন মানুষ নারীও মানুষ। পুরুষ ছাড়া নারী যেমন সম্পূর্ণ নয় তেমনি নারী ছাড়াও পুরুষ সম্পূর্ণ নয়। সুতরাং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে থেকে নিজ নিজ কাজ করে যেতে হবে। ঘরে বসেও এখন অনেক কাজ করার সুযোগ রয়েছে নারীদের। নারী এগিয়ে গেলে পরিবার, সমাজ, দেশ এগিয়ে যাবে।একজন প্রতিভাবান মানুষ প্রকৃতির মতোই স্নিগ্ধ সুন্দর। তিনি ছোটবেলা থেকে শ্রদ্ধেয় পিতার অনুপ্রেরণায় লেখালেখি শুরু করেন। ভ্রমণ কাহিনী, ছোটগল্প, প্রবন্ধ ও রম্যরচনায় তিনি স্বতঃস্ফ‚র্ত ও সাবলীল। তিনি চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল, চমেক রোগী কল্যাণ সমিতি, চক্ষু হাসপাতাল, চট্টগ্রাম প্রগ্রেসিভ ট্রাস্ট, মহিলা ইসলামী পাঠাগারের প্রাক্তন সম্পাদিকাসহ বহু প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত রয়েছেন। বিভাগীয় সমাজ কল্যাণ সংস্থার সমাজসেবা স্বর্ণপদক, মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী স্বর্ণ পদক, রতœগর্ভা মা স্বর্ণপদক, চট্টগ্রাম লেডিস ক্লাব ও লেখিকা সংঘ সম্মাননাসহ বেশকিছু পদকে ভূষিত হয়েছেন। তিনি ইংল্যান্ড, জার্মানি, কানাডা সিঙ্গাপুর, নেপাল, মালয়েশিয়া, ভারত ও সৌদিআরব ভ্রমণ অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ। জিনাত আজম দুই পুত্র ও এক কন্যার জননী। তাঁরা সবাই উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত এবং প্রতিষ্ঠিত। স্বামী মরহুম আলী আজম খান ছিলেন উচ্চপদস্থ ব্যাংক কর্মকর্তা। বড়ছেলে আতিক খান ও তার স্ত্রী ফারহানা তেহসীন সাহিত্য চর্চার সাথে জড়িত। সমাজসেবা সাহিত্যচর্চা দেশভ্রমণ ও বাগান করা ছিলো জিনাত আজমের শখ।
আলোকিত অধ্যায়ের সমাপ্তি : জিনাত আজমের প্রয়াণ চট্টগ্রামের সাহিত্য ও সংস্কৃতি জগতে এক অপূরণীয় ক্ষতি। তার হাস্যোজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব, তীক্ষ্ণ মেধা এবং অসাধারণ লেখনী চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তিনি তার কর্ম ও সৃষ্টির মাধ্যমে পাঠকের হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন চিরকাল। তার মৃত্যুতে আমরা হারালাম একজন বরেণ্য রম্য লেখিকাকে, যিনি তার লেখনীর মাধ্যমে আমাদের মনকে হাসিয়েছিলেন, আর সমাজের প্রতি তার দায়বদ্ধতা ছিল অনুকরণীয়। জিনাত আজম ঘুমিয়ে আছেন, কিন্তু তার লেখাগুলো তার স্মৃতিকে উজ্জ্বল করে রাখবে আমাদের মাঝে।
লেখক : প্রাবন্ধিক