জামায়াত নেতা আজহারুল ইসলাম ‘বেকসুর’ খালাস

1

পূর্বদেশ ডেস্ক

যুদ্ধাপরাধ মামলায় মৃত্যুদন্ডের রায় বাতিল করে জামায়াতে ইসলামীর নেতা এটিএম আজহারুল ইসলামকে বেকসুর খালাস দিয়েছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। ছয় বছরের ব্যবধানে দ্বিতীয়বার আজহারের আপিল শুনে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের সাত বিচারকের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ গতকাল মঙ্গলবার ঐকমত্যের ভিত্তিতে এ রায় দেয়।
জুলাই অভ্যুত্থানে সরকার বদলের পর পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে এই রায় এলো। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের কোনো মামলায় রিভিউ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আপিলে এই প্রথম কেউ খালাস পেলেন।
রায়ের পর আদালত প্রাঙ্গণে উল্লাস প্রকাশ করেন আইনজীবীরা। শোনা যায় জামায়াতে ইসলামীর নারায়ে তাকবির ধ্বনী।
আজহারের আইনজীবী মো. শিশির মনির তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘এই রায়ের মধ্য দিয়ে সত্য জয়ী হয়েছে, মিথ্যা পরাজিত হয়েছে’।
রায়ের সময় রাষ্ট্রপক্ষে উপস্থিত ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল অনীক আর হক। রায়ের পর তিনি কোনো মন্তব্য করেননি। খবর বিডিনিউজের
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যা, হত্যা, অপহরণ, নির্যাতনের ছয় ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত করে ২০১৪ সালে আজহারুল ইসলামকে মৃত্যুদÐ দিয়েছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ২০১৯ সালে প্রথমবার আপিল শুনানি করে সেই রায় বহাল রেখেছিল তখনকার আপিল বেঞ্চ। ওই দুই রায় বাতিল করে এখনকার আপিল বিভাগ বলেছে, যে সমস্ত তথ্য প্রমাণ এই মামলায় ছিল, তা অতীতের আপিল বিভাগ ‘সঠিকভাবে বিবেচনা করতে ব্যর্থ হয়েছে’।
২০১২ সালের ২২ আগস্ট মগবাজারের বাসা থেকে গ্রেপ্তার হন জামায়াতে ইসলামীর তখনকার সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলাম। তখন থেকেই তিনি কারাগারে আছেন।
আপিল বিভাগের রায়ে এটিএম আজহারকে তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। অন্য কোনো মামলা না থাকলে তাকে অবিলম্বে মুক্তি দিতে বলেছে সর্বোচ্চ আদালত।

কোন যুক্তিতে খালাস
এ মামলায় ট্রাইব্যুনালের রায় বহাল রেখে আপিল বিভাগ ২০১৯ সালের ৩১ অক্টোবর যে রায় দিয়েছিল, তা পূর্ণাঙ্গভাবে প্রকাশিত হয় ২০২০ সালের ১৫ মার্চ। এরপর তা পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে ওই বছরের ১৯ জুলাই আপিল বিভাগে আবেদন করেন আজহারুল ইসলাম। জুলাই অভ্যুত্থানে সরকার বদলের পর পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে আপিল বিভাগ গত ২৬ ফেব্রুয়ারি রিভিউ শুনে ফের আপিল শুনানির সিদ্ধান্ত দেয়। সে অনুযায়ী আপিল শুনানি শেষে ৮ মে আপিল বিভাগ রায় ঘোষণার জন্য ২৭ মে দিন ধার্য করে দেয়।
গতকাল মঙ্গলবার বিচারকরা আসন গ্রহণ করার পর সকাল ৯টা ৫৫ মিনিটের দিকে রায় ঘোষণা করা হয়। রায়ের পর সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে আদালতের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন আজহারের আইনজীবী শিশির মনির।
তিনি বলেন, ‘আদালত বলেছেন, অতীতের রায়ে বাংলাদেশসহ এই ভারতীয় সাব কনটিনেন্টের ক্রিমিনাল বিচার ব্যবস্থার পদ্ধতি চেইঞ্জ করে দেওয়া হয়েছিল। এটা ছিল সবচাইতে বড় ভুল। আরো বলেছেন, আদালতের সামনে উপস্থাপিত সাক্ষ্য প্রমাণ অ্যাসেসমেন্ট করা ছাড়াই জনাব এটিএম আজহারুল ইসলাম সাহেবকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। এবং আরেকটি ইমপর্টেন্ট কথা বলেছেন, যে পৃথিবীর ইতিহাসে এটি একটি ট্রাবেস্ট্রি অফ ট্রুথ, অর্থাৎ বিচারের নামে অবিচার। আরো বলেছেন, যে সমস্ত তথ্য প্রমাণ আদালতে হাজির করা হয়েছিল, অতীতের আপিল বিভাগ তা সঠিকভাবে বিবেচনা করতে ব্যর্থ হয়েছে’।
শিশির মনির বলেন, ফলশ্রুতিতে আজকে এটিএম সাহেবকে বেকসুর খালাস প্রদান করেছেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে নয়, পৃথিবীর ইতিহাসে এটি একটি নজিরবিহীন ঘটনা হয়ে থাকবে। এর মাধ্যমে আমরা মনে করি, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সত্য বিজয়ী হয়েছে, মিথ্যা পরাজিত হয়েছে।
যুদ্ধাপরাধ মামলায় এর আগে জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপির ছয় জন শীর্ষ নেতার মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার প্রসঙ্গ ধরে শিশির মনির বলেন, ‘পাঁচজন, অন্তত পক্ষে পাঁচজন জেলেই মৃত্যুবরণ করেছেন। দুনিয়ার ইতিহাসে এটা নজিরবিহীন নির্যাতনের শামিল। এটিএম আজারুল ইসলাম সাহেব সৌভাগ্যবান, তিনি ন্যায়বিচার পেয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা তাকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। তাই আমরা এটা মনে করি, এই রায়ের মাধ্যমে সিন্ডিকেটেড ইনজাস্টিসের অবসান হয়েছে। আমরা এটাও মনে করি, এই রায় ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মর্যাদা সমুন্নত হয়েছে’।
এই আইনজীবী বলেন, ‘এখন থেকে জামায়াতে ইসলামের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলাম ইজ অ্যান ইনোসেন্ট ম্যান’।
শিশির মনির বলেন, তারা আদালতের কাছে একটি ‘শর্ট অর্ডার’ চেয়েছিলেন, আদালত তা মঞ্জুর করেছে। আদালত বলেছেন, আমরা চেষ্টা করব আজকেই যেন এবং আজকে এবং কালকের মধ্যে যেন এই শর্ট অর্ডারটা প্রসেস হয়ে এটিএম আজহারুল ইসলাম সাহেব মুক্তি পেতে পারেন। এই জন্য সকল আইনি ব্যবস্থা আমরা গ্রহণ করব’।
আদালতের বাইরে উপস্থিত জামায়াতে ইসলামের নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মুহম্মদ তাহের বলেন, ‘আমি কোর্টকে ধন্যবাদ জানাই এবং এই দেশবাসীর প্রতি আমি ধন্যবাদ জানাই। কৃতজ্ঞতা জানাই। তাদের আন্দোলন সংগ্রামের একটি সুস্পষ্ট সুন্দর রেজাল্ট আজকে বেরিয়ে আসছে’।
রায়ের পর আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল ফেসবুকে তার প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘এই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টির কৃতিত্ব জুলাই গণআন্দোলনের অকুতোভয় নেতৃত্বের। এই সুযোগকে রক্ষা করার দায়িত্ব এখন আমাদের সবার’।