ফখরুল ইসলাম নোমানী
পরকালে বিশ্বাসী যেকোনো বান্দার জন্য জান্নাতের সুসংবাদের চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কিছু হতে পারে না। আর সেই সুসংবাদ যখন পান বেলালের মতো এক কালো ও অসুন্দর মানুষ স্বভাবতই প্রশ্ন আসে কী এমন আমল করতেন তিনি যার কারণে বেহেশতে পায়চারি করছেন। মসজিদে নববির মুয়াজ্জিন হজরত বেলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু। প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদিন সকালে বেলাল (রা.) কে তার বিশেষ আমলের কথা জিজ্ঞাসা করলেন। যে আমলের কারণে হজরত বেলাল প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আগে জান্নাতে পায়চারি করছিলেন। হজরত বেলালের বিশেষ আমলের বর্ণনা সম্পর্কিত হাদিসটি মুসলিম উম্মাহর জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ হজরত বেলালের (রা.) বিশেষ আমল দুটি ছিল সহজ। যা পালনে সহজেই মুসলিম উম্মাহ জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে। হাদিসে এসেছে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে বুরাইদাহ তাঁর পিতার কাছ থেকে বর্ণনা করেছেন তিনি বলেন একদিন সকালে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হজরত বেলাল (রা.) কে ডেকে বললেন হে বেলাল! কি এমন কাজ করে তুমি জান্নাতে আমার আগে চলে গেলে ? আমি গত রাতে (স্বপ্নে) জান্নাতে প্রবেশ করলে তোমার (পায়চারির/জুতার) শব্দ আমার সামনে থেকে শুনতে পেলাম! মেরাজের রাতে রাসুল (সা.) জান্নাত পরিদর্শনের সময় হজরত বেলাল ইবনে রাবাহ (রা.) এর পায়ের আওয়াজ শুনতে পেয়েছিলেন।
হজরত বেলাল (রা.) বললেন হে আল্লাহর রাসুল! (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমি যখনই আজান দিয়েছি তখনই ২ রাকাআত নামাজ পড়েছি। আর যখনই আমি অপবিত্র হয়েছি তখনই আমি সঙ্গে সঙ্গে অজু করে নিয়েছি। এ কথা শুনে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন এ কাজের জন্যই। (জান্নাতে আমার আগে আগে তোমার শব্দ শুনলাম)। উল্লেখিত হাদিসের আলোকে বুঝা যায় মুমিন ব্যক্তির ওজু ছুটে গেলে পুনরায় ওজু করা এবং আজানের পর মসজিদে গিয়ে ২ রাকাআত নামাজ আদায়ে অনেক ফজিলত ও মর্যাদা রয়েছে। যা প্রিয়নবি হাদিসে বর্ণনা করেছেন। আর এ দুটি কাজ (বার বার ওজু ও নামাজ আদায়) প্রত্যেক মানুষের জন্যই অনেক সহজ। তাই মুমিন মুসলমানের উচিত ওজু ছুটে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুনরায় ওজু করে নেয়া। আর আজান হলে মসজিদে গিয়ে প্রথমেই ২ রাকাআত নামাজ আদায় করে নেয়া। কৃষ্ণাঙ্গ সাহাবি হজরত বেলাল (রা.) এর জন্ম মক্কায়। তবে তিনি ছিলেন আবিসিনিয়ার (বর্তমান ইথিওপিয়া) বংশোদ্ভূত। মক্কার প্রভাবশালী কুরাইশ নেতা উমাইয়া ইবনে খালফের ক্রীতদাস ছিলেন তিনি। কুরাইশদের চোখে ক্রীতদাস হিসেবে হজরত বেলাল বেলালের (রা.) ইসলাম গ্রহণ ছিল চরম ধৃষ্টতা। তাঁদের শত বছরের বিশ্বাস, চিন্তা ও আভিজাত্যের প্রতি প্রচন্ড আঘাত হানে। হজরত বেলাল (রা.) এর মনিব উমাইয়া তাঁর ইসলাম গ্রহণের কথা জানতে পেরে তাঁকে ইসলাম ত্যাগের জন্য জবরদস্তি করতে থাকেন। তাতে বিফল হওয়ায় উমাইয়ার নির্দেশে বেলাল (রা.) এর ওপর শুরু হয় নিষ্ঠুর নির্যাতন। কখনো মরুভূমির উত্তপ্ত বালুতে, কখনো তপ্ত অঙ্গারের ওপর তাঁকে শুইয়ে রাখা হতো, নৃশংসভাবে গলায় উত্তপ্ত রশি বেঁধে ছাগলের মতো তাঁকে মক্কার অলিতে-গলিতে হেঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হতো। কখনো বুকের ওপর ভারি পাথর রেখে দেওয়া হতো। রুদ্ধ হয়ে আসত তাঁর নিশ্বাস। প্রভাবে প্রতিদিন তাঁর ওপর নির্যাতন চালাতো মক্কার মুশরিকেরা।
এত নির্যাতনের মধ্যেও হজরত বেলাল (রা.) শুধু আহাদ, আহাদ (আল্লাহ এক, আল্লাহ এক) বলে চিৎকার করতেন। একদিন বাতহা উপত্যকায় হজরত বেলাল (রা.) এর অত্যাচার চলছিল। হজরত আবু বকর (রা.) যাচ্ছিলেন সে পথ ধরে। ঘটনা দেখে তিনি ভীষণ মর্মাহত হলেন। মোটা অঙ্কের অর্থ উমাইয়াকে দিয়ে বেলাল (রা.) কে তিনি তাঁর কাছ থেকে কিনে নিলেন। হজরত বেলাল (রা.) মুক্তি পেলেন দাসের জীবন থেকে। বদর, উহুদ, খন্দক যুদ্ধসহ সব সামরিক অভিযানেই হজরত বেলাল (রা.) অংশ নিয়েছিলেন। বদর যুদ্ধের ময়দানে কুরাইশদের পক্ষে ছিলেন হজরত বেলাল (রা.)এর এক সময়ের মনিব অত্যাচারী অবিশ্বাসী উমাইয়া ইবনে খালফ। সে যুদ্ধে হজরত বেলাল (রা.)এর তরবারির আঘাতে তাঁর মৃত্যু হয়। এভাবে এক সময়কার ক্রীতদাস হজরত বেলাল (রা.) এর হাতে প্রাণ হারান তাঁর পুরোনো নির্যাতনকারী মনিব।
মক্কায় হিজতের আগ পর্যন্ত ইসলাম দুর্বল ছিল। হিজরতের পর মদিনায় সবল হয়। মদিনা থেকেই ইসলামি আচার-আচরণ ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের মূল ভিত্তি স্থপান শুরু হয়। মসজিদ প্রতিষ্ঠা, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, নামাজের জন্য আজানের প্রচলন হয়। হজরত বিলাল (রা.)-ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিন হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেন। তাঁর আজানের ধ্বনি, নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর, তরুণ-যুবক সবাইকে আকৃষ্ট করতো। মদিনার বাইরেও বিভিন্ন সফরে তিনি রাসূল (সা.) এর মুয়াজ্জিন ছিলেন। ইসলামের প্রধান প্রধান সব যুদ্ধেই তিনি অংশ গ্রহণ করেছিলেন। বদর যুদ্ধে তিনি ইসলামের চির শত্রু উমাইয়্যা ইবনে খালফকে হত্যা করেন। মক্কা বিজয়ের দিনে রাসূল (সা.) এর সঙ্গী ছিলেন এবং রাসূল (সা.) এর সঙ্গে কাবার ভেতরে প্রবেশের সৌভাগ্য লাভ করেন।
তিনি হিজরি ২০ সালে ৬০ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। তাঁর বিশেষ আমল ছিল সবসময় অজু অবস্থায় থাকা। তাঁর এই আমলটি আল্লাহর রাসূল (সা.) অনেক পছন্দ করেছিলেন। মুসলমানদের জন্যও এ আমল অনুসরণীয়। এ আমলের কারণে রাসূল (সা.) জান্নাতে ভ্রমণের সময় বেলাল (রা.) এর জুতার শব্দ শুনতে পেয়েছিলেন। সুন্নত তরিকায় অজু করলে মহাপুরষ্কারের ঘোষণা এসেছে হাদিসে। হজরত ওমর (র.) হতে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন “তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি পূর্ণাঙ্গভাবে অজু করে অতঃপর বলে আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসুলুহ। তার জন্যে জান্নাতের আটটি দরজা খুলে দেওয়া হবে। যে দরজা দিয়ে ইচ্ছা সে প্রবেশ করতে পারবে।
হিজরি ১৬ সালের কথা জেরুজালেম প্রথমবারের মতো মুসলমানদের অধিকারে এসে যায়। খলিফা হজরত উমর (রা.) সেখানে পৌঁছেন। বিজয়ের পর সেখানে কয়েকদিন অবস্থান করেন। একদিন নামাজের সময় তিনি বেলাল (রা.) কে আজান দিতে বলেন। বেলাল (রা.) বললেন আমি সংকল্প করেছিলাম যে রসূলুল্লাহ (সা.) এর পর আমি আর কারো জন্য আজান দেব না। কিন্তু আজ এবং একমাত্র আজ আপনার নির্দেশ পালন করব। এই বলে তিনি আজান দিতে শুরু করেন। এ সময় উপস্থিত সাহাবায়ে কেরাম সকলের রসূলুল্লাহ (সা.) এর মোবারক যুগ স্মরণ হয়ে যায় এবং তাদের মধ্যে দারুণ আবেগের সৃষ্টি হয়। আবু ওবায়দা (রা.) এবং মোআজ ইবনে জাবাল (রা.) কাঁদতে কাঁদতে অস্থির হয়ে পড়েন। হজরত উমর (রা.) বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন এবং দীর্ঘক্ষণ তার এ অবস্থা বিদ্যমান ছিল। সুকণ্ঠের অধিকারী বিলাল বিন রাবাহ ছিলেন ইসলাম ধর্মের প্রথম মুয়াজ্জিন। আল্লাহর প্রতি তার ছিল একনিষ্ঠ আনুগত্য এবং ঈমানের প্রতি ছিল নিদারুণ দৃঢতা। ইসলামের ইতিহাসের এক অনন্য ব্যক্তিত্ব হযরত বেলাল (রা.) ইসলামের ইতিহাসের এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। নবী মুহাম্মদ (সা.) এর সঙ্গী হিসেবে প্রথম জান্নাতে প্রবেশকারী হওয়ার অগ্রিম সুসংবাদ পাওয়া ব্যক্তি হলেন হযরত বেলাল (রা.)। ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিখিত এই মহিমান্বিত ব্যক্তির জীবন।
আশা করা যায় এ আমল নিয়মিত করলে আল্লাহতাআলা হজরত বেলাল রাদিয়াল্লাহু আনহুর মতো মর্যাদা মুমিন মুসলমানকে দান করবেন। পরিশেষে নামাজ ও ওজুর হেফাজত মুমিন মুসলমান মাত্রই বেশি করে থাকেন। হাদিসে পাকে প্রিয়নবি (সা.) থেকে এমন বর্ণনাই পাওয়া যায় হজরত সাওবান রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন তোমরা (দ্বীনের প্রত্যেক বিষয়ে) কর্তব্য নিষ্ঠ হও। আর তাতে কখনোই পূর্ণ সক্ষম হবে না। জেনে রেখ! তোমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ আমল নামাজ। আর মুমিন ব্যতিত কেউই ওজুর হেফাজত করে না। আল্লাহতাআলা মুসলিম উম্মাহকে নামাজ ও ওজুর যথাযথ হেফাজত করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক : ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট