জাতীয় ও উপজেলা নির্বাচনে ভোট দেয়নি ৩২ লাখ ভোটার

1

নিজস্ব প্রতিবেদক

চট্টগ্রামে দ্বাদশ জাতীয় ও ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ভোট দেয়নি ৩২ লাখ ভোটার। শহর থেকে গ্রামে না যাওয়া ও ভোট দেয়ার আগ্রহ কম থাকায় ভোটকেন্দ্র বিমুখ ছিল ভোটাররা। যে কারনে প্রতিটি কেন্দ্রেই বেশিরভাগ ভোটার অনুপস্থিত ছিল। জাতীয় নির্বাচনে ৩৬ শতাংশ এবং উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ২৭ শতাংশ ভোটার ভোটাধিকার প্রয়োগ করেননি। একতরফা নির্বাচন ও এক দলের প্রার্থীদের লড়াইয়ের কারনে জাতীয় নির্বাচনে ভোটারদের আগ্রহ ছিল কম।
অন্যদিকে তিন পদে নির্বাচন হওয়ায় জাতীয় নির্বাচনের চেয়ে উপজেলা নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কিছুটা বেশি ছিল। তবে উপজেলা নির্বাচনেও অন্যান্য দলের প্রার্থীদের উপস্থিতি কম ছিল। গত ৭ জানুয়ারি জাতীয় নির্বাচন ও মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত কয়েকটি ধাপে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
নির্বাচন বিশ্লেষক ড. তোফায়েল আহমেদ এক সাক্ষাতকারে বলেন, গত দশ বছরে দেশের নির্বাচনী সংস্কৃতিতে বেশ বড় একটি পরিবর্তন এসেছে। সে কারনে সাধারণ ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে যেতে চায় না। হাতে গোনা দুই একটি ভোট ছাড়া গত দশ বছরে নির্বাচনগুলোতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও নির্বাচন কর্মকর্তারা সরকারি দলের পক্ষে কাজ করেছে। যে কারনে শুধু ভোটার না, আগ্রহ হারাচ্ছেন প্রার্থীরাও।
উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কম হওয়া নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে সুজন সম্পাদক এবং বর্তমানে নির্বাচন সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘নির্বাচনে যে উৎসাহ-উদ্দীপনা ও উৎসবমুখ পরিবেশ থাকার কথা, তার কোনো কিছুই উপজেলা নির্বাচনে দেখা যায়নি। নির্বাচনে ভোটার নাই, বিরোধী দল নাই এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাও নাই। নির্বাচন যে নির্বাসনে চলে গেছে এটা তারই প্রমাণ। নির্বাচনী ব্যবস্থা ভেঙে গেছে। এই ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। আমরা ভোট পাগল জাতি। এখন ভোট খরায় ভুগছি। আমরা ভোট পাগল থেকে ভোট খরার জাতিতে পরিণত হয়েছি’।
গত জাতীয় নির্বাচন ও উপজেলা নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, জাতীয় নির্বাচনে চট্টগ্রামের ১৬টি আসনে ৬৩ লক্ষ ১৩ হাজার ৩৯৫ ভোটার ছিল। নির্বাচনে ২ হাজার ২৩টি ভোটকেন্দ্রে ভোট পড়েছিল ৩৯ লক্ষ ৮৯ হাজার ৫১৩ ভোট। ২৩ লক্ষ ২৩ হাজার ৮৮২ জন ভোটার নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেনি।
এরমধ্যে চট্টগ্রাম-১ (মিরসরাই) আসনে ৩ লক্ষ ৬৬ হাজার ৫২৫ ভোটারের মধ্যে ভোট দিয়েছেন ২ লাখ ২১ হাজার ৪৬৩ জন। চট্টগ্রাম-২ (ফটিকছড়ি) আসনে ৪ লক্ষ ৫৬ হাজার ৪৮৭ ভোটারের মধ্যে ভোট দিয়েছেন ৩ লক্ষ ৭ হাজার ২২ জন। চট্টগ্রাম-৩ (সন্দ্বীপ) আসনে ২ লক্ষ ৪১ হাজার ৯১৪ ভোটারের মধ্যে ভোট দিয়েছেন ১ লক্ষ ৫৪ হাজার ৩৩৩ জন। চট্টগ্রাম-৪ (সীতাকুন্ড আসনে ৪ লক্ষ ২৭ হাজার ১৭২ ভোটারের মধ্যে ভোট দিয়েছেন ২ লক্ষ ৬৮ হাজার ২২৪ জন। চট্টগ্রাম-৫ (হাটহাজারী) আসনে ৪ লক্ষ ৭৫ হাজার ৭১৩ ভোটারের মধ্যে ভোট দিয়েছেন ৩ লক্ষ ৭৬ হাজার ৫৩৯ জন। চট্টগ্রাম-৬ (রাউজান) আসনে ৩ লক্ষ ১৬ হাজার ৯২০ ভোটারের মধ্যে ভোট দিয়েছেন ৮৪ হাজার ৮১২ জন। চট্টগ্রাম-৭ (রাঙ্গুনিয়া) আসনে ৩ লক্ষ ১৩ হাজার ৯১ ভোটারের মধ্যে ভোট দিয়েছেন ৯৫ হাজার ৭১১ জন। চট্টগ্রাম-৮ (বোয়ালখালী) আসনে ৫ লক্ষ ১৫ হাজার ৫৭৩ ভোটারের মধ্যে ৩ লক্ষ ৭৭ হাজার ৬২৮ জন, চট্টগ্রাম-৯ (কোতোয়ালী) আসনে ৪ লক্ষ ৯ হাজার ৫৭৬ ভোটারের মধ্যে ২ লক্ষ ৬৮ হাজার ৭০২ জন, চট্টগ্রাম-১০ (পাহাড়তলী-ডবলমুরিং) আসনে ৪ লক্ষ ৮৫ হাজার ৮০১ ভোটারের মধ্যে ৩ লক্ষ ৮০ হাজার ৬৫০ জন, চট্টগ্রাম-১১ (বন্দর-পতেঙ্গা) আসনে ৫ লক্ষ ১ হাজার ৮৫২ ভোটারের মধ্যে ৩ লক্ষ ৯৯ হাজার ২২৩ জন, চট্টগ্রাম-১২ (পটিয়া) আসনে ৩ লক্ষ ২৯ হাজার ৪২৮ ভোটারের মধ্যে ১ লক্ষ ১৬ হাজার ৬৪০ জন, চট্টগ্রাম-১৩ (আনোয়ারা-কর্ণফুলী) আসনে ৩ লক্ষ ৫৬ হাজার ৮৬৪ ভোটারের মধ্যে ১ লক্ষ ৫২ হাজার ৯৪৩ জন, চট্টগ্রাম-১৪ (চন্দনাইশ) আসনে ২ লক্ষ ৮৮ হাজার ২৯৩ ভোটারের মধ্যে ১ লক্ষ ৭১ হাজার ২৩ জন, চট্টগ্রাম-১৫ (লোহাগাড়া-সাতকানিয়া) আসনে ৪ লক্ষ ৫৮ হাজার ৪১১ ভোটারের মধ্যে ৩ লক্ষ ২৯ হাজার ৪৮ জন, চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালী) আসনে ৩ লক্ষ ৭০ লক্ষ ৭৭৫ হাজার ভোটারের মধ্যে ২ লক্ষ ৪১ হাজার ৫৫২ জন ভোটার ভোট দিয়েছেন। এসব আসনে ভোট দেয়নি ২৩ লক্ষ ২৩ হাজার ৮৮২ জন।
চট্টগ্রামের ১৫টি উপজেলার মধ্যে ১১ টিতে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। বাকি উপজেলায় বিনাভোটে প্রার্থীরা নির্বাচিত হওয়ায় ভোটগ্রহণ হয়নি। নির্বাচনে ১ হাজার ৮০টি ভোটকেন্দ্রে ৩৩ লক্ষ ৩৭ হাজার ৩৪৫ ভোটার ছিল। ভোট পড়েছে ২৪ লক্ষ ৫১ হাজার ৪৫৮। নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেনি ৮ লক্ষ ৮৫ হাজার ৮৮৭ ভোটার।
এরমধ্যে সীতাকুন্ড উপজেলায় ৩ লক্ষ ২৪ হাজার ২৪০ ভোটারের মধ্যে ভোট দিয়েছেন ২ লক্ষ ৫১ হাজার ৬১০ জন, মিরসরাইয়ে ৩ লক্ষ ৭২ হাজার ২৫৭ ভোটারের মধ্যে ৩ লক্ষ ৮ হাজার ৯৯১ জন, সন্দ্বীপে ২ লক্ষ ৪৫ হাজার ৬৭৬ ভোটারের ২ লক্ষ ৩১৪ জন, ফটিকছড়িতে ৪ লক্ষ ৬৪ হাজার ৬০৭ ভোটারের মধ্যে ৩ লক্ষ ৬১ হাজার ৫৫৬ জন, হাটহাজারীতে ৩ লক্ষ ৫৭ হাজার ৪৪৮ ভোটারের মধ্যে ২ লক্ষ ৫৯ হাজার ৪ ভোট, চন্দনাইশে ১ লক্ষ ৯১ হাজার ৬০৭ ভোটারের মধ্যে ১ লক্ষ ২৯ হাজার ৬৮৬ জন, বোয়ালখালীতে ২ লক্ষ ১০ হাজার ৩৬০ ভোটারের মধ্যে ১ লক্ষ ২৯ হাজার ৭১৮ জন, পটিয়ায় ৩ লক্ষ ৩৪ হাজার ৫৪৫ ভোটারের মধ্যে ২ লক্ষ ২৪ হাজার ৭০৯ জন, আনোয়ারায় ২ লক্ষ ৩৩ হাজার ১০৯ ভোটারের মধ্যে ১ লক্ষ ৩৪ হাজার ৫৭৩ জন, বাঁশখালীতে ৩ লক্ষ ৭৬ হাজার ৯০৬ ভোটারের মধ্যে ২ লক্ষ ৮৯ হাজার ৭২৯ জন, লোহাগাড়ায় ২ লক্ষ ২৬ হাজার ৫৯০ ভোটারে মধ্যে ১ লক্ষ ৬১ হাজার ৫৬৮ জন ভোটার নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। এসব উপজেলায় ভোট দেয়নি ৮ লক্ষ ৮৫ হাজার ৮৮৭ ভোটার।
ভোটাররা জানান, যে ভোটগুলো পড়েছে তার বেশিরভাগই জোরপূর্বক ও কেন্দ্র দখল করে নেয়া হয়েছে। গ্রামে থাকা মানুষরাই ভোট কেন্দ্রে গিয়েছে। শহর থেকে গ্রামে গিয়ে কেউ ভোটাধিকার প্রয়োগ করেনি। প্রায় অর্ধেক নারী ভোটার থাকলেও তাদের মধ্যে ভোট দেয়ার আগ্রহ কম দেখা গেছে। তরুণ ভোটারদের মধ্যে ভোট দেয়ার প্রবণতা দেখা যায়নি।