জাতিসংঘের প্রয়োজন কি ফুরিয়ে এল!

1

আকতার কামাল চৌধুরী

সম্প্রতি ইরানের ভূখন্ডে ইসরায়েল-মার্কিন বিমান হামলায় জাতিসংঘের ভূমিকা ও অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলা-ই যায়। জাতিসংঘ সনদের ২(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সংস্থাটি (জাতিসংঘ) তার সকল সদস্য রাষ্ট্রের সার্বভৌম সমতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হবে।’ এর মানে হল, জাতিসংঘ তার সকল সদস্য রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও সমতাকে স্বীকৃতি দেয় এবং তাদের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করে। অথচ, এই স্বীকৃত অধিকারকে যুগের পর যুগ ভূলুণ্ঠিত করে আসছে কারা? কারাই-বা রক্ষক হয়ে ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে ?
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, ভেটো ক্ষমতার অধিকারী রাষ্ট্রগুলোই মূলত জাতিসংঘের এ ধারাকে বার বার পদদলিত করেছে। ১৯৯০ সালের ২ আগস্ট ইরাক অতর্কিত হামলা চালিয়ে কুয়েত দখল করে নেয়। এই দখলের বিরুদ্ধে সোচ্চার যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে জরুরি বৈঠক ডেকে ইরাকের বিরুদ্ধে ব্যাপক নিষেধাজ্ঞা জারি করায়, এমনকি ইরকের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালানোর জন্য ৩৪টি দেশের সমন্বয়ে একটি সামরিক জোটও গঠন করে। পরবর্তীতে এই সামরিক জোটের চতুর্মুখী হামলা ও নিষেধাজ্ঞায় কোণঠাসা ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন একসময় বশ্যতা মানতে বাধ্য হন। বেশ তো! কুয়েতের সার্বভৌমত্ব ফিরিয়ে আনতে জাতিসংঘ সবাইকে এক-কাতারে নিয়ে আসে। সবাই এককাট্টা। কেউ ভেটোও দেয়নি। এটাই তো জাতিসংঘের ভূমিকা। ইরানে আক্রমণ করে ইসরায়েল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মূলত জাতিসংঘকে আরও একবার প্রশ্নের সম্মুখীন করে দিয়েছে। প্রশ্ন ওঠেছে,ইসরায়েল কোন আইনী-অধিকারে ইরান আক্রমণ করলো? যুক্তরাষ্ট্রও-বা কীভাবে নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন ছাড়া ইসরায়েলের পক্ষ নিয়ে নিজেরাই এ আক্রমণে অংশ নিল? এটা যদি বে-আইনী না-হয়,ইরাকের কুয়েত দখল বে-আইনী কেন ছিল? ইরাকের এ কার্যক্রমকে কোনোভাবে সমর্থন না করেও এই প্রশ্ন এখন প্রাসঙ্গিকই।
ইতিহাসে দেখা যায়, জাতিসংঘ গঠিত হওয়ার অব্যাবহিত পরেই কম্যুনিস্ট বলয়কে ক্ষমতা দেখানোর জন্য নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন ছাড়াই যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনামে বোমাবর্ষণ শুরু করে। একটানা ঊনিশ বছর ধরে চলে এ মরণযুদ্ধ। বলা হয়, ভিয়েতনামের এক ইঞ্চি জায়গাও যুক্তরাষ্ট্রের বোমা থেকে রক্ষা পায়নি। পরের ইতিহাস সবার জানা। স্বাধীন-সার্বভৌম আফগানিস্তান একে-একে দু’বার বে-দখলের কবলে পড়ে। প্রথমবার নাজিবুল্লাহকে ক্ষমতায় বসিয়ে কৌশলে দখল করে নেয় তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন। দ্বিতীয়বার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র- সেই নাইন ইলেভেনে টুইন-টাওয়ারে হামলার অজুহাতে সরাসরি আক্রমণ চালিয়ে।
এরজন্যে তারা জাতিসংঘের অনুমতির তোয়াক্কাই করেনি। সবই হয়েছে দুই পরাশক্তির ক্ষমতার মদমত্ততায়। দুবার-ই প্রাণ গেছে হাজার হাজার আফগানের। জাতিসংঘ অবশ্য সরব হয়েও কী করবে ছিল, যখন দু’রাষ্ট্রই ভেটোধারী। টুইন-টাওয়ারে হামলার সেই একই অজুহাতে ইরাকে হামলার অনুমতির জন্য নিরাপত্তা পরিষদের বিশেষ অধিবেশন ডাকে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু, নিরাপত্তা পরিষদ যুক্তরাষ্ট্রের এ অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে। নিরাপত্তা পরিষদের যুক্তি ছিল, টুইন টাওয়ারে হামলার জন্য ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন ‘দায়ী’- এমন কোনো অকাট্য প্রমাণ যুক্তরাষ্ট্রের হাতে নেই। যুক্তরাষ্ট্র এভাবে আইনগতভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়ে নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন ছাড়াই ‘ইরাক মারাত্মক অস্ত্র লুকিয়ে রেখেছে’ এমন ভূয়া রিপোর্টের ভিত্তিতে সরাসরি ইরাক আক্রমণ শুরু করে দেয়। প্রাচ্য কিংবা পাশ্চাত্যের কোনো সরকার-ই এ অন্যায় যুদ্ধের বিরুদ্ধে টু-শব্দটিও করেনি। বরং পশ্চিমারা যুক্তরাষ্ট্রের এ হামলার যৌক্তিকতা প্রমাণে সচেষ্ট থাকে।
একসময় সাদ্দাম হোসেনকে হটিয়ে পুরো ইরাককে বধ্যভূমি বানিয়ে এক নারকীয় উল্লাসে মেতে ওঠে যুক্তরাষ্ট্র। শেষে ইরাকে তাদের অনুগত পুতুল সরকার বসিয়ে নিজেদের ঘাঁটি বানানোর পথ পোক্ত করে। অথচ, এই যুদ্ধের বিরুদ্ধে তখন বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশ লাখো-কোটি মানুষের এ প্রতিবাদের তোয়াক্কাই করেননি। হাজার হাজার ইরাকির জীবন যায় এ-যুদ্ধে। জাতিসংঘ যেন অসহায় মার্কিন প্রেসিডেন্টের কাছে। কোনো আইনের তোয়াক্কা না-করে যুক্তরাষ্ট্র গুয়েন্তেনামো বে নামে আলাদা কারাগার প্রতিষ্ঠা করে। এখানে এনে রাখা হয় আফগান-ইরাক যুদ্ধবন্দিদের। বন্দীদের উপর চলে ওয়াটার বেডিংসহ নানা ভয়ানক, লোমহর্ষক নির্যাতন। এর তুলনা চলে হিটলারের নাৎসি বাহিনীর সাথে। কোনো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাকে এ কারাগার পরিদর্শনের সুযোগ দেয়নি যুক্তরাষ্ট্র। এ-নিয়ে কোনো রা নেই জাতিসংঘের।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পশ্চিমারা দলে দলে ইহুদিদের আরব-ভূখন্ডে নিয়ে আসে। গায়ের জোরে ফিলিস্তিনিদের তাড়িয়ে দিয়ে ইহুদিদের জন্য ইসরায়েল নামের একটি রাষ্ট্রও প্রতিষ্ঠা করে। সেই থেকে ইঙ্গ-মার্কিন সামরিক শক্তির দাপটে ইহুদীরা আরবদের তাড়িয়ে নতুন নতুন যায়গা দখল করে ইসরায়েল রাষ্ট্রের পরিধি বাড়াতে থাকে। বিতাড়িত ফিলিস্তিনিরা নিজেদের ভিটেমাটি ফিরে পেতে দশকের পর দশক লড়াই করে যাচ্ছে। সর্বশেষ তার-ই ধারাবাহিকতায় গাজা উপত্যকা আজ বধ্যভ‚মি। ফিলিস্তিনিরা আজ উদ্‌বাস্থ, ইসরায়েলী সেনাদের গুলিতে প্রাণ দিচ্ছে প্রতিদিন। এদের জন্য জাতিসংঘের যেন কিছুই করার নাই। স্নায়ুযুদ্ধকালীন নিরাপত্তা পরিষদে যতবারই বিল ওঠেছে ততবারই ইঙ্গ-মার্কিন শক্তি যৌথ ভেটো দিয়ে তা অকার্যকর করে দিয়েছে। সর্বশেষ গাজার যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবেও ভেটো দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে গণহত্যার সুযোগ করে দিয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইতিহাসের সবচেয়ে নৃশংস গণহত্যার ঘটনা ঘটে সেব্রেনিৎসায়। সেই গনহত্যাও ঠেকাতে পারেনি জাতিসংঘ। নিজেদের মতো রেজিম-চেঞ্জের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আরব-বসন্তের নামে মধ্যপ্রাচ্যে এক ‘সামরিক মরুঝড়’ সৃষ্টি করে। এতে পথে-ঘাটে কুকুরের মতো পিটিয়ে হত্যা করার হয় লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট মুয়াম্মার গাদ্দাফীকে, মিসরের প্রেসিডেন্ট হোসনী মুবারক গদিহারা হন। জাতিসংঘ আইনের রক্ষাকবচ এখানে গেল কোথায়?
বোঝাই যায়, জাতিসংঘ এখন ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোর এলিট ক্লাব ছাড়া আর কিছুই নয়। এই এলিটদের কাজ ভেটোর মাধ্যমে নিজেদের ক্ষমতার জানান দেওয়া। দুনিয়ার মানুষ চায় এক, তারা চায় আরেক। শেষে এলিটদের-ই জয় হয়। মানবতা, ন্যায়বিচার মার খায় ভেটোর কাছে। এই ভেটো জাতিসংঘের গণতান্ত্রিক চর্চাকে রুদ্ধ করে দিয়েছে, নিরাপত্তা পরিষদকে স্বৈরতন্ত্রের আঁকড়া বানিয়েছে। এই ভেটোর অপপ্রয়োগ অনেক জাতির স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছে, স্বাধীকার বিপন্ন হয়েছে, স্বপ্ন ভেঙে দিয়েছে, অনেক সমস্যার সহজ সমাধানকে জটিল করে ঝুলিয়ে রেখেছে। ভেটো মানে আজ পঞ্চশক্তির ইচ্ছাপূরণের হাতিয়ার। এই জাতিসংঘ-ই কি মানুষ চেয়েছিল?
এদিকে ইরানকেও দৌড়াচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র তাদের সাথে পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি স্বাক্ষর করাতে। এটা তো বিশ্বসংস্থা হিসেবে জাতিসংঘের-ই কাজ, যুক্তরাষ্ট্রের নয়। আন্তর্জাতিক পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ চুক্তিতে স্বাক্ষর করা কোনো রাষ্ট্র পরমাণু অস্ত্র বানানোর চেষ্টা করলে সেটি তদারকি করার দায়িত্ব আন্তর্জাতিক আনবিক সংস্থার। এই সংস্থার প্রতিবেদনের উপর নিরাপত্তা পরিষদ ওই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে,যুক্তরাষ্ট্র তো নয়। কিন্তু দুনিয়ার সকল রাষ্ট্রই ইরানকে তাগাদা দিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চুক্তি করে সমস্যা মিটিয়ে ফেলতে। আচ্ছা, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চুক্তি করেই যদি সমস্যা মিটে যায় তাহলে জাতিসংঘের প্রয়োজনটা কী? যুক্তরাষ্ট্র কি বিকল্প জাতিসংঘ?
এখন প্রশ্ন, যে সংস্থা একটি দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে পারে না, দখল ঠেকাতে পারে না, যুদ্ধ-গণহত্যা ঠেকাতে পারে না,মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের ইচ্ছা-অনিচ্ছায়-ই যখন সবকিছুর নিয়ন্তা, তখন জাতিসংঘ নামের সেই সংস্থার কি আদৌ কোনো প্রয়োজনীয়তা আছে বিশ্বে?
লেখক : প্রাবন্ধিক