জাতির মেরুদন্ড ও শিক্ষা গুরুর শির

2

এমরান চৌধুরী

দক্ষিণ চট্টগ্রামের শঙ্খ তীরবর্তী এক গ্রামে আমার জন্ম। আমার জন্মের ৫/৬ বছর পর পিতা মারা যান। একটু বুদ্ধি হওয়ার পর জানতে পারি আমার পিতা ছিলেন একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। প্রধান শিক্ষক। আজকাল যেভাবে গ্রামে গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয়, কেজি স্কুল বা মাদ্রাসা দেখতে পাচ্ছেন পাকিস্তান আমলে তা কিন্তু ছিল না। বড় বড় দুয়েক পাড়া মিলে মসজিদসংলগ্ন স্থানে ফোরকানিয়া ছিল। যেখানে ঘুম ঘুম চোখে ছেলেমেয়েরা আমপাড়া পড়ত। সাবেক পটিয়া মহকুমার আওতাধীন ১৯ ও ২০ নাম্বার ইউনিয়নের নাম ছিল যথাক্রমে বরকল ও বরমা। এই দুটো ইউনিয়ন মিলে সেই পাকিস্তান আমলে (মুক্তিযুদ্ধের ৫/৬ বছর আগে) প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল দুটো। বাবার সর্বশেষ পোস্টিং ছিল বরকল ইউনিয়নের কানাইমাদারি। অন্য স্কুলেও তিনি শিক্ষকতা করেছেন। বেতন পেতেন সর্বসাকুল্যে ৫ টাকা। কথাটা শুনতে এখন আশ্চর্য নয়, অষ্টম আশ্চর্য মনে হলেও এটাই সত্য। শায়েস্তা খাঁর আমালে গোয়াল ভরা গরু/ পুকুর ভরা মাছ ছিল। সেই সব কথা এখন ইতিহাস।
সেই ৫ টাকা বেতনের স্কুল শিক্ষকের সন্তান হিসেবে সেটাই ছিল আমাদের সাত ভাই-বোনের গর্ব। কারণ বাবা মারা যাওয়ার পর তাঁর নাম শুনলেই যাঁরা বাবাকে চিনতেন /জানতেন কিংবা বাবার ছাত্র ছিলেন সবাই আমাদের অত্যন্ত ভালোবাসতেন। তাঁদের এই ভালোবাসায় আমাদের বুক স্ফীত হতো উত্তাল সমুদ্রের মতো।
বাবা প্রয়াত হয়েছেন প্রায় ছয় দশক হয়। ৬৪ কী ৬৫ সালের রমজান মাসের প্রথম দিন তিনি ইন্তেকাল করেন। এই দীর্ঘ সময় পরও আমাদের ভাই-বোনদের সবার পরিচিতি ফোরাক মাষ্টারের ছেলে ( তিনি তাঁর নাম বানান লিখতেন ফোরাক) হিসেবে। আমাদের উত্তরসূরী আর বোনদের ছেলেমেয়েরাও ফোরাক মাস্টারের নাতি হিসেবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দবোধ করে। এর একটাই কারণ অর্থবিত্তের দিক দিয়ে আমরা এগিয়ে যেতে না পারলেও বাবার শিক্ষকতার সুবাদে আমাদের পরিবারটি আলাদা একটা মর্যাদায় আসীন হয়েছিল। গ্রামের মানুষের এমন ভালোবাসা থেকে এটাই স্পষ্ট যে শিক্ষকতা মহান পেশা। যে পেশার মানুষেরা জাতির মেরুদন্ড তৈরিতে রাখেন এমন একটি ভূমিকা, যা হাজার কোটি টাকার মালিকের পক্ষে রাখা সম্ভব নয়। এলাকার মানুষ শিক্ষক হিসেবে তো বটেই, একজন মানুষ হিসেবেও বাবাকে ভালোবাসতেন। শ্রদ্ধা করতেন। পরম নির্ভরতা আর বিশ্বস্ততার প্রতীক ছিলেন আমার বাবা। গ্রামের লোকেরা তাঁকে এতই বিশ্বাস করতেন যে, আমার এক চাচা চট্টগ্রামের জুবলি রোডে সেই পাকিস্তান আমলে বাবার নামে একটি দোকান কিনেছিলেন। বাবার নামে কেন দোকান সেটি প্রথমে বুঝতে না পারলেও পরে বুঝেছিলাম একান্নবর্তী পরিবারে অন্য ভাইদের নজর যাতে না পড়ে তার জন্য চাচা কাজটি করেছিলেন। দোকানটি বাবার নামে কেনা হলেও তাতে আমাদের কিছুই ছিল না। দোকানটি চাচাই করতেন। বাবা যখন মৃত্যুশয্যায় তখন বড় ভাইকে বলে যান আমরা যেন দোকানটি চাচা চাহিবামাত্র হস্তান্তর করি। শিক্ষক পরিবারের সন্তান হিসেবে আমরা চাহিবামাত্র ওনাকে দোকানটি হস্তান্তর করা দিয়েছিলাম ।
আমাদের চাচাতো জেঠাতো ভাইদের বেশ ক’জন বাবার স্কুলে পড়তেন। তাঁদের কাছ থেকে জানতে পেরেছি বাবা ছিলেন লেখাপড়ার ব্যাপারে ভীষণ সিরিয়াস। স্কুল ফাঁকি দেওয়া ছাত্রদের তিনি নিজে খুঁজে খুঁজে স্কুলে নিয়ে যেতেন। তাঁর হাতের লিকলিকে বেতের বারি যে একবার খেয়েছে সে জীবনে আর কোনোদিন স্কুল কামাই করেনি। শীত গ্রীষ্ম শরতে মানে সব ঋতুতে বাবা একটা ছাতা রাখতেন। সেই ছাতা বগলদাবা করে তিনি প্রতিদিন হেঁটে স্কুলে যেতেন। যাওয়ার পথে এক একজনের নাম ধরে ডেকে ডেকে নিয়ে যেতেন। যতদিন বেঁচেছিলেন পরের সন্তানকে মানুষ করতে নিজের সর্বোচ্চ ত্যাগ করেছেন। আমার এক জেঠাতো ভাইযের নাম লেদিয়া (আঞ্চলিক ডাক নাম)। তিনি বাবাকে ডেকে ডেকে পড়া বুঝে নিতেন। তখনকার সময় বেশিরভাগ বাড়ি ছিল লাগোয়া-মাটিরঘর। ফলে এক ঘর থেকে ডাক দিলে অন্য ঘরে শোনা যেত। জেঠাতো ভাই রাত জেগে পড়তেন। আর বাবাও রাত জেগে পড়া বুঝিয়ে দিয়ে তারপরই ঘুমাতেন।
বাবাকে গ্রামের মানুষ কতটা ভালোবাসতেন এবং বিশ্বাস করতেন তার জ্বলন্ত প্রমাণ পাই এক ঘটনায়। ১৯৯৭ সালের প্রথম দিককার কথা। আমার ছোট ভাইয়ের জন্য পাত্রী খোঁজা হচ্ছে। পাশ্ববর্তী উপজেলার এক গ্রামের এক পাত্রীর খবর দেন আমার এক খালাতো ভাই। সবকিছু জেনে শুনে আমার তালই আসেন আমাদের গ্রামে। আমাদের বাড়ির সামনে পেছনে দুদিকেই সরু রাস্তা। তিনি সামনের রাস্তা দিয়ে ঘুরে পেছনের রাস্তা দিয়ে বের হয়ে উঠেন স্থানীয় বাজারে। সেখানে তিনি কোনো একটা দোকানে বসে হয়তো কিছু একটা ভাবছিলেন। হাজার হোক কনের বাপকে অনেক কিছু ভাবতে হয়। এ ভাবনারত অবস্থায় এক ভদ্রলোক এসে তাঁকে সালাম দিলেন। ভদ্রলোক তাঁকে চিনতেন। কুশলাদি জানার পর ভদ্রলোক আমার তালইকে জিজ্ঞেস করলেন, এখানে কী জন্য এসেছেন? তালই বললেন, একটা ছেলের খোঁজ নিতে এসেছেন। কার ছেলে? পিতার নাম কী? ফোরাক মাস্টার। এ কথা শোনামাত্র ভদ্রলোক বললেন, ‘ফোরাক মাস্টার। হ্যাঁ। ফোরাক মাস্টারের ছেলে হলে আপনার আর কোনো খোঁজ নেওয়ার দরকার নেই। আপনি চোখ বন্ধ করে সম্পর্ক করতে পারেন। ‘আমি জানি না লোকটা কে এবং তিনি আমার ভাইকে চিনতেন কি না? একজন শিক্ষকের প্রতি কতটা ভালোবাসা থাকলে মানুষ এমন কথা দ্বিধাহীন চিত্তে বলতে পারেন তা ভাবতেই আশ্চর্য হতে হয়।
ব্যক্তিগত বিষয় টেনে আনার মূল কথা হলো শিক্ষক সবসময় সম্মানিত। এই সম্মানিত ব্যক্তিদের সম্মান করা হলেই তাঁদের হাত ধরে ভালো ভালো শিক্ষার্থী বের হবে। শিক্ষকদের প্রতি আস্থার সংকট হয়, হতেও পারে। তিনিও তো মানুষ, ফেরেশতা নন। এক্ষেত্রে কোনো দোষত্রæটি চোখে পড়লে তা অবশ্যই প্রতিষ্ঠান প্রধানকে জানাতে হবে। প্রতিষ্ঠান প্রধান তাঁর কাছে ব্যাখ্যা চাইতে পারেন। সংশোধনের তাগিদ দিতে পারেন। অপরাধের প্রকরণভেদে বহিষ্কার করতে পারেন। স্থায়ী বরখাস্তের জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের বরাবরে সুপারিশ পাঠাতে পারেন। শিক্ষার্থী বা সংক্ষুব্ধ পক্ষ লিখিত বা মৌখিক আকারে অভিযোগ করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় অনুসরণ করা মোটেই ন্যায্য নয়।
শিক্ষক জীবনের আরাধ্য সম্মান। একজন ছাত্র যখন হুট করে পায়ে পড়ে সালাম করে তখন খুশিতে তাঁর মনটা ভরে ওঠে। একজন ছাত্র যখন পরবর্তীজীবনে বড় কোনো পদে আসীন হয়ে শিক্ষককে দেখামাত্র চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান এই দৃশ্য একজন শিক্ষকের জন্য সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। এই প্রাপ্তির কোনো তুলনা হয় না। এমন শিক্ষক যদি কোমলমতি শিক্ষার্থীদের দ্বারা এতটুকু অপমানিত হন তাহলে তাঁর হৃদয়টা ভেঙে চুরচুর হয়ে যায়। এ অবস্থায় ঐ শিক্ষকের কাছে ক্ষমা চাইলেও তাঁর মনের ক্ষত কতটা শুকায় তা গবেষণার বিষয়। তাঁর দ্বারা আর সম্ভব হয় না পূর্বাবস্থায় ফিরে যেতে। আগের মতো আন্তরিকতার সাথে পাঠদান করতে। তাই শিক্ষাঙ্গনে সুষ্ঠু পরিবেশ যথাযথ পাঠদানের পূর্বশর্ত। একটি সুশৃঙ্খল পরিবারের মতো শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশও যাতে অব্যাহত থাকে সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সকলকে দায়িত্বশীল হতে হবে। মনে রাখতে হবে মা-বাবার আশির্বাদ আর শিক্ষকের আশির্বাদের হাত অভিন্ন। জাতির মেরুদন্ড তখনই শক্ত হয়, উন্নত হয়, প্রয়োজনীয় পুষ্টি পায় যখন মা-বাবার মতো শিক্ষকগণও পায় তাঁর প্রাপ্য মর্যাদা, সম্মান। কবি কাজী কাদের নেওয়াজ-এর ভাষায় তাই বলতে চাই, ‘আজ থেকে চির উন্নত হলো শিক্ষা গুরুর শির/ সত্যই তুমি মহান উদার বাদশাহ আলমগীর।’ সকল আঁধার কেটে আমরা অতীতের মতো প্রত্যেক শিক্ষকের শির চির উন্নত দেখার প্রত্যাশায় থাকলাম।

লেখক : শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক