অধ্যক্ষ আবু তৈয়ব
২৫ আগস্ট, দায়িত্ব নেয়ার দুই সপ্তাহের পর জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ডক্টর ইউনূস ‘শিক্ষায় নৈরাজ্য দূরিকরণে সংস্কার করা হবে’ বলে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। যা প্রশংসার দাবী রাখে। এই জন্য প্রশংসার দাবী রাখে যে একটি দেশের সার্বিক আর্থিক-সামাজিক উন্নয়ন নির্ভর করে শিক্ষায় নৈরাজ্য না থাকার উপর, ও মানের উপর। তবে সেই শিক্ষায় বৈষম্য থাকা যাবে না। রবীন্দ্রনাথ এর কথায় ‘শিক্ষা সকলের জন্য, শ্রেণীবিশেষ বা গোষ্ঠিবিশেষের জন্য নয়। যে শিক্ষা জাতিবর্ণ ধনীদরিদ্র নির্বিশেষে সকলের জন্য নয়, তা শুধু অর্থহীন নয়, তা ক্ষতিকর। তা দেশের মধ্যে, কিন্তু দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন একটি বিশেষ সুবিধাভোগী স¤প্রদায়ের সৃষ্টি করে এবং শিক্ষা তখন শোষণেরই যন্ত্র হয়ে দাঁড়ায়।’ এই বক্তব্যে স্পষ্ট যে জাতীয় পর্যায়ে বৈষম্যহীন সবার জন্য শিক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারলেই সমাজে শিক্ষা রসাম্য প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার হয়ে উঠে, বৈষম্য দূর হয়। আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা বহু ধারায় বিভক্ত থাকায় সমাজে বৈষম্যহীন সাম্য ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা আজ পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। বরং শ্রেণি বৈষম্য বাড়িয়ে দিয়েছে, বহু ধারায় বিভক্ত এই শিক্ষা ব্যবস্থা। জাতীয়জীবনের সমস্ত প্রধান সমস্যার মূল সমাজের অশিক্ষায়। তাই বৈষম্যহীন ও সার্বজনীন শিক্ষা হলো সমাজের সমস্যা সমাধানে ও জাতীয়জীবনের পুনর্গঠনের প্রথম ধাপ।
এই প্রথম ধাপে শিক্ষার নৈরাজ্য দূরিকরণের সংস্কার করা খুবই প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক মানের পÐিত প্রফেসর ড. মো. ইউনূস এর পক্ষেই অনুধাবন করা সম্ভব হয় যে সুশিক্ষা দিয়েই সুনাগরিক গড়ে তুলতে হবে, যারা সমাজ ও দেশ পরিচালনায় সম্পদ হয়ে উঠবে। কারণ শিক্ষাই মানুষকে যুক্তির পথ চেনায়, বিজ্ঞানে আগ্রহী করে তুলে, কৃষিতে উন্নত করে এবং কারিগরীতে পারদর্শী করে। শিক্ষা দেশের মানুষকে সচ্ছল, সুস্থ ও সুখী করে, শিক্ষা তাদের আত্মবিশ্বাসী করে স্বাধীনতাকামী করে, সংগঠিত করে। সুতরাং শিক্ষার সুব্যবস্থাই আগে করতে হয়। তার পরে অন্য সব সংস্কার করতে হয়। যাঁরা বলেন আগে রাজনৈতিক স্বাধীনতা, তার পরে শিক্ষা, অথবা যাঁরা বলেন আগে সমাজবিপ্লব, তার পরে শিক্ষা, তাঁরা ঘোড়ার আগে গাড়িকে বসাতে চান। রাজনৈতিক কোলাহল ও দ্বন্দ্বমুক্ত এই সময়ে মান সম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য বিষয়গুলো নিয়ে ভাবা যায়, বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া যায়। এই বিবেচনায় রাখলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শিক্ষাকে সংস্কার করার কাজে আগে হাত দেয়া জরুরি। যা অন্যান্য অসংগতিকে দূর করে অব্যবস্থাকে সহজে নিয়ন্ত্রণে আনতে ভূমিকা রাখবে। এই জন্য চিন্তার দৈন্য কাটিয়ে উঠতে হয়। আর শিক্ষাকে জাপানের মতো অগ্রাধিকার বিবেচনায় শিক্ষার চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত অর্থবরাদ্দ দিয়ে সুষ্ঠুভাবে দক্ষতার সহিত মনিটরিং করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়।
ভয়ে শিক্ষা নিয়ে কাজ করা যায় না। যেখানে ভয় সেখানে স্বতঃস্ফূর্ততা থাকে না। আর স্বতঃস্ফূর্ততা না থাকলে বিশেষ করে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশ হতে পারে না, সৃজনশীল হয়ে উঠতে পারে না। এজন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভীতিকর অবস্থা দূর করতে হয় আগে। প্রশাসনিক ব্যবস্থা ক্ষমতামুখী হওয়া থেকে শিক্ষামুখী থাকার ব্যবস্থা নিশ্চিত রাখতে হয়। নানা মানসিকতার ও মতের বহুত্বের মধ্যে একত্ব তৈরি থাকার প্রেক্ষিত রাখতে হয়। যা শিক্ষার গুণগত মানকে ও জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রকে প্রসারিত করে। তাই একক মানসিকতা ও একক মতবাদ থাকা প্রতিষ্ঠান কর্মী তৈরি করতে পারে সৃষ্টিশীল জ্ঞানী তৈরি করতে পারে না।
প্রশাসন সংশ্লিষ্টদের ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হওয়া থেকে দূরে রাখতে হয়। আমাদের দুর্ভাগ্য এই যে জ্ঞানবিমুখ সমাজের শিক্ষা সংস্কৃতিতে শুধু শিক্ষার নিম্নতর বা গৌণ লক্ষ্যকে আমরা গুরুত্ব দিয়ে থাকি। তা হলো যে কোনভাবে শিক্ষার্থীকে পরীক্ষায় নম্বর বেশি পেতে হবে, তা বিপুল অর্থব্যয় করে হলেও। এবং ভাল সনদ পেতে হবে চাকুরির জন্য। এই যদি শিক্ষার লক্ষ্য হয় তা হলে এই নিম্নতর লক্ষ্য অর্জনের শিক্ষা জাতিকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে, জাতিকে কোন মানে পৌঁছাতে আগাম তো ধারণা করা যায়। শিক্ষার উচ্চতর বা মুখ্য লক্ষ্যের দিকে আমরা অভিভাবক, শিক্ষার্থী এমন কি শিক্ষকও এতই উদাসীন হয়ে পড়েছি সেই মূল লক্ষ্যের কথা ভুলতে বসেছি। প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. ইউনূস সাহেব আমাদেরকে সেই সংস্কৃতি থেকে বাইর হয়ে আসার জন্য বার বার তাগদা দিয়ে যাচ্ছেন। আমরা যেন শুধু চাকুরিমুখী শিক্ষায় আবদ্ধ হয়ে না পড়ি। শুধু জীবিকার্জনের যোগ্যতালাভ, বেচেঁ থাকার হাতিয়ার করায় শিক্ষাকে সীমিত না করি। শিক্ষার প্রধান বা মুখ্য লক্ষ্য হলো তো যথার্থ মানুষ হওয়া। স্বাধীন ও সৃজনশীল হয়ে সামাজিক ও রাষ্ট্রিক সম্পদ হয়ে উঠা। মুখ্যত সেই মূললক্ষ্য অর্জনের জন্য রাষ্ট্র প্রতি শিক্ষার্থীর পিছনে এত বিনোয়োগ করে। অন্যদিকে একটি জীবনচর্যাকে নিজের করে নিতে পারার ব্যবস্থা থাকে।
এমন পরিবেশ চাই যাতে শিক্ষার্থী জ্ঞান, ভাব ও কর্মের মধ্য দিয়ে নিজেকে সৃষ্টি করতে পারি। শিখার বিষয়কে শুধু বিষয় হিসাবে দেখার সংস্কৃতিতে রাখলে হয় না। ‘রসায়ন’ বল, সাহিত্য বল, সবইকে জীবনের সাথে যুক্ত করে নিতে হয়, জীবনকে সমৃদ্ধ করার জন্য। এই জন্য সাহিত্যজ্ঞান শুধু সাহিত্যজ্ঞান ভাবার মানসিকতা থেকে বাহির হয়ে সাহিত্যের রসোপভোগ ও সাহিত্যসৃষ্টিতে নিবেদিত হওয়ার ক্ষেত্র দিতে হয়। কোমল বিজ্ঞান যেমন কলা ও সঙ্গীতকে শুধু শিক্ষণীয় বিষয় ভাবার দৃষ্টিভঙ্গি পালটাতে হবে। সৌন্দর্য শুধু অবসরের খোরাক নয়, জীবনের অঙ্গ ও অস্ত্বিতের অংশ হিসাবে নিতে হবে। পাশাপাশি জ্ঞান বুদ্ধি বিকাশের নানা জঞ্জাল ও অন্তরায়ের মধ্যে থেকেও বুদ্ধিকে মোহমুক্ত ও সতর্ক করাবার জন্য বিজ্ঞান চর্চাকেও এগিয়ে রাখতে হয় ও বিজ্ঞান মেজাজি প্রজন্ম গড়ে তোলার উপর জোর দিতে হয়। এতে শিক্ষার উৎপাদনশীলতা বেড়ে যাবে। তবে আর্থিকভাবে পিছিয়ে থাকা সমাজে ও অভাব অনটনে থাকা পরিবারে শিক্ষার্থীকে অনেকটা বাধ্য হয়েই জীবিকামুখী ও ডিগ্রিমুখী তথা পরীক্ষামুখী থাকতে হয়।
গুরুত্বপূর্ণ এই কথা মনে রাখত হয়, সব দেশে শিক্ষা সংস্কারের ইতিহাস হচ্ছে আচরণবাদী ধারণা থেকে গঠনবাদী ধারার দিকে যাওয়ার চেষ্টা করা। অন্য কথায় পাঠ্য বিষয় যে কোনভাবে মুখস্থ করানো তা পরীক্ষার খাতায় হউক বা উচ্চারণ করে হউক প্রকাশ করাতে পারা। আর বিষয়কে শিক্ষার্থীর নিজস্বতায় আয়ত্ত করার প্রেক্ষিত দিয়ে তাকে তার অভিজ্ঞতা থেকে শিখার প্রক্রিয়াই হলো গঠনবাদ। এই গঠনবাদী শিক্ষা ধারার অগ্রগতিতে যে দেশ এগিয়ে থাকতে পারে সে দেশ শিল্পে, মেধা ও মননে এগিয়ে থাকে। জরিপে তাই দেখা যায়। এই গঠনবাদী শিক্ষাব্যবস্থার মূল কথাই হলো সামাজিক ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়ায় সক্রিয় অংশ গ্রহণ করে শিশু শিখে। এখানে কোন বিষয়ে শেখানোর সময় শিক্ষার্থীকে ধাপে ধাপে সহায়তাদানের প্রয়োজন হয়। যাতে শিক্ষার্থীর অনুসন্ধিৎসা ও মেধা কাজে লাগাতে পারে, জ্ঞান উৎপাদন করতে পারে। এর জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত ও যোগ্য শিক্ষক। শিক্ষার্থীর স্বনির্ভরতার ভিত্তিতে এই প্রক্রিয়ায় কাজ করতে হয়। এই সব সম্ভব হয় না আমাদের মত দেশে। সেই যোগ্যতার ও দক্ষতার শিক্ষক যথেষ্ট সংখ্যক তৈরি করা সম্ভব হয় না বলে। শিক্ষায় আবার প্রয়োজনীয় আর্থিক সংস্থানও করা যায় না বলে। তাই প্রত্যাশিত গতি ও মানে গঠনবাদী শিক্ষার দিকে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে সংস্কার করে এগিয়ে নেওয়াটা অত সহজ হচ্ছে না। এখানেই মনোযোগের বিষয়, জোর দেয়ার বিষয়। প্রধান উপদেষ্টা ভাষণে শিক্ষাব্যবস্থায় সংস্কারের যে কথা উল্লেখ করেছেন সেই সংস্কারের দিক গঠনবাদের দিকে হলে তা হলে এই আশা করা যায়, শিক্ষার মান বাড়বে, প্রজন্মদের ভবিষ্যৎ সুন্দর হবে। সেই দিকে জোর দিয়ে সংস্কার করলে মানসম্মত শিক্ষার নিশ্চয়তার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে।
প্রধান উপদেষ্টা এপর্যন্ত যা বক্তব্য দিয়েছেন, ভাষণ দিয়েছেন তার কথাগুলো সংক্ষেপে এভাবে বলা যায়, ভাঙাগড়ার ভিতর দিয়ে মহৎ কিছুর লক্ষ্য অর্জনের জন্য ধৈর্য ও সময়ের প্রয়োজন। নদীর প্রবাহের মাঝে পলি জমে জমে ফসলি চর/দ্বীপ গড়ে উঠতে সময় লাগে। আরও লাগে নানা প্রতিক‚লতা মোকাবেলা করে টিকে থাকার সৎসাহস ও অদম্য কর্মস্পৃহা। আবার ভবিষ্যত প্রজন্মদের মাঝে সেই সৎসাহস, অদম্য জ্ঞান ও কর্মস্পৃহা তৈরি এবং সঞ্চারিত হওয়া চলমান রাখাতেও তৎপর থাকতে হয়। তার জন্য শিক্ষায় পুনঃজাগরণ ঘটানোর পাশাপাশি শিক্ষাকে সজীব ও বিকাশমান রাখতে হয়। যেখান থেকে কথা বলার স্বাধীনতা, নিজের ধর্ম পালনের স্বাধীনতা, অভাব থেকে মুক্তির স্বাধীনতা, ভয় থেকে মুক্তির স্বাধীনতা শিক্ষার্থী লাভ করতে পারবে। এসবের মধ্যে বড় কথা হলো আমাদের, সাধারণ জনগণের সেই সব ধারণ করতে, মর্যাদা বোঝতে ও গুরুত্ব অনুধাবনের প্রতি কতটুকু সচেতন ও দায়িত্বশীল থাকতে পারছি সেটা। যদি তা থাকা সম্ভব হয় তা হলে প্রধান উপদেষ্টা শিক্ষায় নৈরাজ্য সংস্কারের যে কথা জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে ব্যক্ত করেছেন তা শিক্ষায় প্রত্যাশা পূরণ সম্ভব হবে।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট
অধ্যক্ষ- খলিলুর রহমান মহিলা কলেজ, চট্টগ্রাম