প্রধান উপদেষ্টা নোবেল বিজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত বুধবার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫ম সমাবর্তনে অংশগ্রহণের জন্য নিজ জন্মভূমি চট্টগ্রামে আসেন। উদ্দেশ্য যদিও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন, প্রকৃতপক্ষে তিনি বন্দরের আধুনিকায়নের প্রস্তাবনা, নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের দ্রুত বাস্তবায়ন ও কালুরঘাট সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে চট্টগ্রামবাসীর নজর কেড়েছেন। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সবার আগে নজর দিলেন চট্টগ্রামের দুঃখ হিসেবে পরিচিত জলাবদ্ধতা সংকট নিরসনের দিকে। তারও আগে তিনি চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনালের (এনসিটি) ৫নং ইয়ার্ড পরিদর্শন করেন। এসময় তিনি বন্দর ব্যবহারকারী ও ব্যবসায়ীদের সাথে এক মতবিনিময় সভায় মিলিত হন। সভায় চট্টগ্রাম বন্দরকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করতে অন্তর্বর্তী সরকারের নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা জানান। এসময় চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবস্থাপনায় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কাজ করে এমন দক্ষ ব্যবস্থাপকদের হাতে বন্দর পরিচালনার ভার ন্যস্ত করার সরকারের উদ্যোগের কথা জানান। তিনি বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারে নেপাল, ভুটান ও সেভেন সিস্টারকে সুযোগ দেয়া হলে বাংলাদেশ লাভবান হবে। এসময় সিঙ্গাপুরসহ বিশ্বের বিভিন্ন বন্দরের আধুনিকায়ন ও আন্তর্জাতিক মানের বিষয়টি তিনি তুলে ধরেন। পরে নগরীর সার্কিট হাউসে জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের অগ্রগতি নিয়ে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন, জেলা প্রশাসন ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট নগর সেবা কর্তৃপক্ষগুলোর সাথে মতবিনিময় সভায় মিলিত হন। এসময় তিনি জলাবদ্ধতা প্রকল্পের অগ্রগতির বিষয়ে নগর কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্টদের কথা ধৈর্য্যসহকারে শুনেন। পরে তিনি চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা চলতি বছরের বর্ষা মৌসুমে আগের তুলনায় অর্ধেকে এবং ক্রমান্বয়ে শূন্যে নামিয়ে আনতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেন। দৈনিক পূর্বদেশসহ সহযোগি পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, এসময় প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস চট্টগ্রামের উন্নয়নে তাঁর সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ তুলে ধরেন। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা অনেক রকম থিওরিটিক্যাল আলোচনা করেছি। সেসব আর করতে চাই না। আমরা চাই জলাবদ্ধতার সমস্যা থেকে চিরতরে বের হয়ে আসতে। কিন্তু সেটা একবারেই হবে না, তাই আমাদেরকে ক্রমান্বয়ে অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘এবছর যেহেতু বর্ষা মৌসুম ইতোমধ্যে এসে গেছে তাই এবার সমস্যা পুরোপুরি সমাধান সম্ভব হবে না। কিন্তু গত কয়েক মাসে সিটি কর্পোরেশনসহ স্থানীয় সরকারের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলো সম্মিলিতভাবে যে প্রচেষ্টা চালিয়েছে তাতে যদি এবছর যদি তারা আশানুরূপ ফল না আসে তাহলে তো সবকিছু মনে হবে জলে গেল।’ চট্টগ্রামের ঐতিহ্য ও ঐতিহাসিক অর্জনের কথা উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসন হচ্ছে একটি প্রতীকী সমস্যা এবং খুবই জটিল সমস্যা। এই সমস্যা নিরসনের মাধ্যমে অন্যান্য শহর ও জেলা উৎসাহিত হবে। তাই চট্টগ্রামকে এই কাজে দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করতে হবে। এই সমস্যা নিরসনে নিয়মিত তাগিদ দেওয়ার নির্দেশনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রাম শহরের যে সক্ষমতা রয়েছে অন্য অনেক অনেক শহরের সেই সক্ষমতা নেই। তাই চট্টগ্রামের সব প্রতিষ্ঠানকে সক্রিয় হতে হবে এবং নাগরিক সমাজকে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখে নিজেদের সক্ষমতার প্রমাণ দিতে হবে।’ সভায় চট্টগ্রাম-অক্সিজেন ও হাটহাজারী মহাসড়ক উন্নয়নের বিষয়ে ব্যাপক আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হয়।
চট্টগ্রামবাসীর জন্য সৌভাগ্যের বিষয় যে, ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীনের পর দেশের নির্বাহী প্রধান হিসেবে প্রথম কোন চট্টগামবাসীকে তারা পেয়েছেন। দেশের দ্বিতীয় বৃহৎ নগর ও প্রধান সমুদ্র বন্দর চট্টগ্রামের উন্নয়নে এর চেয়ে বড় সুযোগ আর আছে বলে মনে হয় না। ড. ইউনূসের ব্যক্তিত্ব ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে তাঁর যে গ্রহণীয়তা তাকে সম্বল করে চট্টগ্রামকে সত্যিকার বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে গড়ে তোলার প্রয়াস এখনই নিতে হবে। এক্ষত্রে চট্টগ্রামের সন্তান প্রধান উপদেষ্টার আন্তরিকতা ও দায়িত্বশীল ভূমিকা প্রত্যাশা করে চট্টগ্রামবাসী। চট্টগ্রাম অবকাঠামোর দিক দিয়ে বেশ এগিয়ে গেলেও দেশের অর্থনীতিতে চট্টগ্রামের যে অবদান সেই তুলনাই অপ্রতুলই বলা যায়। জলাবদ্ধতার প্রধান যে সংকট তা চাক্তাই খালেই নিহিত। দেশের অন্যতম প্রধান নদী কর্ণফুলীর সাথে যার সংযোগ। এক সময় যে নদীটির প্রস্থ ছিল প্রায় আড়াই কিলোমিটার সেটি এখন আধা কিলোমিটারের চেয়ে কম। এ নদীর সাথে প্রধান সংযোগকারী চাক্তাই খাল একসময় বাণিজ্যিক নৌপথ হিসেবে ব্যবহার হত। সেখানে এখন নৌকা চলাচলের মত অবস্থা নেই। অবৈধ দখল, ভরাট আর দূষণে পর্যুদস্ত চাক্তাই খাল। এ ঐতিহাসিক খাল আর কর্ণফুলী নদী পুনরুদ্ধার ও দখলমুক্ত করতে পারলে জলাবদ্ধতার সংকট অর্ধেক কমে যাবে। কিন্তু এ কাজটি কে করবে, কীভাবে করবে-তা আলোচনার বিষয়। অতীতে আদালতের কঠোর নির্দেম জেলা প্রশাসন, সিডিএ, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এবং বন্দর কর্তৃপক্ষ কর্ণফুলীকে দখলমুক্ত করতে বহু কামান দাগিয়েছিল, কিন্তু তাতে কিছুই হয়নি। যে লাউ সেই কদুই আমরা দেখে আসছি। এক্ষেত্রে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস একটু নজর দিলেই সংকটের ইতি ঘটবে বলে আমাদের প্রত্যাশা। আমরা চট্টগ্রাম বন্দর ও নগরীর উন্নয়নসহ জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রধান উপদেষ্টার দেয়া নির্দেশনা বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্টদের আন্তরিকতা প্রত্যাশা করছি।