বান্দরবান ও রাঙামাটি প্রতিনিধি
বান্দরবানে জলকেলিতে মাতোয়ারা মারমা তরুণ-তরুণীরা। সাংগ্রাই উসৎবে প্রধান আকর্ষণ জলকেলি। জলকেলি উৎসবে বান্দরবানের মারমা শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণীরা মেতে উঠেছে এই পানি খেলায়। পানি খেলার মাধ্যমে পুরনো বছরের সকল দুঃখ-কষ্ট, গ্লানি ধুয়ে-মুছে নতুন বছরকে বরণ করে তারা। তবে এটি এখন শুধু মারমাদেরই না এই উৎসব এখন সার্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে। পুরো জেলা শহরজুড়ে চলছে পানি খেলা। শিশু থেকে শুরু করে তরুণ-তরুণী এমনকি বয়স্করাও একে অপরের গায়ে পানি ঢেলে নতুন বছরকে বরণ করে নিয়েছেন। গতকাল বুধবার বিকেলে জেলা শহরের রাজার মাঠে জলকেলিতে অংশ নেওয়া তরুণ-তরুণীদের একে অপরের গায়ে পানি ঢেলে মৈত্রী পানিবর্ষণ প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেন। জলকেলি উৎসবে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয় নারী-পুরুষ। বুধবার বিকেলে জলখেলি উৎসবে পাহাড়ী বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকজন উপস্থিত ছিলেন। এছাড়াও আশপাশের শত শত পাহাড়ি নারী-পুরুষ এবং দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পর্যটকরা ভিড় জমান জলকেলি উৎসবে। সাংগ্রাই উৎসবে জলখেলির পাশাপাশি আয়োজন করা হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের।
আয়োজক কমিটির সভাপতি চনু মং মার্মা বলেন, বান্দরবান একটি সম্প্রীতির জেলা। জেলার সকল সম্প্রদায়ের সাংগ্রাই উৎসব মিলেমিশে এবং শান্তিশূর্ণভাবে উৎসব উপভোগ করেন। তিনি মনে করেন, নতুন প্রজন্মকে দেখিয়ে দিয়েছি যে আমাদের সংস্কৃতিগুলো ফিছিয়ে পড়ছে। সেই ফিছিয়ে পড়া সংস্কৃতিগুলো তুলে এনে আমরা নতুন প্রজন্মকে উপহার দিচ্ছি। চনু মং আরো বলেন, আমাদের মূল অনুষ্ঠান হচ্ছে পানি উৎসব। যাকে ঘিরে পার্বত্য অঞ্চলসহ সারা বাংলাদেশের মানুষের ঢল নামে। এ উৎসবকে ঘিরে এক মহামিলন ঘটে। ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত এই উৎসব চলবে। এই জেলার সকল সম্প্রদায়ের সাংগ্রাই উৎসব মিলেমিশে এবং শান্তিপূর্ণভাবে উপভোগ করেছে। পাহাড়ী-বাঙালির যেই সম্প্রীতির বন্ধন রয়েছে মঙ্গল কামনা করেন পাহাড়ী এই নেতা।
অপরদিকে রাঙামাটির রাজস্থলীতে মারমা স¤প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী সাংগ্রাই জলকেলি উৎসবের মধ্য দিয়ে শেষ হলো পাহাড়ের সবচেয়ে বড় সামাজিক উৎসব বৈসাবি। গতকাল বুধবার রাজস্থলী উপজেলার বাঙ্গালহালিয়া উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে এই উৎসবে অংশ নেন হাজারো মারমা স¤প্রদায়ের পাহাড়ি শিশু-কিশোর। সাংগ্রাই গানের তালে তালে একে অপরকে পানি ছিটিয়ে স্বাগত জানানো হয় নতুন বছরকে।
পুরাতন বছরের গানি ও দুঃখ দূর করে আনন্দে ভেসে যায় পুরো মাঠ। ছোট ছোট পাত্রে রাখা পানি ছিটিয়ে তরুণ-তরুণীরা উৎসবের আনন্দ ভাগাভাগি করেন। জনশ্রæতি রয়েছে এই উৎসবের মধ্য দিয়েই অনেকেই বেছে নেন তাদের প্রিয় মানুষকে। মারমা ভাষায় এই উৎসবকে বলা হয় ‘সাংগ্রাই রিলাং পোয়ে’ অর্থাৎ মৈত্রী জল বর্ষণের উৎসব। ছোট ছোট পাত্রে রাখা জল থেকে দলবেঁধে তরুণ-তরুণীরা একে অপরকে পানি ছিটিয়ে শুভেচ্ছা জানান, খুঁজে নেন আপনজন, ভালোবাসার সঙ্গী। উৎসবের মূল বার্তাই হলো বন্ধুত্ব, ভালোবাসা ও স¤প্রীতির বন্ধন আরও দৃঢ় করা।
বর্ণিল পোশাক আর হাস্যোজ্জ্বল মুখে মুখর হয়ে ওঠে পুরো প্রাঙ্গণ। আয়োজন হয় সাংস্কৃতিক পরিবেশনা, মঞ্চে পরিবেশিত হয় মনোমুগ্ধকর নৃত্য ও গান। দিনভর চলেছে আনন্দমুখর পরিবেশে পানির উৎসব। অনুষ্ঠানের শুরুতে ধর্মীয় প্রার্থনা ও মঙ্গলাচরণ শেষে কেক কেটে ও মারমা স¤প্রদায়ের মং বাজিয়ে জলকেলি উৎসবের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি কাপ্তাই জোন কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল এসএম মাহমুদুল হাসান সোহান। সভাপতিত্ব করেন মারমা সংস্কৃতি সংস্থা (মাসস) এর সভাপতি বাবু মংসুইপ্রু মারমা।
উৎসবে অংশ নেওয়া তরুণ-তরুণীরা বলছেন, শুধু একটি জলকেলি নয়, এটি আমাদের সংস্কৃতির গভীরতম বন্ধনকে স্মরণ করিয়ে দেয়। ভালোবাসা, সম্মান আর ঐতিহ্যের মিলনমেলা হয়ে ওঠে এই দিনটি।
জল উৎসব অনুষ্ঠানে সাংগ্রাইং উদযাপন কমিটির সভাপতি মংসুইপ্রুু মারমার সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথি ছিলেন লে. কর্নেল কাওসার মেহেদী সিগন্যালস্ জোন কমান্ডার, ওয়াগ্গাছড়া জোন, লে. কর্নেল মুহাম্মদ জুনাঈদ উদ্দীন শাহ চৌধুরী এসইউপি, পিএসসি, লে. কর্নেল এসএম মাহমুদুল হাসান সোহাগ পিএসসি জোন কমান্ডার, কাপ্তাই জোন, মেজর মো. আসফিকুর রহমান জিএসও-২ (ইন্ট) রাঙামাটি রিজিয়ন, ক্যসুইথুই চৌধুরী হেডম্যান ৩২০ নং কাকরাছড়ি মৌজাসহ অন্যান্য অতিথিবৃন্দ।
আগামী ১৯ এপ্রিল রাঙামাটির মারী স্টোডিয়ামে জলকেলির মধ্য দিয়ে সমাপ্তি ঘটবে পাহাড়ি জনপদের পঞ্চদশ দিনের সাংগ্রাই উৎসব। এই উৎসব শুধু আনন্দের নয়, এটি পাহাড়ি সংস্কৃতি, ঐতিহ্য আর সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতির এক অপূর্ব প্রতীক।