মিঞা জামশেদ উদ্দীন
চোখের পলকে লাফিয়ে ওঠেছিল, সেকেন্ডে সেকেন্ডে কয়েক লাফ; যেন বুকের ওপর চড়ে বসবে! সামনে পা ফেলারও সুযোগ নেই। কোনোভাবেই সীমানা ক্রস করা যাচ্ছে না। এমন নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেই। সঙ্গে গগন জোড়া ঘেউ ঘেউ চিৎকার। এর মধ্যে মনিব এসে গেলে লেজ নেড়ে নেড়ে শান্ত হয়। তখনই হালে পানি আসে। এবং স্বস্তির ফিরে আসে মনে। তখন চোখে পড়ার মতো আরেকটি দৃশ্য- প্রতিবারই শূন্য ডিগ্রি কোণ থেকে লাফিয়ে উঠেছিল! পুনরায় ডিগবাজি খেয়ে একই বিন্দুতে ফিরে আসা। বলছিলাম, একটি কুকুর ছানার গল্প। কিন্তু এটি ছানা কুকুর নয়; আকার-গঠন- প্রকরণ ও ওজনে এ ধারণা পোষণ করা যেতে পারে। ছানা কুকুরটির ওজন সর্বোচ্চ ৫০০ গ্রাম হবে। পুরো শরীরজুড়ে লম্বা লম্বা লোমে আবৃত। চোখ কোথায় যে লুকিয়ে রেখেছে বা লোমে ডাকা পড়ছে, তা খুঁজে মেলাবার। অর্থাৎ নাক-চোখ-মুখ দেখাই যাচ্ছে না। উচ্চতা সর্বোচ্চ ৪ ইঞ্চি। লম্বাও অনুপাতে, ৮ ইঞ্চি হবে। এ প্রজাতির কুকুর সচরাচর দেখা যায় না। গৃহকর্ত্রী বলছেন, কুকুরটি বয়স দুই বছর। তাহলে বাচ্চা কুকুর নয়- এটি এ প্রজাতির ও বংশধর কুকুর। তাদের আকার-ঘটন এ রকমই। তা হলে বাচ্চা বয়সে-এর অবস্থা কেমন ছিল সঙ্গত কারণে প্রশ্ন আসতে পারে।
কুকুরটি মালিক উলিয়াম টমার্স। তিনি একজন এমবিবিএস ডাক্তার। বাড়ি বান্দরবান জেলায়। একবার তাঁদের বাসায় যাওয়া হয়। তিনি হলেন, আমার বড় ভগ্নিপতি নিজাম উদ্দিন দারোগা সাহেবের বন্ধু। ওই সুবিধা তাঁদের বাসায় বেড়াতে যাওয়া। বান্দরবান সদরে তাদের দ্বিতল বিল্ডিং, বাসা-বাড়ি রয়েছে। সঙ্গে বড় আপা আনোয়ারা বেগমও ছিলেন। ডাক্তার উলিয়াম টমার্সের বাবাও একজন পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন। সম্ভবত সে কারণে দুলাভাইয়ের সঙ্গে সম্পর্কের দিকটা ভালো ছিল। যাক, এখন সেই কথা। ‘উলিয়াম টমার্স ও তাঁর কুকুর’ নিয়ে আমার একটি গল্প আছে। ওটি গ্রন্থিত-ও হয়। তিনি কুকুর নিয়ে ইতিবৃত্ত বলতে গিয়ে আরো লোমহর্ষক ইতিহাস জানালেন। তিনি তরুণ ও ছাত্রত্বকালে পিসিজেএসএস-এর সদস্য ছিলেন। তখন ওই সংগঠনকে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদ্রোহী ও নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। অবশ্য ১৯৯৭ সালে ২ ডিসেম্বর জনসংহতি সমিতির (পিসিজেএসএস) সাথে শান্তি চুক্তি হয়। জনসংহতি সমিতির প্রধান ছিলেন সন্তু লারমা। তরুণ পিসিজেএসএস সদস্য উলিয়াম টমার্স একপর্যায়ে আত্মগোপনে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। যখন শান্তি চুক্তি সম্পাদিত হলে তখন পুনরায় দেশে ফিরে আসেন। সেই দীর্ঘ ফেরারি জীবনের স্মারক-স্মৃতি হিসেবে শুধু কুকুর ছানাটি সঙ্গে করে নিয়ে আসেন। অবশ্য দেশে ফেরাকালে ভারত থেকে কোন কিছুই আনার সুযোগ বা অনুমতি ছিল না। কুকুর ছানাটি তাঁর অতিপ্রিয় ও আদরের পোষা ছিল। তাই অভিনব পন্থায় চেকপোস্টকে ফাঁকি দিয়ে একটি দিয়াশলাইয়ের প্যাকেটের ভেতর করে কোমরে গুজিয়ে নিয়ে আসে। এটি সম্ভবত পামরিয়ান জাতের কুকুর। ডোডোদেরও একটি গোল্ডেন প্রজাতির কুকুর আছে। এ প্রজাতির কুকুর আকারে বেশ বড়সড় হয়। ঢাকার জাপানি গার্ডেনে তাদের বাসা। ডোডো অষ্টম শ্রেণিতে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ে। একবার তাদের বাসায় যাওয়া হয়। তার বাবা সুদীপ্ত রায় গুপ্ত আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের একজন। খুবই সখ করে গোল্ডেন কোর প্রজাতির এ কুকুরটি তারা লালন-পালন করে আসছে। জাপানি গার্ডেনে ৭-৮ তালায় তাদের বাসা। লিফটে ওঠা-নামা করতে হয়। তাই দিকপালে খেয়েপরে-স্মরণে থাকে না এসব। এমনিতে লিফটে ওঠানামাতে
কম্পোটেবল মনে করি না। কখন যে আটকে পড়ি এর ভেতর। সেদিন হোটেল সৈকত-এর ৬ষ্ঠ তলা থেকে লিফটে নামতে গিয়ে আটকা পড়ার দশা হয়। ভাগ্যিস, একজন অপরিচিত নারী ওই লিফটে ছিল। স্মার্ট ওই নারী না থাকলে কি-যে দশা হতো বলাই মুশকিল ! আরেকবার প্রখ্যাত শ্রমিক নেতা ও শ্রমিক ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় নেতা এটিএম নিজাম উদ্দিনের চট্টগ্রামস্থ বোদ্ধ মন্দিরসংলগ্ন বাসায় যেতে গিয়ে একই দশা হয়। সেবারও অন্য বাসার এক পিচ্চি কাজের মেয়ে সদাই-পাতি নিয়ে উঠছিল। আমি যে ডেবরাধার-বোকা সে বুঝতে পেরেছে; মেয়েটি আমাকে ৫ তলা ওঠিয়ে দিয়ে পুনরায় তাদের বাসা চতুর্থ তলায় ফিরে। এরমধ্যে বন্ধু সুদীপ্তর সখের ঐ পালিত কুকুরকে নিয়ে একবার মহা বিপদে পড়ে। কুকুরটি একবার গ্রামে আসার সময় বাড়িতে নিয়ে আসে। গ্রামে তাকে দুদিন থাকতে হয়। কিন্তু সমস্যা হলো তার কুকুরটি নিয়ে। কুকুরটি অসুস্থ হয়ে পড়ে। রীতিমতো খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দেয়। এ নিয়ে তাকে চরম বেকায়দায় পড়তে হয়। শেষতক ডাক্তার এনে সুস্থ করে তোলে এবং দ্রুত ঢাকার বাসায় ফিরতে বাধ্য হয় কুকুরটি নিয়ে। কারণ, গ্রামের ওই পরিবেশ কুকুরটির মোটেই অসহনীয় ছিল না। থাকা, খাওয়া ও মলমূত্র ত্যাগ করা। সে তো বাসা-বাড়ি ও শহরের পরিবেশে অভ্যস্ত। তার জন্য পৃথক টয়লেট ও পৃথক থাকার রুম রয়েছে। অনেকটা পরিপাটি-অভিজাত্যের সংস্পর্শে জীবন প্রবাহ। আমিও একবার বেড়াতে গিয়ে একরাত ছিলাম ওই জাপানি গার্ডেনে। কেমন মনে হলো, কুকুরের বিছানা-পত্র ও রুম। ক্ষানিকটা অগোছালো মনে হওয়ায়, কিছুটা সংশয়ে রাত কাটাতে হয়। টয়লেটের ক্ষেত্রে শতভাগ নিশ্চিত ছিলাম। যাক, সেটিও অঁজপাড়া ও গ্রামের জনপদ থেকে শতগুণ উন্নত। তারপরও এমন সন্দেহের কথা ও ঘটনা না বলাই ভালো। আস্তা আর ভালোবাসার লোকজনদের নিয়ে এমন ভাবনা-চিন্তা করাটা অনভিপ্রেত। এরমধ্যে যে বিষয়টি সবার দৃষ্টি কাটে। ঢাকাস্থ মোহাম্মদপুরে অবস্থিত জাপানি গার্ডেনে ৫টি কুকুর ও ১টি বিড়াল হত্যা করার ঘটনা। অভিযোগ উঠে ওই ব্যবস্থাপনা কমিটির লোকজনের ওপর। বিশেষ করে খাওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে বিষ খাইয়ে নির্বোধ প্রাণীগুলো হত্যা করা হয়। বিগত পাঁচ-ছয় বছর পূর্বেও ঐ প্রাণীগুলোকে হত্যা করতে চেষ্টা করে কমিটির লোকজন। এখন সময়-সুযোগ পেয়েই হত্যাকান্ডটি সংঘটিত করে। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রাপ্ত ও দু’বাংলার জনপ্রিয় নায়িকা জয়া হাসান নিরীহ এ সকল প্রাণী হত্যার প্রতিবাদ করেন। ২৩ নভেম্বর নায়িকা জয়া হাসান-এর সোশ্যাল মিডিয়া পেইজে এবং একটি জাতীয় দৈনিকে তাঁকেসহ খবরটি গুরুত্ব সহকারে প্রকাশিত হয়। নায়িকা জয়া হাসানের এ প্রতিবাদকে হালকা করে দেখার সুযোগ নেই। ঘটনাটি পরিবেশবাদীদের দৃষ্টি আকৃষ্ট করে। কুকুর, বিড়ালসহ অন্যান্য প্রাণীও যে পরিবেশের সহায়ক, তিনি আঙ্গুল দিয়ে তা জানিয়ে দিলেন। আমরা হাতিরও করিডর স্বাধীনতা দাবি করে আসছি। কিন্তু একশ্রেণির লোকজন এসব অশোভনীয় আচরণ করে যাচ্ছে। সমানে হাতি, বানর, হরিণসহ অন্যান্য বন্য প্রাণী হত্যা করে চলেছে। তাদের বৈরী আচরণে পরিবেশ অসহনীয় হয়ে ওঠেছে। অবশ্য পরিবেশ অধিদপ্তর ও বনবিভাগ হাতির নিরাপদ বিচরণ- ভূমি অক্ষত রাখা বা সংরক্ষণ করা বা নো ম্যান ল্যান্ড বা অনুপ্রবেশ বন্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছে। সেন্টমার্টিন দ্বীপেও অভুক্ত কুকুরের খাওয়ার ব্যবস্থা করেছে।
বিশেষ করে কুকুরকে একবাক্যে বলা যেতে পারে, পরিবেশ সহায়ক প্রাণী। এছাড়া প্রভুভক্ত ও পরিচ্ছন্ন প্রাণী হিসেবে তার খ্যাতি-সুনাম আছে সহস্র কাল ধরে। সমাদৃত হয়েও আসছে লোকালয়ের জনমানবের। শত্রু ও চোর খেদানো তার ভূমিকা প্রশংসনীয়। সমানে ঘেউ ঘেউ করে সম্ভাব্য বিপদে গৃহস্থসহ পাড়া-প্রতিবেশীকে সজাগ করে। পাশাপাশি ময়লা- আবর্জনা, নষ্ট, পচা ও উচ্চিষ্ট খাবার খেয়ে পরিবেশকে স্বাভাবিক রাখে।
হাতির স্বাধীন করিডর স্থলে যেসকল স্থাপনা আছে, শীঘ্রই ওইসব স্থাপনা উচ্ছেদসহ সহনীয় পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। প্রয়োজনে সকল চুক্তিপত্র বা লিজ বাতিল করতে হবে এবং পরিবেশ সহনীয় দেশীয় প্রজাতির গাছগাছালি ও বনায়ন করতে হবে।
নায়িকা জয়া হাসানের এ প্রাণী প্রীতিকে অবশ্য সাধুবাদ জানাতে হয়। তাঁর সাথে কোনো এক অনুষ্ঠানে দেখা হয়েছিল। সীতাকুন্ডেও কোন একটা ছবির শ্যুটিং করেন তিনি। সীতাকুন্ডের ব্যাসকুন্ডের পাড়ে দৃশ্যপট ধারণ করে। তখনও একান্তভাবে কথা হয় এ নায়িকার সাথে। ভারতে কৃষ্ণসার দুটি হরিণ শিকার করার দায়ে নায়ক সালমান খানের পাঁচ বছর জেল হয়। তাঁকে রীতিমতো যোধপুর কেন্দ্রীয় কারাগারেও যেতে হয়।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধাবিষয়ক গবেষক, কবি ও কলামিস্ট