জব্বারের বলীখেলা শুক্রবার মেলা চলবে তিন দিন

1

নিজস্ব প্রতিবেদক

চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক আব্দুল জব্বারের বলীখেলা অনুষ্ঠিত হবে আগামী শুক্রবার। ১১৬তম এই আসর বসবে এদিন বিকাল ৪টায়। ঐতিহাসিক লালদীঘি ময়দানে তৈরি বিশেষ মঞ্চে লড়বেন দেশসেরা বলীরা। খেলাকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন এলাকার বলীরা ইতোমধ্যে আয়োজক কমিটির সাথে যোগাযোগ শুরু করেছেন।
গতকাল মঙ্গলবার বেলা ১২ টায় নগরীর লালদীঘি পাড় সিটি কর্পোরেশন লাইব্রেরি মিলনায়তনে আব্দুল জব্বারের বলীখেলার ১১৬তম আসর উপলক্ষে সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানিয়েছেন আয়োজক কমিটির সদস্য সচিব শওকত আনোয়ার বাদল।
এদিকে প্রতিবছরের মতো বলীখেলা ঘিরে ২৪, ২৫ ও ২৬ এপ্রিল বসছে দেশের অন্যতম বড় বৈশাখী মেলা। তবে এবার প্রধান সড়কে (আন্দরকিল্লা থেকে কোর্ট বিল্ডিং পর্যন্ত) মেলার স্টল বসতে দেওয়া হচ্ছে না বলে আয়োজকেরা জানিয়েছেন। যানজটের আশঙ্কায় নগর পুলিশের অনুরোধে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
সংবাদ সম্মেলনে আয়োজক কমিটির সদস্য সচিব শওকত আনোয়ার বাদল বলেন, ‘প্রায় ১১৫ বছর আগে চট্টগ্রাম শহরের বদরপাতির বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আমার দাদা আব্দুল জব্বার সওদাগর ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে এ অঞ্চলের যুবকদের শারীরিকভাবে প্রস্তুত করতে ১৯০৯ সালের ১২ বৈশাখ লালদীঘি ময়দানে এই বলীখেলা শুরু করেন। এরই ধারাবাহিকতায় জীবিত থাকতে তিনি, এরপর আমার মরহুম বাবা; ১৯৮৬ সাল থেকে আমি এবং ভাইয়েরা চট্টগ্রামবাসীকে নিয়ে প্রতিবছর ১২ বৈশাখ (২৫ এপ্রিল) বলীখেলা আয়োজন করে আসছি। এবারের বলীখেলার আসর ১১৬তম। এতে অংশ নিতে ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বলীরা আমাদের সাথে যোগাযোগ শুরু করেছেন’।

প্রাইজমানি চ্যাম্পিয়ন ৩০ হাজার, রানার্সআপ ২০ হাজার
শওকত আনোয়ার বাদল বলেন, ‘প্রতিবারের মতো এবারও বলীখেলায় অংশ নিতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রায় ১০০ জন বলী যোগাযোগ করেছেন। অংশগ্রহণকারী প্রত্যেক বলীর জন্য সম্মানি থাকবে। ট্রফিসহ চ্যাম্পিয়ন বলীকে ৩০ হাজার আর রানার্সআপকে ২০ হাজার টাকা দেওয়া হবে’।

প্রধান সড়কে বসছে না মেলা
শওকত আনোয়ার বাদল জানান, লালদীঘি মাঠে বলীখেলার জন্য মূল রিং স্থাপন করা হবে। নগরীর কোতোয়ালী মোড়, আন্দরকিল্লা, সিনেমা প্যালেস ও বদরপাতি এলাকা ঘিরে বসবে বৈশাখী মেলার শতাধিক স্টল। শিশুর পুতুল-খেলনা থেকে শুরু করে খাবার, হস্তশিল্প, পোশাক, কসমেটিকসহ নানান সামগ্রী পাওয়া যাবে মেলায়।
তবে নিরাপত্তা ও যান চলাচল স্বাভাবিক রাখতে আন্দরকিল্লা থেকে কোর্ট বিল্ডিং পর্যন্ত প্রধান সড়কে মেলার স্টল না বসানোর পরামর্শ দিয়েছে পুলিশ প্রশাসন। দোকান বিক্রি, দখল, চাঁদাবাজি রোধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কঠোর অবস্থানে থাকবে বলেও জানানো হয় সংবাদ সম্মেলনে।
আয়োজকদের পক্ষ থেকে জানানো হয়, চট্টগ্রামের সংস্কৃতির অংশ হয়ে ওঠা এই আয়োজনকে ঘিরে এবারও তিন দিনের বৈশাখী মেলায় নানা আয়োজন থাকছে। গ্রামীণফোন এবারের বলীখেলার প্রধান পৃষ্ঠপোষক। বলীখেলা উদ্বোধন করবেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার হাসিব আজিজ।বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেবেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন।
এদিকে জব্বারের বলীখেলাকে ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেতে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে লালদীঘি চত্বরকে তার স্মৃতিরক্ষায় নামকরণ এবং বলীখেলা একাডেমি প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনাও রয়েছে। এ লক্ষ্যে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানানো হয়।

গ্রামীণফোনের বক্তব্য
সংবাদ সম্মেলনে গ্রামীণফোনের চট্টগ্রাম সেন্ট্রাল রিজিয়নের রিজিওনাল হেড মোহাম্মদ মোরশেদ আহমেদ বলেন, ‘জব্বারের বলীখেলার মতো একটি ঐতিহ্যবাহী ও জনপ্রিয় আয়োজনে অংশ হতে পেরে গ্রামীণফোন গর্বিত। এর আগেও আমরা এই আয়োজনের পৃষ্ঠপোষক ছিলাম। আমরা স্থানীয় ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও কৃষ্টির প্রতি শ্রদ্ধাশীল। সমাজ ও মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে এমন আয়োজনের পাশে থাকতে সংকল্পবদ্ধ গ্রামীণফোন’।

ব্যবসায়ীদের অসন্তোষ
বলীখেলা ও বৈশাখী মেলাকে ঘিরে দূর-দূরান্ত থেকে এসেছেন দোকানিরা। আগের মতো মেলা শুরুর চারদিন আগেই চট্টগ্রামে এসে ‘নির্ধারিত’ স্থানে বসে আছেন তারা। অন্যবার মেলা শুরুর আগে থেকে চলতো তাদের বিক্রি। তবে এবার তা হচ্ছে না। এছাড়া, মেলা শুরু হলেও প্রধান সড়কে দোকান বসাতে পারবেন না তারা। এমন সিদ্ধান্ত শুনে তাদের অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন, অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন।
খেলনা বিক্রেতা আল হাসান বলেন, প্রধান সড়ক আগে বন্ধ করে দেয়া হতো। কিন্তু এবার তা করবে না জানিয়েছে। এমনটা জানলে এত কষ্ট করে আসতাম না। এখন যেহেতু চলে আসছি। তাই মেলার তিনদিন কোনো রকমে থাকতে হবে।
আব্দুল জব্বারের সম্মানে কিছুই হয়নি আজও
জব্বারের বলীখেলা ও মেলা চট্টগ্রামের ক্রীড়া, সংস্কৃতি এবং বিনোদনের অংশ হয়ে গেছে। যা এখন দেশের বৃহত্তম বার্ষিক লোক উৎসব হিসেবে পরিণত হয়েছে। আর প্রতিবছর এ খেলাকে ঘিরে আয়ও হয় বেশ। তবে খেলা-মেলা শেষের পরই আয়ের হিসাব হাওয়ায় মিশে যায়। অন্যদিকে এত বছরেও খোদ জব্বারের ‘সম্মানে’ কিছুই করা হয়নি।
সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিক মোহাম্মদ শাহ নওয়াজ বলেন, ‘পেছনের ইতিহাস ভুলে গেলে চলবে না। এ খেলার আয়োজন করতে গিয়ে যদি বাণিজ্যিক স্বার্থ, ব্যক্তি-গোষ্ঠীকে প্রাধান্য দিই বা শুধু বিনোদনের অংশ হিসেবে প্রাধান্য দিই; তাহলে আব্দুল জব্বারের স্মৃতির প্রতি এবং এই ঐতিহাসিক খেলার প্রতি অবিচার হবে। এ বলীখেলার ঐতিহাসিক গুরুত্ব এবং মর্যাদা ধরে রাখতে হবে। তাহলে এটা যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকবে’।
তিনি আরও বলেন, ‘দেশের যেকোনো ইভেন্টে ফাইন্যান্সিয়াল ট্রান্সপারেন্সি (আর্থিক স্বচ্ছতা) খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা দেখেছি- নগরে স্বাধীনতা ও মুক্তিযোদ্ধার নামে যে মেলা হতো; সেই মেলার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবই হাওয়ায় মিলে যেত। কোনো হিসাব-নিকাশ থাকতো না। কে টাকা তুলে, ফান্ড কোথায় যায় কোনো কিছুই নেই। একইভাবে জব্বারের বলীখেলাও এতদিন ধরে যারা আয়োজন করেছেন, এটার যে ইনকাম (আয়), এক টাকা নাকি ২শ’ কোটি, জানা নেই কারো! এছাড়া আনুষ্ঠানিক আয় কত, অনানুষ্ঠানিক আয় কত সেটাও কেউ জানে না’।
জব্বারের পরিবারকে উদ্দেশ্য করে শাহ নওয়াজ বলেন, ‘এত বছরেও জব্বারের সম্মানার্থে একাডেমি প্রতিষ্ঠা, স্মারকগ্রন্থ বের করা, সেমিনার করা, স্থায়ী প্রতিষ্ঠান করা সম্ভব হয়নি। আমরা ইউনেস্কোর দিকে তাকিয়ে আছি, সরকারের দিকে তাকিয়ে আছি। আমরা কার কাছে দাবি জানাব! আপনারা (জব্বারের পরিবার) এগিয়ে এলেই আমরা সামনের দিকে যেতে পারবো। এগুলো করার জন্য আপনাদের এগিয়ে আসতে হবে। সরকার বা ইউনেস্কোকে বাধ্য করার আগে আপনাদের নিজেদের উদ্যোগে কিছু করার দরকার ছিল। আপনারা চাইলে তো সেটি করতে পারতেন’।
তিনি বলেন, ‘এই বলীখেলা ঘিরে অতীতে যে ইনকাম হয়েছে সেটার ফান্ড কোথায় গেছে জানি না! তবে ভবিষ্যতে শৃঙ্খলা মেনে আয়ের হিসাব রেখে একটা ফান্ড প্রতিষ্ঠা করুন। আর সেই টাকা দিয়ে সামর্থ্য অনুযায়ী উনার (জব্বার) সম্মানার্থে কিছু করা শুরু করুন। তাহলে বাকিগুলো ধীরে ধীরে হয়ে যাবে’।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সদস্য সচিব জাহিদুল করিম কচি, গ্রামীণফোনের চট্টগ্রাম সেন্ট্রাল রিজিয়নের রিজিওনাল হেড মো. মোরশেদ আহমেদ, বিজনেস সার্কেলের মার্কেট কমিউনিকেশন প্রধান মো. আব্দুল্লাহ আল নূরসহ আয়োজক কমিটির সদস্যরা।