ড. মোহাম্মদ কামরুল হাসান
বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে জনপ্রশাসন ব্যবস্থার ওপর জন আস্থার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জনপ্রশাসন হলো রাষ্ট্রের কার্যকর পরিচালনার অন্যতম ভিত্তি। এ ব্যবস্থা যদি জনগণের আস্থা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়, তবে এটি রাষ্ট্রের সার্বিক উন্নয়ন, শাসন, এবং সামাজিক স্থিতিশীলতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। জনআস্থা হলো জনগণের বিশ্বাস যে, প্রশাসন তাদের সেবা ও অধিকার সুনির্দিষ্ট ও কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করতে সক্ষম। এটি মূলত প্রশাসনের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, দক্ষতা এবং নৈতিকতার ওপর নির্ভর করে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে, জনআস্থা হলো একটি দ্বিমুখী প্রক্রিয়া, একদিকে প্রশাসনকে সঠিকভাবে তার কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে, অন্যদিকে জনগণকে প্রশাসনের কার্যক্রম সম্পর্কে সচেতন ও ইতিবাচক মনোভাবাপন্ন হতে হবে। এই আস্থার অভাব রাষ্ট্রের সঙ্গে জনগণের সম্পর্কের অবনতি ঘটাতে পারে এবং এর ফলে প্রশাসনিক কার্যকারিতা হ্রাস পাড।
জনপ্রশাসন রাষ্ট্রের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান, যা দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে, জনপ্রশাসনের প্রতি জন-আস্থা আজও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। জনপ্রশাসন ব্যবস্থায় এই আস্থার অভাবের পেছনে কয়েকটি মূল কারণ রয়েছে। বাংলাদেশের জনপ্রশাসনে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতার অভাব অন্যতম প্রধান বাধা হিসেবে দেখা হয়। প্রশাসনের কার্যক্রম প্রায়শই গোপনীয়তার মধ্যে পরিচালিত হয়, যা জনসাধারণের মধ্যে অবিশ্বাসের জন্ম দেয়। সাধারণ মানুষ যখন প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের প্রেক্ষাপট এবং কার্যক্রম সম্পর্কে অবগত হতে পারে না, তখন তারা সেসব সিদ্ধান্তের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে। তাছাড়া, জবাবদিহিতার অভাব ও প্রশাসনিক কর্মচারীদের অবহেলা সাধারণত জন-আস্থার আরও বেশি ক্ষতি করে। পাশাপাশি, বাংলাদেশের জনপ্রশাসন ব্যবস্থায় দুর্নীতি এবং স্বজনপ্রীতির প্রভাব বহুল প্রচলিত।
প্রশাসনিক প্রক্রিয়ায় ঘুষ প্রদান, ক্ষমতার অপব্যবহার, এবং নৈতিকতার অভাব জনসাধারণের মধ্যে আস্থার অভাবে ভূমিকা রাখে। যখন মানুষ দেখে যে প্রশাসনিক সিদ্ধান্তগুলো প্রায়শই আর্থিক বা রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে পরিবর্তিত হচ্ছে, তখন তারা প্রশাসনের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে।
এছাড়া, বাংলাদেশে জনপ্রশাসনের মাধ্যমে প্রদত্ত সেবার মান প্রায়শই প্রত্যাশার তুলনায় অনেক কম। দীর্ঘসূত্রতা, জটিলতা, এবং দক্ষতার অভাব প্রশাসনিক সেবার প্রাপ্যতা এবং মান নিয়ে জনসাধারণের মধ্যে অসন্তুষ্টি বিদ্যমান। অধিকন্তু, অনেক ক্ষেত্রে প্রত্যাশার চেয়ে কম আইনের শাসন এবং ন্যায়বিচারের প্রাপ্তির কারণে জনপ্রশাসনের প্রতি জনসাধারণের আস্থা ধীরে ধীরে হ্রাস পায়। সেই সাথে যখন জনগণ দেখেন যে প্রশাসনিক প্রক্রিয়া ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে আইন অমান্য করা হয়, বা নিরপেক্ষতা অবলম্বন করা হয় না, তখন তারা প্রশাসনের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে। সর্বোপরি, বাংলাদেশের জনপ্রশাসন প্রায়শই রাজনৈতিক প্রভাব দ্বারা প্রভাবিত হয়। রাজনৈতিক চাপ প্রশাসনের কার্যক্রমকে অদক্ষ এবং পক্ষপাতদুষ্ট করে তোলে, যা জনসাধারণের মধ্যে অবিশ্বাস সৃষ্টি করে।
লোকপ্রশাসন এর বোদ্ধাদের মত অনুযায়ী রাষ্ট্রের কার্যকারিতা অনেকাংশে জনপ্রশাসনের কার্যকারিতার ওপর নির্ভর করে। এবং জনপ্রশাসন ব্যবস্থার কার্যকারিতা মূলত জনগণের আস্থার ওপর নির্ভর করে। সে কারণে জনআস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত যখন প্রশাসনের প্রতি জনগণের আস্থা থাকে, তখন প্রশাসনিক কার্যক্রমের সফলতা বৃদ্ধি পায়। উদাহরণস্বরূপ, সরকারের নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে জনগণের সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জনআস্থা থাকলে জনগণ সরকারি সিদ্ধান্তগুলোর প্রতি সমর্থন জানায় এবং নীতিমালার বাস্তবায়নে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। অন্যদিকে, যদি আস্থার অভাব থাকে, তবে নীতিমালার কার্যকারিতা ও সঠিক বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পরে।
জনআস্থার সঙ্গে সামাজিক স্থিতিশীলতার একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে। প্রশাসনের প্রতি জনগণের আস্থা থাকলে সমাজে শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় থাকে। বাংলাদেশে যখন কোনও বিশেষ সময়ে প্রশাসনের ব্যর্থতা বা অবহেলা দেখা যায়, তখন সমাজে অস্থিরতা ও সহিংসতার ঝুঁকি বেড়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যক্রমে অনাস্থা থাকলে বা আইনের শাসনে অবহেলা করা হলে, এটি সমাজে অস্থিরতার জন্ম দেয়।
অন্য দিকে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের জন্য প্রশাসনের ওপর জনআস্থার গুরুত্ব অপরিসীম। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প, যেমন অবকাঠামো উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ইত্যাদি ক্ষেত্রে জনপ্রশাসনের সঠিকভাবে কাজ করা এবং জনগণের আস্থা অর্জন করা জরুরি। জনগণ যদি বিশ্বাস করে যে, সরকার বা প্রশাসন তাদের উন্নয়নের জন্য সঠিক পদক্ষেপ নিচ্ছে, তবে তারা প্রকল্পগুলোতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করবে এবং সেগুলোর সাফল্য নিশ্চিত করবে। উদাহরণস্বরূপ, স্থানীয় পর্যায়ে উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে জনগণের অংশগ্রহণ এবং সহযোগিতা প্রশাসনের সফলতা নিশ্চিত করে এবং প্রকল্পগুলো টেকসই করে।
বিশেষ করে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে প্রশাসনের ওপর জনআস্থা থাকা অত্যন্ত জরুরি। অন্যথায়, জনসাধারণের মধ্যে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবনতা বৃদ্ধি পায় যার প্রমাণ বাংলাদেশে প্রায়শই দেখা যায়। অধিকন্তু, বাংলাদেশে প্রশাসনিক উদ্ভাবন ও দক্ষতা বৃদ্ধির জন্যও জনআস্থা অপরিহার্য। প্রশাসনের ওপর জনআস্থা থাকলে প্রশাসনিক কর্মকাÐে উদ্ভাবনী চিন্তাধারা ও প্রযুক্তির ব্যবহার উৎসাহিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, ই-গভর্নেন্স বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে জনআস্থা প্রশাসনের সক্ষমতা ও কার্যকারিতা বাড়িয়েছে। যখন জনগণ বিশ্বাস করে যে, প্রশাসন উদ্ভাবনী ও কার্যকরী সেবা প্রদান করতে সক্ষম, তখন তারা প্রশাসনিক সেবা গ্রহণে আগ্রহী হয় এবং প্রশাসনের উদ্যোগগুলোতে সহযোগিতা করে।
প্রশাসনিক ব্যবস্থায় জনআস্থার অভাবের ফলে রাষ্ট্রে নানাবিধ বিরূপ প্রভাব পরে যা বৈশ্বিক অবস্থা বিশ্লেষণ করলে প্রমান পাওয়া যায়। মালয়েশিয়ার মতো দেশে, যেখানে রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি জনগণের আস্থা কমছে, সেখানে নির্বাচনের সময় ভোটার উপস্থিতির হার কমে যাচ্ছে। ভোটাররা বিশ্বাস করতে পারছে না যে তাদের ভোট প্রশাসনিক প্রক্রিয়ায় কোনও প্রভাব ফেলবে। এর ফলে, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার উপর প্রভাব পড়ছে এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ছে। জনআস্থার অভাব সরাসরি অর্থনৈতিক উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে। ভিয়েতনামের ক্ষেত্রে দেখা যায়, ব্যবসায়ী মহল প্রশাসনের প্রতি আস্থা না রাখায় তাদের বিনিয়োগের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। তারা বিশ্বাস করে যে প্রশাসনিক দুর্নীতি এবং অব্যবস্থাপনার কারণে তাদের বিনিয়োগ সুরক্ষিত থাকবে না। এর ফলে দেশটির অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে এবং সার্বিকভাবে দেশের উন্নয়ন মন্থর হচ্ছে। প্রশাসনের প্রতি জনআস্থার অভাবের কারণে সরকারি সেবাগুলোর মানেও অবনতি ঘটে। উদাহরণস্বরূপ, ভারতের বিভিন্ন সরকারি স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মান নিয়ে জনগণের ব্যাপক অসন্তোষ রয়েছে। জনআস্থার অভাবে, জনগণ প্রায়ই বেসরকারি খাতে নির্ভরশীল হয়ে পরে, যা দেশের সার্বিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য ক্ষতিকর। অধিকন্তু, যখন প্রশাসনিক ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা নষ্ট হয়, তখন সমাজে বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা দেখা দেয়। মালয়েশিয়া এবং ভারতের মতো দেশে প্রশাসনের প্রতি আস্থার অভাবে আইনের শাসন দুর্বল হচ্ছে, এবং অপরাধের মাত্রা বাড়ছে।
বাংলাদেশের জনপ্রশাসন ব্যবস্থার ওপর জনআস্থা অর্জন ও বজায় রাখা একটি অত্যাবশ্যকীয় বিষয়। প্রশাসন যদি জনগণের আস্থা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়, তবে তা রাষ্ট্রের সুশাসন, স্থিতিশীলতা, এবং সার্বিক উন্নয়নের পথে বাধা সৃষ্টি করবে। জনআস্থা বৃদ্ধির জন্য প্রশাসনকে সঠিকভাবে কার্যক্রম পরিচালনা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, এবং নৈতিকতার মানদন্ড বজায় রাখতে হবে। একই সঙ্গে, দুর্নীতি প্রতিরোধ, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, এবং সামাজিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় প্রশাসনের সক্ষমতা নিশ্চিত করতে হবে। এভাবে, জনআস্থা বৃদ্ধির মাধ্যমে একটি সুশাসিত, স্থিতিশীল ও উন্নয়নমুখী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। (সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন)
লেখক: লোকপ্রশাসন গবেষক