সারা দেশে চলছে তীব্র গ্যাস সংকট। বাসাবাড়ি, সিএনজি স্টেশন, শিল্প-কলকারখানা সর্বত্র একই অবস্থা। চট্টগ্রাম নগরীর অধিকাংশ এলাকার বাসাবাড়িতে সকাল ৭টার পর থেকে দিনভর চুলা জ্বলছে না। বাধ্য হয়ে অনেকে মধ্যরাতে জেগে রান্নার কাজ সারছেন। এ অবস্থায় লাইনের গ্যাসের পাশাপাশি কেউ কেউ এলপিজি সংযোগ আর কেউ সিলিন্ডার নিতে বাধ্য হচ্ছেন। বাসাবাড়ির পাশাপাশি একই সংকট পেট্রোল পাম্পেও। পেট্রোল পাম্পে গ্যাসের চাপ না থাকায় যানবাহনের দীর্ঘ লাইন তৈরি হয়েছে। একটি গাড়ির গ্যাস নিতে কমপক্ষে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা লাগছে। গ্যাসের সংকটের কারণে গণপরিবহন কমে গেছে সড়কে। ফলে সংকটে পড়ছেন সাধারণ মানুষ। এ অবস্থা শুধু চট্টগ্রাম নগরীতে নয়, রাজধানী ঢাকাসহ পুরো দেশে। চট্টগ্রাম গ্যাস সরবরাহ করে বাখরাবাদ আর ঢাকাসহ অন্যান্য জেলায় তিতাস। দৈনিক পূর্বদেশসহ স্থানীয় ও জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, গ্যাসের চাপ না থাকায় অনেক শিল্প-কারখানা দিনে বন্ধ রাখতে হচ্ছে। চট্টগ্রামে গ্যাসচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং সার কারখানা রেশনিং করে চালাতে হচ্ছে। চট্টগ্রাম, ঢাকা, গাজীপুর, সাভার ও নারায়ণগঞ্জসহ সারা দেশের বেসরকারি শিল্পাঞ্চলে চলছে এই সংকট। শিল্পমালিকরা বলছেন, একদিকে ডলার ক্রাইসিস অন্যদিকে গ্যাস সংকট চলতে থাকলে এই সেক্টরে শিগগিরই বড় বিপর্যয় নেমে আসবে। উৎপাদন কমে আসায় নিত্য ব্যবহার্য পণ্যের সংকট বাড়ার সঙ্গে পালস্না দিয়ে দাম বাড়বে। এতে উর্ধ্বমুখী মূল্যস্ফীতিকে আরও উসকে দেবে। পাশাপাশি রপ্তানি বাণিজ্যও মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে। যা রিজার্ভের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে উৎপাদন না বাড়ায় গ্যাসের সংকট কাটছে না। বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) বলছে, দীর্ঘদিন ধরে গ্যাস খাত চলছে রেশনিং (এক খাতে সরবরাহ কমিয়ে অন্য খাতে দেওয়া) করে। দেশে দিনে গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে ৩০০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হয়। কোনো কারণে সরবরাহ এর চেয়ে কমলেই বেড়ে যায় সংকট।
তিতাস ও কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিভিউশন লিমিটেড (কেজিডিসিএল)এর একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, শীতকাল এলেই দেশে গ্যাসের সংকট তৈরি হয়। পাইপলাইনে কনডেন্সড জমে গ্যাসের স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়। কিন্তু এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। দেশে গ্যাস উৎপাদন হ্রাস, ডলার সংকটে এলএনজি আমদানি না হওয়ার পাশাপাশি চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় বর্তমানে দেশে গ্যাসের সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। সেইসঙ্গে একটি টার্মিনাল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সেই সংকট আরও বেড়েছে। পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে, দুটি টার্মিনালের একটি শিডিউল রক্ষণাবেক্ষণের জন্য চার দিন বন্ধ রাখা হচ্ছে। এতে এলএনজি সরবরাহ কমেছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই গ্যাসের সংকট বেড়েছে। অপর টার্মিনাল সামিটের সর্বোচ্চ সরবরাহেও চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না।
তীব্র গ্যাস সংকটে শিল্পকারখানার উৎপাদন কতটা কমেছে, সে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে রীতিমত আঁতকে উঠতে হয়েছে। বেশিরভাগ শিল্প মালিকরা জানিয়েছেন, তাদের উৎপাদন ন্যূনতম ৩৫ শতাংশ কমেছে। গ্যাস সংকটে কোনো কোনো শিল্পকারখানা বিকল্প শক্তি ব্যবহার করে উৎপাদন স্বাভাবিক রাখতে গিয়ে বাড়তি খরচ করছে। উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় উৎপাদিত পণ্য বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।
এদিকে আবাসিকে গ্যাস সংকটের কথা স্বীকার করছে কেজিডিসিএল কর্তৃপক্ষ। তাদের দাবি, শীতে সঞ্চালন লাইনে সমস্যার কারণেই এই সংকট। ঠান্ডা কমে গেলে আবাসিকে গ্যাস সংকট কেটে যাবে বলে দাবি করেন তিতাসের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। যদিও মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা অনেকেই এ ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করেছেন। তাদের ভাষ্য, সামগ্রিকভাবে গ্যাস সংকট না কাটলে আবাসিকে সরবরাহ বাড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। কেননা, শিল্প-কারখানা, বিদ্যুৎকেন্দ্র, বাসাবাড়ি ও গ্যাস স্টেশন- সবখানেই গ্যাস রেশনিং করা হচ্ছে। গত কয়েকদিন ধরে চট্টগ্রাম ও রাজধানী ঢাকাসহ দেশজুড়ে গ্যাসের যে হাহাকার চলছে, তা রীতিমত ক্ষোভে পরিণত হয়েছে। অনেকেই গ্যাস সিলিন্ডার, ইলেক্ট্রিক চুলা, রাইস কুকার, মফস্বল শহওে লাকড়ির চুলায় রান্না করছেন। কেউ হোটেল থেকে খাবার কিনে আনছেন। একই অবস্থা সিএনজি ফিলিং স্টেশনও। গ্যাস কর্তৃপক্ষসহ সকলেই স্বীকার করেছেন শীতে তীব্রতায় গ্রাস সঞ্চালন বাধাগ্রস্ত হওয়ার কারণে গৃহ থেকে র্শিপ প্রতিষ্ঠান সকল পর্যায়ে সঙকট সৃষ্টি হয়। এটি স্বাভাবিক, তবে আধুনিক প্রযুক্তির যুগে এসব কারণ দেখিয়ে দায় এড়ানোর চেষ্টাকে গ্রাহক সহজে গ্রহণ করবে না। আমরা মনে করি, সারা বিশ্বের অধিকাংশ দেশে শীতকালে তীব্র তুষারপাত হয়, তাপমাত্রা শূন্যের কোটায় চলে যায়, সেখানেও নিশ্চয় গ্যাসের সঞ্চালন আছে। এসব দেশের গ্যাস সঞ্চালনের প্রক্রিয়াটা আমরা জেনে নিতে পারি। তাদের আইডিয়া কাজে লাগিয়ে সংকট উত্তরণের পথ পাওয়া যাবে বলে আমরা আশা করি। এক্ষেত্রে সরকার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেবে-এমনটি প্রত্যাশা করেন গ্রাহকরা।